আসামির সঙ্গে গোপন বৈঠকের ঘটনায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর পদ থেকে তুরিন আফরোজকে অপসারণ করেছে সরকার। সোমবার আইন ও বিচার বিভাগের সলিসিটর অনুবিভাগ থেকে জারি করা এক প্রজ্ঞাপনে তার নিয়োগ বাতিল করা হয়।
এতে তুরিনের শৃঙ্খলা ও পেশাগত আচরণ ভঙ্গ এবং গুরুতর অসদাচরণের অভিযোগ আসে। এ ব্যাপারে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের বক্তব্য হল, ‘তুরিন আফরোজকে অব্যাহিত দেয়াটা জরুরি হয়ে পড়েছিল।
যে সাক্ষ্যপ্রমাণ আছে, সেগুলো কিন্তু অল আর ডকুমেন্টরি। এজন্য আমরা সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে অব্যাহিত দিয়েছি।’ তবে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে এ ধরনের পদক্ষেপে হতাশা প্রকাশ করেছেন তুরিন আফরোজ।
জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই) ও পাসপোর্ট অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক (ডিজি) মুহাম্মদ ওয়াহিদুল হকের বিরুদ্ধে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধ মামলা পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজ।
গত বছর এপ্রিলে অভিযোগ ওঠে, মামলা পরিচালনার দায়িত্ব পাওয়ার পর ২০১৭ সালের নভেম্বরে ওয়াহিদুল হককে ফোন করে কথা বলেন তুরিন। পরে পরিচয় গোপন করে ঢাকার একটি হোটেলে তার সঙ্গে দেখাও করেন।
ওই অভিযোগ ওঠার পর প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে ওয়াহিদুল ও তুরিনের কথোপকথনের রেকর্ড ও বৈঠকের অডিও রেকর্ডসহ যাবতীয় তথ্যপ্রমাণ আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। এরপর ট্রাইব্যুনালের সব মামলা থেকে সরিয়ে দেয়া হয় তুরিনকে।
তুরিন সেসময় অভিযোগের বিষয়ে সরাসরি কোনো জবাব দেননি। ফেসবুক পোস্টে নিজেকে নির্দোষ দাবি করলেও ওই গোপন বৈঠকের কথা তিনি অস্বীকার করেননি।
জানতে চাইলে তুরিন আফরোজ যুগান্তরকে বলেন, ‘যে দায়িত্ব আমাকে দেয়া হয়েছিল, আমি একশভাগ সতততার সঙ্গে পালন করেছি। জ্ঞানত আমি এমন কিছু করিনি, যাতে আইন ভঙ্গ বা কোনোভাবে আস্থা ভঙ্গ করেছি।
আমি শুনেছি এ বিষয়ে একটি তদন্ত কমিটি হবে, সেখানে নিদেনপক্ষে আমাকে আত্মপক্ষ সমর্থন দেয়ার জন্য ডাকা হবে। না ডেকেই একটা সিদ্ধান্ত দিয়ে দেয়া হল। তারপরও এ সিদ্ধান্ত আমি মেনে নিচ্ছি। মেনে নিতেই হবে।’
যুদ্ধাপরাধের বিচারে ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের তিন বছরের মাথায় প্রসিকিউটর হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন তুরিন আফরোজ। জামায়াতে ইসলামীর আমীর অধ্যাপক গোলাম আযমের মামলাসহ গুরুত্বপূর্ণ বেশ কয়েকটি মামলা পরিচালনায় ভূমিকা রাখেন তিনি। তাকে ওয়াহিদুল হকের মামলার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল ২০১৭ সালের নভেম্বরে।
তুরিন আফরোজকে অপসারণের পর সোমবার বিকালে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সচিবালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নে বলেন, এই পদক্ষেপ নেয়া জরুরি হয়ে পড়েছিল। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল, যে মামলা তিনি নিজে করছিলেন, সেই মামলার একজন আসামির সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করতে গিয়েছিলেন।
মামলার আলোচনা করার সময় এও বলেছিলেন যে, এ মামলায় কোনো সারবর্তা নেই। সেই যে কথোপকথন টেপ করা হয়। টেপ করা কথোপকথনগুলো এবং তার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর অভিযোগ আমাদের কাছে পাঠান। এ অভিযোগ নিয়ে সাক্ষীদের কাছে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে এবং ওনার সঙ্গে কথা বলার প্রয়োজন যতটুকু মনে করি হয়েছিল।
তিনি বলেন, যে সাক্ষ্যপ্রমাণ আছে, সেগুলো কিন্তু অল আর ডকুমেন্টরি। এজন্য আমরা সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে অব্যাহিত দিয়েছি। তুরিনের আগের কাজে নিজের সন্তুষ্টির কথা জানিয়ে আনিসুল হক বলেন, ‘যে কারণে আজ তাকে অব্যাহতি দেয়া হল, তার আগ পর্যন্ত তিনি কিন্তু নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে গেছেন।
এ ব্যাপারে তার সেন্স অব জাজমেন্ট কেন কাজ করেনি, আমি জানি না। তার দিক থেকে এসব বক্তব্য সেটা তার গলা বলে প্রমাণিত হয়েছে। এটা উনি কেন করলেন, আমরা বুঝতে পারছি না। এটা দুঃখজনক।’
অপসারণের বিষয়ে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘কাজটা যে আমি খুশি হয়ে করেছি, তা না। কিন্তু তাকে অব্যাহতি দেয়াটা জরুরি হয়ে পরে। কারণ যে মামলা নিয়ে কথা হচ্ছে, সেই মামলায় চার্জ গঠন হয়ে গেছে, সেই কারণে আমার মনে হয়, এই ব্যাপারটি একটি নিষ্পত্তি টানা দরকার ছিল। সেজন্য এটা করা হয়েছে।’
তুরিনের কর্মকাণ্ড ফৌজদারি অপরাধ কি না জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘আমি তো এ রকম কথা বলতে পারব না, আমার এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য নেই।’
আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেয়া হয়েছিল কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তার সঙ্গে কথা হয়েছে। কিন্তু টেপ করা কথাবার্তা আমরা পেয়েছি এবং তার বিরুদ্ধে নালিশ হয়েছে। সার্বিক আলোচনা করার পর তাকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে।’
এটা চলমান শুদ্ধি অভিযানের অংশ কি না- এ প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা আশা করি, যে আইনজীবীরা এ কাজে নিয়োজিত আছেন, তারা তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে অত্যন্ত সজাগ। তাদের নতুন কোনো মেসেজ দিতে হবে বলে আমি মনে করি না।’