দলের ভাবমর্যাদা উজ্জ্বল এবং নিজের জনপ্রিয়তা ৯৭ থেকে শতভাগে উন্নীত করতে প্রধানমন্ত্রী সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে অপসারণের পর এখন যুবলীগকে ‘ধরেছেন’ এবং পরে মূল দলেও শুদ্ধি অভিযান পরিচালনা করবেন বলে দলের নিবেদিতপ্রাণ প্রবীণ নেতা ও সমর্থক বুদ্ধিজীবী মহল, সুশীল সমাজ এবং ব্যবসায়ী নেতারা মনে করছেন। শুদ্ধি অভিযানের গতি, ব্যাপ্তি ও ধরন দেখে আমজনতা তাদের সাথে একমত হতে পারছে না। মাত্র ১০ মাস আগে সব দলের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত একাদশ সংসদ নির্বাচনে কাস্টিং ভোটের ৯৭ শতাংশ পেয়ে চৌদ্দদলীয় জোট প্রার্থীরা ৯৭ শতাংশ আসনে জয়ী হয়ে তাদের দাবি মাফিক, জনপ্রিয়তার প্রমাণ রেখেছেন। ওই নির্বাচনে ৮৪.৪০ শতাংশ ভোট পড়েছিল যার ৯৭ শতাংশ চৌদ্দদলীয় প্রার্থীদের পক্ষে পড়ায় ২৯২টি আসনে তা এক থেকে চার লক্ষাধিক ভোটের ব্যবধানে ‘জয়ী’ হয়ে রেকর্ড সৃষ্টি করেছেন, যা মিসর ও উত্তর কোরিয়ায় সম্ভব। দলনেত্রীর প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির প্রার্থীর পক্ষে পড়েছিল মাত্র ১২৪টি ভোট। ২০০৮ সালের নির্বাচনে চৌদ্দদলীয় জোট পেয়েছিল ২৬৫টি আসন এবং ২০১৪ সালের নির্বাচনে ২৮৫টি আসন যার ১৫৪টি ছিল বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। গত তিনটি সংসদ নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, প্রধানমন্ত্রীর জনপ্রিয়তা দলের জনপ্রিয়তার চেয়ে দ্বিগুণ বেশি। প্রতিবেশী ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত নেহরুর উত্তর ভারতেও এমন জনপ্রিয় নেতার উত্থান ঘটেনি, যিনি পরপর তিনটি নির্বাচনে বিপুল জনপ্রিয়তা নিয়ে ক্ষমতাসীন হতে পেরেছেন। ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, শ্রমিক লীগ ও মূল দলের নেতাকর্মীরা আগে যাই করুক তার তুলনায় দলের ভাবমর্যাদা গত এক দশকের চেয়ে ক্ষুণ্ন হয়েছে এবং এর জনপ্রিয়তা ৯৭ শতাংশ থেকে হ্রাস পেয়ে ৫০ শতাংশ এর নিচে নেমে গেছে। গত নির্বাচনের চার-পাঁচ মাস আগে সাধারণ ছাত্র পরিষদের গড়ে তোলা চাকরিতে কোটাবিরোধী ও প্রবেশের বয়সসীমা বৃদ্ধির আন্দোলন এবং স্কুল-কলেজের কিশোর ছাত্রছাত্রীদের গড়ে তোলা ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলন যেভাবে হেলমেট বাহিনী নামিয়ে আন্দোলনকারীদের শায়েস্তা করা হয়েছিল, তার নেতিবাচক প্রভাব সারা দেশের নির্বাচনী ফলাফল দূরে থাক; ঢাকা শহরের ১৫টি আসনের ফলাফলেও পরিলক্ষিত হয়নি। অথচ এটাই ছিল স্বাভাবিক। ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালের নির্বাচনে একমাত্র সাদেক হোসেন খোকা ব্যতীত কোনো দলের কোনো প্রার্থীই পরপর দুইবার নির্বাচিত হতে পারেননি। তবে ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিজয়ী ১৪ দলের প্রার্থীরাই ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে পরপর তিনবার নির্বাচিত হয়ে ঢাকা শহরে তাদের ‘জনপ্রিয়তা’র স্বাক্ষর রেখেছেন। এ অবস্থায় প্রশ্ন, পর পর তিনটি নির্বাচনে ৯০ শতাংশ থেকে ৯৭ শতাংশ ভোটে ‘বিপুল জনপ্রিয়তা নিয়ে জয়ী’ দল একটানা তিন হাজার ৬৫২ দিন ক্ষমতায় থাকার পর মাত্র ৩০০ দিনের মধ্যে এমন কী ঘটনা ঘটল যার কারণে ১০ বছর ধরে তৈরি করা নিজ দলের নেতাদের বিরুদ্ধে ঘোষণা দিয়ে শুদ্ধি অভিযান চালাতে হচ্ছে?
গত তিন সপ্তাহের অভিযানের গতি, ধরন ও ব্যাপ্তি দেখে মনে হচ্ছে- ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের আসন মেয়র নির্বাচনকে সামনে রেখে দুর্নীতি, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, দখলবাজি, কমিশন বাণিজ্য, নিয়োগ বাণিজ্য, ভর্তি বাণিজ্য ও সিট বাণিজ্য এবং এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ বাণিজ্যের কারণে ক্ষুব্ধ নগরবাসীকে নৌকামুখী করার লক্ষ্যে এ সব তৎপরতা। ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে অপসারণের প্রত্যাশিত প্রভাব সংগঠনের নেতাকর্মীদের ওপর না পড়ায় ভিন্ন মতের ছাত্র সংগঠনকে আক্রমণ এবং সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওপর তাদের একক নিয়ন্ত্রণ বাস্তবে বহাল রয়েছে। যুবলীগের যে নেতার কর্মকাণ্ডে প্রধানমন্ত্রী উষ্মা প্রকাশ করে এই অভিযান শুরুর নির্দেশ দিয়েছিলেন, সেই নেতার গ্রেফতারে ১৬-১৭ দিন লেগে যায়। তিন সপ্তাহব্যাপী অভিযানে যুবলীগের তিন নেতার বাসভবন ও ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালিয়ে সাত কোটি ২৬ লাখ টাকা, ১৬৫ কোটি টাকার এফডিআর, ৯ হাজার মার্কিন ডলার ও ৭২০ ভরি স্বর্ণালঙ্কার উদ্ধারের পর অভিযানের দিক পরিবর্তন করে ক্লাব ও বারের দিকে নজর দেয়ায় জনমনে সন্দেহের উদ্রেক করেছিল। যেসব নেতার পৃষ্ঠপোষকতায় ক্লাবগুলোয় বিদেশী জুয়া ও ক্যাসিনো চলত আগে তাদের গ্রেফতার করে তাদের দেয়া তথ্যমতে ক্লাবে অভিযান চালালে জনমনে সন্দেহের উদ্রেক হতো না। কচ্ছপ গতিতে অভিযান পরিচালনার কারণে প্রভাবশালী পৃষ্ঠপোষক ও সুবিধাভোগী নেতাদের অনেকে প্রমাণ লোপাট করে আত্মগোপনের সুযোগ পাওয়াই স্বাভাবিক। গোয়েন্দা রিপোর্টের ভিত্তিতে যদি অভিযান পরিচালিত হয়ে থাকে তবে তা সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্য একযোগে পরিচালিত হওয়ার কথা। যেমন নির্বাচনকালে ও ভোট গ্রহণের পূর্ব রাতে এবং দিনের বেলায় পুলিশ, র্যাব ও বিজিবি একযোগে দেশের ৬৮ হাজার গ্রামে ও ৪২ হাজার ভোটকেন্দ্রে অভিযান চালিয়ে তাদের ‘সক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ’ ঘটিয়েছিল। দেশব্যাপী না হোক যদি এই শুদ্ধি অভিযান একযোগে একই দিনে ঢাকা, চট্টগ্রাম, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ ও সাভারে পরিচালিত হতো তাহলে তা ৮০ শতাংশ সফল হতো বলে জনগণ মনে করে।
ছাত্রলীগ, যুবলীগ, শ্রমিক লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও মূল দলের বিপথগামী নেতারা ২০০৯ সাল থেকে ২০১১ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত পদপদবির জোরে দুর্নীতি, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, দখলবাজি, কমিশন বাণিজ্য, নিয়োগ বাণিজ্য, ভর্তি বাণিজ্য, সিট বাণিজ্যসহ বিভিন্ন অপকর্ম রাখঢাক রেখে করতেন। ৩০ জুন ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংবিধান থেকে মুছে ফেলে ক্ষমতাসীন দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সাংবিধানিক ক্ষমতা অধিগ্রহণের পরেই নিশ্চিত হয়ে যায়, ২০১৪ সাল থেকে পরবর্তী নির্বাচনগুলো একই সরকারের অধীনেই হবে। তাই তারা যতদিন ক্ষমতায় আছেন ততদিন সরকারের নির্বাচনে পরাজয়ের ঝুঁকি ০% (শূন্য পারসেন্ট)। দলের পরিচয়ে দুর্নীতি, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, দখলবাজির মতো অজনপ্রিয় ও জনভোগান্তিমূলক কাজের প্রভাব ভোটের বাক্সে ফেলার সাহস জনগণের হবে না ভেবেই দলীয় পদপদবির পরিচয়ে এবং প্রশাসন ও পুলিশের একাংশের সহায়তায় যাচ্ছে তাই করা হয়েছে। ২০০৬ সালের তুলনায় দুর্নীতি ০.০০১% না কমা সত্ত্বেও, বিশ্বের আরো ১২টি দেশ দুর্নীতিতে আমাদের চেয়ে এগিয়ে যাওয়ায় আমাদের অবস্থান ১ নম্বর থেকে ১৩ নম্বরে উন্নীত হওয়াকেই আমরা ‘দুর্নীতি কমার স্বীকৃতি’ বলে বগল বাজাচ্ছি। বিশ্বের ১ নম্বর দৌড়বিদ উসাইন বোল্টও যেমন খুব বেশি বছর প্রথম স্থান তার দখলে রাখতে পারেননি তার চেয়ে দ্রুতগতির মানবের ট্র্যাকে আগমন ঘটায়, তেমন হয়েছে আমাদের অবস্থা।
অনেক প্রবীণ নেতা আওয়ামী লীগে ও ১৪ দলে থাকলেও গত ১০ বছরে বিপথগামী নেতাকর্মীদের বিভিন্ন অপকর্ম তারা দেখেও না দেখার ভান করায় তাদের বক্তব্য হালে পানি পাচ্ছে না। গত ১০ বছরে রাজধানী এবং সব বিভাগীয় শহরে, জেলা ও উপজেলা শহরে রাজনৈতিক ছত্র ছায়ায় এবং প্রশাসন ও পুলিশের সহায়তায় হাজার হাজার শেঠ, সম্রাট, ভূঁইয়া, প্রধান, তালুকদার ও চৌধুরীর উত্থান ঘটেছে। তা প্রবীণ নেতা ও গোয়েন্দাদের অগোচরেই হয়েছে? ২০১৪ সাল থেকে যে নির্বাচনী সংস্কৃতি চালু অদ্ভূত হয়েছে এবং ২০১৮ সালে যার পূর্ণতা দেয়া হয়েছে তাতে ঢাকা ও চট্টগ্রামের মেয়র নির্বাচনে সরকারদলীয় প্রার্থী জয়ী হওয়ার কথা। কিন্তু সরকারের সৃষ্ট সমস্যা আরো ঘনীভূত হবে যদি না শুদ্ধি অভিযান সঠিক ট্র্যাকে থাকে। বিদ্যমান নির্বাচনী ব্যবস্থায় ক্ষমতাসীন দলের পরাজয়ের সম্ভাবনা ০% (শূন্য পারসেন্ট)। ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে যে রেকর্ড এরশাদ একা গড়তে পারেননি- নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ ও জাপা যৌথভাবে সেই রেকর্ড সৃষ্টি করবে বলেই ধারণা করা যায়। গত ১০ বছরে প্রশাসন ও পুলিশের সব কর্মকর্তা ও কর্মচারী তিন-চারটি করে পদোন্নতি পেয়েছেন। নতুন নিয়োগ কিভাবে হয়েছে এবং কারা নিয়োগ পেয়েছেন, তা উপদেষ্টা এইচ টি ইমামের বক্তব্য থেকেই বোঝা যায়। এই কারণেই ছাত্রলীগ, শ্রমিক লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, যুবলীগ ও মূল দলের নেতাদের সাথে প্রশাসন ও পুলিশ কর্মকর্তাদের একাংশের বাটোয়ারার সুসম্পর্ক গড়ে উঠেছে। তাদের নেতৃত্বে পরিচালিত শুদ্ধি অভিযান জনগণের কাক্সিক্ষত রূপ নেবে না নিশ্চয়ই। কাজেই ১০ বছর ধরে গেড়ে বসা ‘দুর্নীতি, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, কমিশন বাণিজ্য, নিয়োগ বাণিজ্য, ভর্তি বাণিজ্য ও সহজ সিট বাণিজ্য’ দূর হবে না জনগণ জানে না শাসক দলের সেই সদিচ্ছা আসলেই আছে কি না।