মো. আব্দুল কাইয়ুম : প্রত্যেক বাবা-মার’ই সন্তানের প্রতি অকৃতিম ভালবাসা থাকে। বাবা-মা না খেয়ে যে সন্তানদের খাওয়ায়, যে সন্তানদের হৃদয় দিয়ে আগলে রাখেন, আর সেই সন্তান যখন ঘাতকের হাতে নিরাপরাধভাবে খুন হন তখন বাবা-মার হৃদয় নিংরানো কান্না থামানোর মতো কেউ কি দুনিয়াতে আছে? এমনি এক মা’র সন্তান নৃশংস খুনের শিকার হয়েছিলো দীর্ঘ ১৩ বছর আগে।
২০০৬ সালের অক্টোবর মাসের ১৩ তারিখের ঘটনা। ঠিক যেন চলতি বছরের অক্টোবরের এই দিনটির মতোই সেদিনও ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার মাইজবাগ ইউনিয়নের সাধুরগোলা গ্রামের জিয়াউর রহমান সারাদিন বাবা-মার সাথেই ছিলো। তবে দিনটি ছিলো পবিত্র মাহে রমযানের। সারাদিন রোযা রেখে বাবা-মার সাথে শেষ ইফতার করেন জিয়াউর রহমান। ২৫ বছরের এই যুবক ছিলো পরিবারের একমাত্র উপার্জনশীল ব্যক্তি। বৃদ্ধ বাবা-মাকে ভরন-পোষণের দায়িত্বটি পালন করতে হতো থাকেই। প্রতিদিন বৃদ্ধ বাবা-মার জন্য সন্ধায় হাতে করে নিয়ে আসতো কলা আর রুটি। বাবা-মাকে সেবা করার জন্য জিয়া ছিলো এক অনন্য যুবক। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস। জিয়া সেদিন বৃদ্ধ বাবা-মাকে নিয়ে একসাথে ইফতারি করে বিশ্রাম নিয়ে তারাবির নামায পড়তে বের হন ঘর থেকে। বাড়ি থেকে অল্প দূরত্বের মসজিদে যেতে হলেও বেশ কয়েকটি বাড়ি অতিক্রম করতে হয়। জিয়া তারাবির নামাযে যেতে তার নিজ বাড়ির সকল নামাযীদের নিয়ে মসজিদের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন। কিন্তু পথিমধ্যে একটি বসত ঘরে এক মহিলার হৈ চৈ শব্দ শুনতে পান জিয়াসহ সকলেই। জিয়াসহ উপস্থিত সকলের মনে সন্দেহ হলে ঘরের দরজায় কড়া নাড়েন। উপস্থিত সবার মনে সন্দেহ ছিলো যে, এই ঘরটির যে মালিক সে এলাকার কুখ্যাত খুনী ও ধর্ষক। মহা সড়কের সাথেই যেহেতু ঘরটি, সেহেতু হয়তবা রিক্সা থেকে কোনো অপরিচিত মহিলাকে জোরপূর্বক ঘরে আটকে রাখছে কু-খ্যাত কাশেম। কারণ হিসেবে এলাকার সবাই বলেন, কাশেম এর আগেও মানুষ খুন করেছে, ধর্ষণ করেছে। একটি খুনের ঘটনা টাকা পয়সা দিয়ে ম্যানেজও করেছিলেন। যাই হোক, ওই ঘরের দরজার সামনে উপস্থিত সবাই যখন জিয়ার খুনি কাশেমকে দরজা খুলতে বলছিলো তখন কাশেম দরজার সামনে থেকে সবাইকে চলে যেতে বলছিলো। কিন্তু সবার মনে যখন সন্দেহ হলো তার কুমতলব রয়েছে। সেহেতু একজন নারীকে ধর্ষনের হাত থেকে রক্ষা করতে দরজায় ধাক্কাধাক্কি করলে কাশেম এক পর্যায়ে দরজা খুলে দেয়। দরজা খুলার পর এক অজ্ঞাত মহিলাকে দেখতে পায় সকলেই। আর তখনি ঘটে মর্মান্তিক ঘটনা। কাশেম নিজেকে সেইফ রাখতে ছোরা দিয়ে জিয়ার গলায় ঘাই দেয়। সাথে সাথে উপস্থিত সবাই আশ্চর্য হয়ে যায়। সবাই রক্তাক্ত জিয়াকে নিয়ে ছুটে চলে। এদিকে এলাকাবাসী কাশেম ও অপরিচিত মহিলা আছমা খাতুনকে আটক করে। মারা যায় জিয়া। আটকের পরে অবশ্য এই মহিলার পরিচয় পাওয়া যায়। এই মহিলা সম্পর্কে তার এলাকায় খারাপ ধারণা রয়েছে। এভাবেই বাবা-মার এক আদরে সন্তানের জীবনের সমাপ্তি ঘটে।
এ প্রতিবেদক গত ১৩ অক্টোবর জিয়ার বাড়িতে গেলে এক হৃদয় বিধারক দৃশ্য দেখতে পায়। জিয়ার মা জমিলা খাতুন ঝাপটে ধরে এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমার ছেরারে এই দিনেই মারছে কাশেম। আমার ছেরার মরার খবর হুইন্যে হের বাপও স্ট্রোক করে। কয়েকদিন পরে তার বাপও মইরা যায়। আমি ১৩ বছর ধইরা সন্তান-স্বামী হারাইয়া কত কষ্টে দিন কাটাইতাছি তা আল্লাহ জানে। আমার বুকটা ফাইট্টা যাইতাছে আইজক্যা।’
এ প্রতিবেদক মৃত জিয়াউর রহমানের ভাই সৌদি প্রবাসী দেলোয়ার হোসেনের সাথে কথা বললে তিনি জানান, ‘আমার ভাই ইফতারের পর আমার বৃদ্ধ বাবাকে রাতের খাবার খাইয়ে তারাবির নামায পড়তে যাওয়ার সময় এই নিষ্টুর কাশেম হত্যা করে। আর এই দীর্ঘ ১৩ বছরের প্রথম কয়েক মাস সে আমাকে ও পরিবারের অন্য সদস্যদের মামলা তুলে নিতে হুমকি দেয়। পরে মামলা না তোলায় সন্ত্রাসী নিয়ে মাঝে মাঝে রাস্তা ঘাটে সমস্যা করে। এখনও বলে, ফাঁসির আদেশ হলেও হাইকোর্ট বসে আছেন তার সাজা কমানোর জন্য। সাজা থেকে মুক্তি পেয়ে আবারো প্রতিশোধ নিবে বলে এখনও হুমকি দেয় কাশেম। তবুও আল্লাহ ভরসা। মামলা চালিয়েছি সত্য ও ন্যায় বিচারের আশায়। আমি পবিত্র মক্কা নগরীতে আছি। উকিলের সাথে কথা হয়েছে মোবাইলে। শীঘ্রই আমার বৃদ্ধ মা’র ন্যায় বিচার পাওয়ার স্বপ্ন পূরণ হবে ইনশাআল্লাহ।