রোহিঙ্গা প্রত্যাবাস এখন আন্তর্জাতিক একটি সমস্যা। কিন্তু সমস্যাটি আজ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পরিবর্তে বাংলাদেশকে বহন করতে হচ্ছে। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর অমানবিক নির্যাতন, গণহত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে দেশ ছাড়া করে। বিতাড়িত প্রায় ১১ লাখ রহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে মানবিক কারণে আশ্রয় দেয় বাংলাদেশ। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশ ভয়াবহ সঙ্কটে রয়েছে। তাদের মানবাধিকার ঠিক রেখে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর বাংলাদেশের প্রচেষ্টা চীন, রাশিয়া, ভারত আর জাপানের সদিচ্ছার অভাবে বারবার ব্যর্থ হচ্ছে।
বন্ধু হিসেবে পরিচিত প্রতিবেশী ভারত, চীন ও রাশিয়া বিশ্ববিবেককে উপেক্ষা করে ইতিহাসের নৃশংসতম গণহত্যা, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগের মতো ঘটনাকে সমর্থন দিয়ে ঢাকাকে কূটনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত করছে। মূলত ভূরাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থে চীন ও রাশিয়া জাতিসঙ্ঘে মিয়ানমায়ের পক্ষ নিয়েছে। বিশ্বের পারমাণবিক শক্তিধর এ দুটি দেশের ছত্রছায়ায় মিয়ানমার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আহ্বানকে উপেক্ষা করছে। রোহিঙ্গা ইস্যুর মতো একটি মানবিক ইস্যুতে বাংলাদেশ কেন চীন, রাশিয়া আর ভারতকে কাছে পাচ্ছে না সে নিয়ে আলোচনা জরুরি।
৬৭৬৫৫২ বর্গকিলোমিটার আয়তনবিশিষ্ট মিয়ানমারের সাথে ১৯৪৯ সালে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি ক্ষমতায় আসার পর থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত সম্পর্ক ভালো ছিল না। মিয়ানমারের অভ্যন্তরে বিদ্রোহী কমিউনিস্ট পার্টি অব বার্মার (সিপিপি) পৃষ্ঠপোষক ছিল চীন। ১৯৭৮ সালে চীনা নেতা দেং জিয়াও পেং মিয়ানমার সফরে আসেন। ১৯৮৬ সালে সিপিবির ওপর থেকে সম্পূর্ণ সমর্থন তুলে নেয় চীন। বৈরী সম্পর্ক সহযোগিতায় মোড় নেয়।
চীন তেল-গ্যাস, খনিজসম্পদসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিনিয়োগসহ বাণিজ্যিক সুবিধা পায়। দারিদ্র্যপীড়িত মিয়ানমার সামরিক শাসনের কবলে পড়লে যুক্তরাষ্ট্র ও এর মিত্র দেশসহ সংগঠনের অবরোধের মুখে পড়ে। ওই সময়ে দেশটির চীন সীমান্তসংলগ্ন পূর্বাঞ্চলে ৩০টি স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠীর সশস্ত্র আন্দোলন দমন করতে ব্যর্থ হচ্ছিল সামরিক সরকার। তখন চীন সামরিকভাবে সহায়তা করে মিয়ানমারকে। চীনের অন্যতম শত্রু রাষ্ট্র ভারতের ওপর ভূ-রাজনৈতিক কৌশলগত সুবিধা বাড়াতে মিয়ানমারের সাথে চীন সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করে। ফলে দেশের অভ্যন্তরে জাতিগত বিদ্রোহ, বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন দমাতে মিয়ানমারকে বহুমুখী সাহায্যের হাত প্রসারিত করে বেইজিং। এ সুবিধা পেয়ে নেপিডো একটি শক্তিশালী সমর শক্তির দেশ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে। একটি গবেষণাপত্রের তথ্য, ১৯৮৮-২০০৬ সাল পর্যন্ত মিয়ানমার কেবল চীনের কাছ থেকে ১৬৯ কোটি ডলারের অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম কিনেছে। কোনোভাবে চীন এত বড় অস্ত্রের বাজার হাত ছাড়া করতে চাইবে না। এ ছাড়াও মিয়ানমারে চীনের বিপুল বিনিয়োগ রয়েছে। দেশটির প্রকাশিত পরিসংখ্যানে বলা হয়, এর পরিমাণ ১৮০০ কোটি ডলার, যা সব পশ্চিমা দেশের মোট বিনিয়োগের দ্বিগুণেরও বেশি।
এদিকে চীন সীমান্তসংলগ্ন মিয়ানমারের কাচিন, সান কোকাং অঞ্চলসহ কয়েকটি রাজ্য ও এলাকায় স্বাধীনতাকামীদের অর্থ ও অস্ত্র সহায়তা দেয়ার অভিযোগ রয়েছে চীনের বিরুদ্ধে। মিয়ানমারকে হাতে রাখতেই এ দ্বিমুখী কৌশল। কাজেই মিয়ানমারের নিজের নিরাপত্তার জন্য যেমন চীনকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়; ঠিক তেমনি চীনও অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থে মিয়ানমারকে না চটিয়ে কৌশলগত সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে। স্পষ্টত, বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে মিয়ানমারকে চাপ দেবে না চীন।
পুতিন রাশিয়ায় ক্ষমতায় আসার পর মিয়ানমারের সাথে সম্পর্ক বাড়ানোর চেষ্টা করেন। বিশেষ করে ২০১৫ সালে মিয়ানমারের ওপর থেকে আন্তর্জাতিক অবরোধ উঠে গেলে দেশটিতে বিনিয়োগ ও অস্ত্র বিক্রির উদ্যোগ নেয় রাশিয়া। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীকে আধুনিকীকরণ, নতুন প্রযুক্তি ও প্রজন্মের অস্ত্রভাণ্ডার সমৃদ্ধকরণ এবং বিমানবাহিনীর সক্ষমতা বাড়ানো ও স্বাধীনতাকামী আন্দোলন দমাতে সহায়তা নেয়া ইত্যাদি নানামুখী কারণে রাশিয়ার অস্ত্রের প্রতি মনোযোগ দেয় মিয়ানমার।
১৯৮৮-২০০৬ সাল পর্যন্ত মিয়ানমার রাশিয়ার কাছ থেকে ৩৯ কোটি ৬০ লাখ ডলারের অস্ত্র ক্রয় করেছে। মিয়ানমারে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ, দেশটির খনিজসম্পদ আহরণে রাশিয়া প্রচুর বিনিয়োগ করেছে। কাজেই রাশিয়া রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক স্বার্থে কৌশলগত কারণে মিয়ানমারের ওপর রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে পক্ষাবলম্বন ছাড়া চাপ দেবে না।
ভারতের স্বাধীনতাকামীদের আন্দোলন দমন, করিডোর, ট্রানজিট, ট্রান্সশিপমেন্ট ইত্যাদি ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কাছ থেকে সব সুবিধা নিলেও মিয়ানমারের সাথে সীমানাসংলগ্ন এক হাজার ৬৪৩ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে স্বাধীনতার দাবিতে আন্দোলনরত তিনটি রাজ্য মনিপুর, নাগাল্যান্ড ও মিজোরামের বিদ্রোহ দমন করতে নেপিডোর বিশেষ সহযোগিতা প্রয়োজন।
সেভেন সিস্টার্স খ্যাত ভারতের সাতটি রাজ্যে পণ্য পরিবহন, সামরিক সরঞ্জামাদি প্রেরণ ও সড়ক যোগাযোগের একমাত্র স্থলপথ ‘চিকেন নেক’ বলে পরিচিত শিলিগুড়ি করিডোর। করিডোরটি ভারতের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ চীন-ভারত যুদ্ধ হলে বেইজিং পথটি বন্ধ করে দিলে এবং বাংলাদেশের ট্রানজিট সুবিধা না পেলে ওই সাতটি রাজ্যের ওপর থেকে দিল্লির নিয়ন্ত্রণ হারানোর ভয় আছে। এ ছাড়াও ভারত মিয়ানমারে অস্ত্র বিক্রির চেষ্টা চালাচ্ছে। অখণ্ড ভারতের সার্বভৌমত্বের হুমকি মোকাবেলায় ভারত ৫০ কোটি ডলার খরচ করে রাখাইনের রাজধানী সিতওয়ে থেকে উত্তর-পূর্ব ভারতের মিজোরামের মধ্য দিয়ে লম্বা একটি মাল্টিমোড আল বা বহুমাত্রিক যোগাযোগ স্থাপনার পরিকল্পনা করেছে, যার নাম দেয়া হয়েছে ‘কালাদান মাল্টিমোড ট্রান্সপোর্ট প্রজেক্ট’।
সীমান্তসংলগ্ন উত্তর রাখাইন যেহেতু ভারতের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ, সেহেতু ভবিষ্যতে এ অঞ্চলে যেকোনো বিশৃঙ্খলা ভারতের জন্য সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। এ ছাড়াও ভারতীয় নীতিনির্ধারকেরা মনে করেন, ভারতকে ঘিরে ফেলছে চীন। তাই নিরাপত্তা ও সামরিক কৌশলগত কারণে মিয়ানমারে চীনের প্রভাব কমাতে আদাজল খেয়ে লেগেছে ভারত। সর্বোপরি অখণ্ড ভারতের সার্বভৌম বজায় রাখতে এবং অর্থনৈতিক কূটনীতি আরো ঘনিষ্ঠ করতে ভারত যেখানে মরিয়া, সেখানে রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের বিপক্ষে অবস্থান নেয়ার প্রশ্নই আসে না।
বাংলাদেশকে উপলব্ধি করতে হবে, ভূ-রাজনীতি, অর্থনৈতিক বা স্বার্থগত রাজনীতির কারণে যারা মানবিক বিষয় পাশ কাটিয়ে ঢাকার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে; তারা এটিকে বিষফোঁড়া হিসেবে দেখতে চাইবে এটিই স্বাভাবিক, যা বাংলাদেশের জন্য পীড়ার কারণ হতে পারে। তাই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন হালকাভাবে না নিয়ে মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টিতে ঢাকাকে কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়াতে হবে।