আরেকটি কলঙ্কজনক অধ্যায়

গত ৬ অক্টোবর রাতে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদের হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। এই নির্মম, নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডে দেশবাসী বিস্মিত, হতবাক। বিশ্বমিডিয়াতেও এই খবর গুরুত্বের সাথে প্রচারিত হয়েছে। দেশ ও দেশের বাইরে নিন্দার ঝড় উঠেছে। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। ক্যাম্পাস অশান্ত হয়ে উঠেছে। এই লোমহর্ষক হত্যাকাণ্ডের নিন্দার ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। দেশের একজন প্রবীণ শিক্ষক হিসেবে একজন ছাত্রের এহেন করুণ পরিণতির কথা চিন্তা করে আমার মন দুঃখ-বেদনায় ভারাক্রান্ত। বারবার মনে হয় যেন আমারই এক সন্তান তার একটি ব্যক্তিগত মত প্রকাশ করার কারণে ছাত্রনামধারী সন্ত্রাসী ও গুণ্ডাদের হাতে প্রাণ বিসর্জন দিলো। আমাদের মতো যেকোনো বাবার জন্য এর চেয়ে দুঃখের ও বেদনার ঘটনা আর কিছু হতে পারে না।

এই হত্যাকাণ্ডের পটভূমি কী ছিল, কীভাবে আবরারের ওপর নির্যাতন চালানো হয়েছে, কারা নির্যাতন চালিয়েছে, কেন চালিয়েছে এসব আর কারো অজানা নয়। বিভিন্ন মিডিয়াতে এসব তথ্য প্রচারিত হয়েছে। জানা গেছে, আবরার ফাহাদ অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিল। মাত্র দেড়-দু’বছর আগে সে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসে।

ভর্তি পরীক্ষায় সাফল্যের স্বাক্ষর রাখে। তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক কৌশল বিভাগে ভর্তি হয় এবং শেরেবাংলা হলের আবাসিক ছাত্র ছিল। ঘটনার দিন আবরার ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছিল। সেটি ছিল পাশ্ববর্তী একটি দেশকে বাংলাদেশের বন্দর ব্যবহারের অনুমতিসংক্রান্ত এবং বাংলাদেশের নদীর পানি বণ্টনের হিস্যা নিয়ে। এই স্ট্যাটাসের মর্মার্থ যদি আমরা বুঝে থাকি, তা হলে যা সে বলতে চেয়েছিল তা হলো-প্রতিবেশী দেশের সাথে চুক্তি হবে সমতার ভিত্তিতে। পানি বণ্টন কিংবা বন্দর ব্যবহার- সব ক্ষেত্রেই সমঝোতা বা চুক্তি হবে ন্যায়ের ভিত্তিতে। এ ধরনের স্ট্যাটাসকে কোনোভাবেই অযৌক্তিক বলা যায় না। যেকোনো সচেতন ও দেশপ্রেমিক নাগরিক দেশের স্বার্থের কথা তো বলবেনই। স্কুল, কলেজ পেরিয়ে যে শিক্ষার্থী অধিকতর উচ্চশিক্ষার জগতে প্রবেশ করেছে, তার পক্ষে দেশের স্বার্থের কথা বলাটাই স্বাভাবিক।

দেশের স্বার্থবিরোধী কোনো চুক্তি বা কোনো কর্মকাণ্ড কোনো শিক্ষিত তরুণই সমর্থন করতে পারে না। আবরার ফাহাদের মতো এ দেশের লাখ কোটি তরুণ দেশমাতৃকার পক্ষে এ ধরনের কথা বলতে পারে, এ ধরনের মত পোষণ ও প্রকাশ করতে পারে। নিজ দেশের স্বার্থে কথা বলা, কাজ করা প্রত্যেক নাগরিকের দায়িত্ব। অতএব, এ কথা নিঃসন্দেহ বলা যায় যে, ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে আবরার কোনো অপরাধ করেনি।

একটি স্বাধীন দেশে মত প্রকাশের অধিকার সব মানুষেরই আছে। মত প্রকাশের স্বাধীনতা মানুষের মৌলিক অধিকার। যে দেশে এই মৌলিক অধিকারকে খর্ব করা হয় সে দেশ কি সত্যিকারের স্বাধীন? মৌলিক অধিকার সংরক্ষণের জন্য কিংবা হারানো মৌলিক অধিকার ফিরে পাওয়ার জন্য যুগে যুগে, দেশে-দেশে আন্দোলন-সংগ্রাম সঙ্ঘটিত হয়েছে। এ সব সংগ্রামে জনগণ জয়লাভ করেছে। আবরার ফাহাদের এটি ছিল ব্যক্তিগত মত। তার এই মতকে কেউ সমর্থন করতে পারে আবার কেউ বা না-ও সমর্থন করতে পারে। কেউ যদি তার সাথে ভিন্নমত পোষণ করে, সেটি সে প্রকাশ করতে পারে। এ ক্ষেত্রে তার হত্যাকারীরা যদি তার সাথে দ্বিমত পোষণ করত, তা হলে কিছু বলার ছিল না। কিন্তু আমরা কী দেখলাম? দেখা গেল, সন্ত্রাসী হত্যাকারীরা এই মত প্রকাশের কারণে তার মূল্যবান জীবনটি হরণ করে নিলো।

এমন পাশবিক নির্যাতনের ঘটনা বিরল। একটি ছাত্র সংগঠনের ছাত্রনামধারী দুর্বৃত্তরা নির্মমভাবে পিটিয়ে আবরারকে হত্যা করেছে। এ হত্যাকাণ্ড বিশ^বিবেককেও নাড়া দিয়েছে। বাংলাদেশে জাতিসঙ্ঘের প্রতিনিধি, ব্রিটিশ ও জার্মান রাষ্ট্রদূত এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা এই হত্যাকাণ্ডের নিন্দা এবং দোষীদের শাস্তি দাবি করেছেন। তাদের অনেকেই শোকপ্রকাশ এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করেছেন। আমাদের দেশের সর্বস্তরের মানুষ এ ঘটনায় গভীর উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছেন; নিন্দা জানিয়েছেন এবং দোষীদের শাস্তি দাবি করেছেন। পুলিশ ইতোমধ্যেই হত্যাকারীদের অনেককেই গ্রেফতার করেছেন। অপর দিকে, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যাপারে অনেকে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। কারণ, অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে বলা যায়, খুনিদের অনেকে ছলেবলে কৌশলে, আইনের ফাঁকফোকরে বা রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে মুক্তি পেয়ে যায়।

মানুষের মনে স্বভাবতই একটি প্রশ্ন জাগে, আবরারের খুনিরা কেন সন্ত্রাস, খুন, জখম, মাদক, চাঁদাবাজ ইত্যাদি অপরাধের সাথে যুক্ত হলো? তারা তো অপরাধী হয়ে জন্মগ্রহণ করেনি। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায়, পরিবেশ পরিস্থিতি তাদেরকে এ পথে টেনে এনেছে। বিশেষ করে তাদের ক্ষেত্রে বলা যায়, তারা নষ্ট ছাত্ররাজনীতির সাথে যুক্ত হয়ে হীনস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য এই পথে এসেছে।

এ দেশের যে বৃহত্তর সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবেশ, তা তাদেরকে অপরাধ জগতে প্রবেশ করতে সাহায্য করেছে। ওরা যখন দেখতে পায় একটি সংগঠনের ছত্রছায়ায় বিভিন্ন ধরনের দুর্নীতি ও চাঁদাবাজি হয়, অন্যের অর্থ-আত্মসাৎ করে, লুটতরাজ করে সমাজে প্রতিষ্ঠা পাওয়া যায়, ধনসম্পদ আহরণ করা যায়, গাড়ি-বাড়ি, ফ্ল্যাটের মালিক হওয়া সম্ভব তখন তারা এই পথের পথিক হতে অনুপ্রাণিত হয়। অনেকেই এটাকে বলে থাকেন, সামাজিক অবক্ষয়। কিন্তু সামাজিক অবক্ষয় কি আপনা-আপনি সৃষ্টি হয়? অবক্ষয় তখনই জন্ম নেয় যখন সমাজের প্রতিষ্ঠিত নৈতিক, মানবিক ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে ধ্বংস করা হয়। আমাদের দেশে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ কীভাবে ধ্বংস করা হয়েছে সে কথা আজ আর কারো অজানা নয়। একজন তরুণ যদি বুঝতে পারে, ভোট ছাড়াও এমপি, মন্ত্রী হওয়া যায়; সে যদি দেখতে পায় কিংবা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তা ফেরত দিতে হয় না; সে যদি দেখতে পায় যে, অবৈধ উপায়ে অর্থ-উপার্জন করে তারই দলের নেতা প্রচুর ধনসম্পদের মালিক হয়েছেন; সে যদি দেখতে পায় তার নেতানেত্রী অনবরত অসত্য বলে যাচ্ছেন; তা হলে তার পক্ষে নীতি-নৈতিকতায় অবিচল থাকা কি সম্ভব?

সে তো তার সংগঠনের নেতানেত্রীদের অনুসরণ করে নীতি-নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে চাঁদাবাজি, হত্যা, লুটপাটের দিকে পা বাড়ানো স্বাভাবিক। এভাবেই সামাজিক ও রাজনৈতিক অবক্ষয়ের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায়।

একজন তরুণ-তরুণীর সামনে যদি দেশপ্রেমের তথা দেশের জন্য ত্যাগ-তিতিক্ষার উদাহরণ থাকে, তাহলে সে সহজেই নীতিভ্রষ্ট হবে না। তাই আমরা দেখি-সমাজ গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ওপর প্রতিষ্ঠিত হলে সেখানে অপরাধ হয় কম। যে সমাজে মানুষের অধিকার হরণ করা হয়, যে সমাজ লুটপাট ও দুর্নীতিতে নিমজ্জিত, সেখানে মানুষ অসহায়বোধ করে। হতাশায় নিমজ্জিত হয়। নীতি-নৈতিকতা থেকে দূরে সরে যায়। আবরারকে যারা খুন করেছে তাদের আদর্শ যদি হয় জুয়া ও ক্যাসিনো মালিকদের আদর্শ, তাদের আদর্শ যদি হয় ভোট ডাকাতি, তাদের আদর্শ যদি হয় নির্যাতন ও নিপীড়নের মাধ্যমে ক্ষমতার বলয় সৃষ্টি করা, তাহলে তারা এ অন্যায় পথেই প্রতিষ্ঠিত হতে চাইবে। এই অবস্থা কোনো দেশ ও জাতির জন্যই কাম্য নয়। ’৬০-এর দশকের ছাত্ররাজনীতি ছিল আদর্শভিত্তিক।

তাই দেখা যায়, ছাত্র সংগঠনগুলো আন্দোলনের মাধ্যমে অনেক মহান অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু সেই সময়ও আইয়ুব ও মোনায়েমের মদদপুষ্ট এনএসএফ নামক ছাত্রনামধারী গুণ্ডারা এ ধরনের নিষ্ঠুর-নির্যাতন চালিয়েছিল। অনাচারে অত্যাচারে বৃহত্তর ছাত্র সমাজ ছিল অতিষ্ঠ। কিন্তু ছাত্রসমাজ এক সময় এনএসএফকে রুখে দাঁড়ায়। তদানীন্তন আইয়ুব সরকারের গুণ্ডারা হার মানতে বাধ্য হলো। অবশেষে সরকারের মদদপুষ্ট এনএসএফ বাহিনী ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। সংগ্রামী ছাত্রজনতার জয়ধ্বনিতে আকাশ-বাতাস মুখরিত হয়ে ওঠে। এ পথ ধরেই ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম।

ইতিহাসের শিক্ষা থেকে বলা যায় যে, একদিন এই অশুভ শক্তি অর্থাৎ আবরারের হত্যাকারী ও তার দোসররা পরাজিত হবেই। জয় হবে আবরারের ও প্রতিবাদী ছাত্রজনতার। আবরার এ দেশে শহীদের স্বীকৃতি পাবে এবং অমরত্ব লাভ করবে।

লেখক : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাবেক উপাচার্য ও রাষ্ট্রদূত

Share this post

scroll to top