৫ অক্টোবর ছিল শহীদ নোমান দিবস। রাইসুল হাসান নোমান এদিন নিহত হয়েছিলেন। বাংলাদেশের রাজনীতির প্রেক্ষাপটে তো বটেই এমনকি যে ময়মনসিংহে নোমান নিহত হন সেখানকার আজকের ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতা বিবেচনাতেও নোমানের মৃত্যুর আলাদা করে কোন গুরুত্ব নেই।
নোমান ছিলেন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ শাখার সহ-সাধারণ সম্পাদক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেশনাল পরীক্ষা দিতে গিয়ে ভাইভা বোর্ডে ঘাতকদের উপর্যুপরি ছুরির আঘাতে পরীক্ষকদের সামনেই লুটিয়ে পরেছিলেন নোমান। ঘাতকের দল অস্ত্র উঁচিয়ে, বীরদর্পে ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ শ্লোগান দিতে দিতে ক্যাম্পাস ছেড়েছিল সেদিন। আর চিকিৎসকদের শত চেষ্টা আর পানির মত রক্ত দিয়েও বাঁচানো যায়নি নোমানকে। শহীদ নোমানের মৃত্যুর পর একটি মামলা হয়েছিল। পরে কি এক অদৃশ্য অঙ্গুলি হেলনে খারিজ হয়ে যায় তা। হয়তো ’৯০-এর পর বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ এমন আইনি পদক্ষেপ। হয়তো জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কর্মীদের হত্যা মামলায় দণ্ডিত করাটা হয়তো সেসময়কার বিচারিক সংস্কৃতিতে অনাকাঙ্খিত ছিল।
১৯৮৮ সালে নোমান যখন শহীদ হন আমি তখন ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের প্রথমবর্ষের ছাত্র। শহীদ নোমানের রক্তমাখা অ্যাপ্রনটা আমি দেখেছিলাম। এখনও দেখি মাঝে মধ্যেই চোখ বুজলেই। আমার মেডিকেল ছাত্র জীবনে আমি যতবার ‘এক নোমান লোকান্তরে, লক্ষ নোমান ঘরে-ঘরে’ কিংবা ‘নোমানের রক্ত বৃথা যেতে দেব না’ শ্লোগান দিয়েছি ততবার স্রষ্টার নাম স্মরণ করলে, সম্ভবত আমার জন্য পরকালে বেহেশতের একটি প্রকোষ্ঠ বরাদ্দ হওয়া নিশ্চিত ছিল! স্রষ্টার মন গললেও গলেনি অবুঝ বিচারকের মন। বিচারকরা শত চেষ্টার পরও কেন জানি নোমানের বিচারের দিক থেকে চোখ বুজেই রেখেছিলেন। অবশ্য তাদের চোখের কালো পট্টি সরানোর প্রয়োজনও আর পরবে না। ছেলের হত্যাকারীদের এই পৃথিবীর আলো-বাতাসে পুষ্ট হতে দেখেই সম্প্রতি পাকাপাকিভাবে চোখ বুজেছেন শহীদ নোমান জননী।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নিপুণ হাতের ছোঁয়ায় বদলে যাচ্ছে দেশ। এর ব্যতিক্রম নয় ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজও। আজকের ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজকে আমি চিনি না। আমি এখানে ক্লাস করিনি, মিছিলে মিলাইনি গলাও। কিন্তু নাড়ির টানটা এখনও অটুট। এখনও ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ শুনলে কানটা আপনা-আপনি খাড়া হয়ে যায়, এখনও এমএমসিয়ান শুনলে বুকে টেনে নিতে ইচ্ছে করে, এখনও ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের একজন নোমানের স্মরণে হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়।
শহীদ নোমানকে আমরা যারা দেখেছি তার সৌধ আমাদের হৃদয়ে। কিন্তু আজকে যারা নোমানের উত্তরসূরি, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের যেসব শিক্ষার্থীদের জন্ম নোমানের মৃত্যুরও অনেক পরে, তারা কিভাবে জানবে একজন নোমানের কথা? তারা কিভাবে শিখবে যে বঙ্গবন্ধুকে ভালবেসে অকাতরে জীবনদানের চেয়ে গর্বের আর কিছু নেই!
কোন দাবি জানাতে নয়, এই লেখাটার অবতারণা ছোট্ট একটা অনুরোধ জানাতে। শুধুই ছোট্ট একটা অনুরোধ। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ ক্যাম্পাসে ঢুকতেই হাতের ডান পাশে ওই যে অডিটোরিয়ামটা, নোমান বেঁচে থাকতে যেখানে ছিল লন টেনিস কোর্ট, ওই অডিটোরিয়ামটার গায়ে কি নোমানের নামটা লিখে দেয়া যায় না? নোমান তো জীবনটাই দিয়ে গেলেন, প্রতিদানে এইটুকু কি খুব বেশি চাওয়া? বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে একজন শহীদ নোমান কি এতটুকু প্রত্যাশা করতে পারেন না?
লেখক :
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের লিভার বিভাগের চেয়ারম্যান এবং সম্প্রীতি বাংলাদেশ- এর সদস্য সচিব।