রোববার (২৯ সেপ্টেম্বর) রাত সাড়ে দশটা। অর্ধবয়স্ক লোকটির পরনে পুরনো ময়লা লুঙ্গি, ছিন্ন গেঞ্জি ও গলায় প্যচানো গামছা। ঝলমলে চট্টগ্রাম নগরীর জামালখানের এক অভিজাত রেস্টুরেন্টের বিপরীতে রাস্তার পাশে ডাস্টবিন হাতড়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতেই উচ্ছিষ্ট খাচ্ছিলেন—এই দৃশ্য আমাকে থমকে দিল। প্রশ্ন করলাম—এখানে কী করছেন? এই দুর্গন্ধযুক্ত উচ্ছিষ্ট কেন খাচ্ছেন? লজ্জায় আমাকে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিলেন। অনেক জিজ্ঞাসার পর বললেন, ‘কাজ নেই। তাই খাবারও নেই।’
নিজের সম্পর্কে বলতে শুরু করলেন তিনি। বললেন, ‘আবর্জনা তো কী হয়েছে, এখানে একমুঠো ভাত হয়তো পাই, ক্ষুধায় সবই সুখাদ্য।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমার নাম আব্দুল শুক্কুর, বাড়ি ময়মনসিংহ। পেটের দায়ে চট্টগ্রামে বসবাস করছি অনেক দিন থেকেই। কাজের অভাবে হাতে টাকা নাই। তাই বাধ্য হয়ে ডাস্টবিনের পঁচা-বাসি খাবার পলিথিনে করে নিয়ে যাচ্ছি নিজে এবং পরিবারের খাওয়ার জন্য।’
যখন জিজ্ঞেস করলাম, আমরা গন্ধে টিকতে পারছি না, আর আপনি কেন এই পঁচা খাবারগুলো পলিথিনে করে নিচ্ছেন?— চোখের পানি মুছতে মুছতে তিনি শুধু বলছিলেন, ‘কোন কাজকাম নাই। টাকাও নাই খাবার কেনার জন্য। খাবারের দোকানে তো টাকা ছাড়া খাবার দেবে না। আর আমার কাছে টাকা নাই খাবার কেনার জন্য। ডাস্টবিনের খাবারগুলো তো দোকানেরই খাবার, এগুলো নিলে টাকা লাগবে না। ক্ষুধা লাগছে প্রচুর। তাই নিচ্ছি খাওয়ার জন্য।’
এ সময় পথচারীদের অনেকেই দাঁড়িয়ে পড়েন তার সাথে কথা বলতে দেখে। সেখানে দাঁড়ানো জামালখানের বাসিন্দা কাইছার আহমেদ বললেন, ‘দেশ তো উন্নত হয়েছে! কাজের অভাবে কেউ ডাস্টবিনের পঁচা বাসি খাবার খাচ্ছেন, এদিকে মন্ত্রীরা বলছেন দেশে গরিব নাই!’
সোমবার সকালে একই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি হলো কালীবাড়ির মোড়ে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন জেনারেল হাসপাতালের সামনে। আনুমানিক ৩০ বছরের যুবক রাস্তার পাশে পঁচা-বাসি খাবার তুলে খাচ্ছেন। দেখে মানসিক ভারসাম্যহীন মনে হলেও আসলে সম্পূর্ণ সুস্থ ছিলেন ওই যুবক।
কথা বলে জানা যায়, তিনি নোয়াখালীর বাসিন্দা, আবুল বশর তার নাম। রেলওয়ে বস্তিতে বাস করেন। সবাই দেখে পাগল মনে করে। তাই কেউ কাজ দেয় না। হাতে টাকাও নাই কিছু খাবে। হাসপাতালের সামনে রাস্তার পাশে পঁচা কমলালেবু পড়েছিল। ক্ষুধার জ্বালায় রাস্তার পাশে সেই পঁচা কমলালেবু খেতে বসে পড়লেন তিনি।
ব্যবসায়ী আলী আজগর ক্ষোভের স্বরে বলেন, ‘মানুষ মৌলিক ন্যুনতম চাহিদাটুকু পাচ্ছে না। এ কেমন সমাজ আমাদের।’
সিএনজিচালক আসাদ বলেন, ‘দেশ শুধু ফ্লাইওভার বা ব্রিজ দিয়েই উন্নত হয় না। মৌলিক চাহিদা নিশ্চিত করাই প্রথম কাজ। প্রথম উন্নতি। এই মানুষগুলো অনেক কিছু চান না। শুধু ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্য দুমুঠো খাবার চান।’
– চট্টগ্রাম প্রতিদিন এর সৌজন্যে