‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মীয় রাজনীতি নিষিদ্ধ’ নিয়ে ভিন্নমত জানিয়েছেন ডাকসু ভিপি নুরুল হক নুর৷ তিনি বলেছেন, ‘‘সিদ্ধান্ত হয়েছে ধর্মীয় উগ্রবাদী, সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী রাজনীতি নিষিদ্ধ৷’’
তিনি বলেন, ‘‘সাধারণ ধর্মভিত্তিক রাজনীতি যে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, সেটা নয়৷’’
তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) এজিএস এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন শুক্রবার ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ডাকসুর বৈঠকে সর্বসম্মতভাবে আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছি৷ ডাকসুর গঠনতন্ত্রেও এটা অন্তর্ভুক্ত হবে৷’’
কিন্তু ডাকসু ভিপি নুরুল হক নুর বলেন, ‘‘ধর্মভিত্তিক বা ধর্মীয় রাজনীতি নিষিদ্ধের প্রস্তাব ছিল ডাকসুর এজিএস সাদ্দাম হোসেন ও সাহিত্য সম্পাদক মাযহারুল কবির শায়ন ও সদস্য রাকিবুল ইসলামের৷ তবে আমি ও আমার প্যানেলের সমাজসেবা সম্পাদক ১৯৯০ সালে পরিবেশ পরিষদের যে সিদ্ধান্ত ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সকল ধরনের উগ্র মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিষিদ্ধ এবং সামরিক স্বৈরশাসক এরশাদের ছাত্রসংগঠন নিষিদ্ধ— সেই প্রস্তাব দেই৷ পরে আমাদের প্রস্তাব মডারেট করে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, ধর্মীয় উগ্রপন্থি ও সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী রাজনীতি নিষিদ্ধ৷ সাধারণ ধর্মভিত্তিক রাজনীতি যে নিষিদ্ধ হয়েছে সেটা নয়৷’’
তিনি বলেন, ‘‘আমরা তো সাধারণ ধর্মীয় রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে পারব না, কারণ, এটা আমাদের বর্তমান সংবিধান ও আইনের বিরোধী৷ নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন নিয়ে অনেকগুলো ধর্মীয় সংগঠন রাজনীতি করছে৷ ডাকসুতে আমাদের আলোচনার সময় ভিসি স্যারও বলেছেন, ধর্ম অনেক সেনসিটিভ৷ যাতে কারুর ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত না লাগে সেটা আমাদের মাথায় রাখতে হবে৷’’
নুর আরো বলেন, ‘‘বৃহস্পতিবার ডাকসুর বৈঠকের শেষ দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের ৩৪ জনের ভর্তি জালিয়াতি ও জিএস রাব্বানীর বিষয়ে প্রশ্ন তোলায় আমাকে অপমান করায় আমি ওয়াক আউট করি৷ পরে তারা ধর্মীয় রাজনীতি নিষিদ্ধের নতুন কোনো সিদ্ধান্ত নিয়েছে কিনা আমার জানা নেই৷ আমি থাকা অবস্থায় সিদ্ধান্ত হয়েছে ধর্মভিত্তিক কোনো উগ্র, মৌলবাদী, সাম্প্রদায়িক সংগঠন নিষিদ্ধ৷ এটা ডাকসুর গঠনতন্ত্রেও অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত হয়৷ সাধারণভাব ধর্মীয় রাজনীতি নিষিদ্ধের কোনো সিদ্ধান্ত তখন হয়নি৷’’
এজিএস সাদ্দাম হোসেন বলেন, ‘‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মীয় রাজনীতি বন্ধের এই সিদ্ধান্ত হঠাৎ করে আসেনি৷ ৯০-এ স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সময় থেকেই সব ছাত্র সংগঠন এ বিষয়ে একমত হয়ে কাজ করেছে৷ এবার ডাকসু নির্বাচনের আগে আমরা পরিবেশ পরিষদের কাছে দাবি বরেছি৷ এমনকি ছাত্রদলও একমত হয়েছে৷ তখন বলা হয়েছিল, নির্বাচিত ডাকসু সিদ্ধান্ত নেবে৷ আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা আন্দোলন ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা থেকে আমরা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি৷ আশা করি জাতীয় রাজনীতিতেও এর প্রতিফলন দেখা যাবে৷’’
তিনি বলেন, ‘‘আমরা মনে করি, ধর্ম যার যার ব্যক্তিগত৷ সবার ধর্মীয় স্বাধীনতা থাকবে৷ কিন্তু ধর্মকে কেন্দ্র করে বা ধর্মভিত্তিক কোনো রাজনীতি আমরা দেখতে চাই না৷’’
ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ নিয়ে ছাত্রদলের সভাপতি ফজলুর রহমান খোকন ডয়চে ভেলের কাছে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি৷ ছাত্রশিবিরের সভাপতি মোবারক হোসাইনকেও ফোনে পাওয়া যায়নি৷
তবে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বলেন, ‘‘বাংলাদেশের সংবিধানে সব নাগরিককে রাজনীতি করার অধিকার দেয়া হয়েছে৷ শুধুমাত্র সরকারি চাকরিজীবী, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী বা সেনাবাহিনী এ ধরনের বিশেষ ক্ষেত্রে রাজনীতি নিষিদ্ধ আছে৷ কোনো গোষ্ঠী বা বিশ্বের লোকজন রাজনীতি করতে পারবে না এটা হয় না৷’’
তিনি মনে করেন, ‘‘ধর্মীয় রাজনীতি নিষিদ্ধে ডাকসুর এই সিদ্ধান্ত ক্যাম্পাসে সংঘাত বাড়াতে পারে, কারণ, ধর্মীয় রাজনৈতিক সংগঠন ও ছাত্র সংগঠন সাংবিধনিকভাবেই আছে৷’’
আর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও নৌ পরিবহণ প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘‘ডাকসুর সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাই৷ আমরা ৯০-এ ক্যাম্পাসে যে সিদ্ধান্ত নিয়ে বাস্তবায়ন করেছি এখন তা ডাকসুর মাধ্যমে নেয়া হলো৷’’
দেশে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল তো আছে, তাহলে এটা কিভাবে সম্ভব- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘আমরা আওয়ামী লীগ ধর্মীয় উগ্রবাদী সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে লড়াই করছি, যারা ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার বানায় তাদের বিরুদ্ধে আমাদের অবস্থান স্পষ্ট৷’’
আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান বলেন, ‘‘দেশের আইনি কাঠামোতে হয়তো ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করা কঠিন, কিন্তু ডাকসু যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের দিক দিয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত৷’’
এদিকে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মভিত্তিক ছাত্র সংগঠনের তৎপরতা নিষিদ্ধের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে শুক্রবার বিকেলে প্রেসক্লাবের সামনে বিক্ষোভ মিছিল করেছে ইসলামী শাসনতন্ত্র ছাত্র আন্দোলন৷
মিছিলের আগে সমাবেশে ইসলামী শাসনতন্ত্র ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সভাপতি শেখ ফজলুল করীম মারুফ বলেন, মুক্ত চিন্তার সূতিকাগার বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মের মতো আদর্শভিত্তিক ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করা একটি স্বৈরাচারমূলক আচরণ৷ ভাবতে আশ্চর্য লাগে, স্বৈরাচার বিরোধী ও গৌরবময় অতীত সমৃদ্ধ একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সংগঠন ডাকসু নিজেই স্বৈরাচারী আচরণ করছে৷
সূত্র : ডয়চে ভেলে