ময়মনসিংহের কৃতিসন্তান শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এখন ভারতের শ্রেষ্ট সাহিত্যিক

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় যিনি বর্তমানে ভারতীয় শ্রেষ্ট বাঙালি সাহিত্যিক, যিনি শিশু ও প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য শতশত গল্প লিখেছেন। তিনি ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের ২রা নভেম্বর বর্তমান বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তবে সনদপত্রে  তার নাম  মধুসূদন মুখোপাধ্যায়।  তাঁদের আদিনিবাস ছিল ঢাকার বিক্রমপুরে। বাবার রেলওয়ের চাকরির সুবাদে শৈশব ও কৈশোরকালে তাঁকে একরকম যাযাবর জীবনযাপন করতে হয়েছে। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তাঁর পরিবার বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যায় কলকাতায়। এরপর বিহার, আসাম, কুচবিহার, পূর্ববাংলা, উত্তরবাংলা ঘুরে সবশেষে আবার কলকাতাতেই ফিরে আসেন। মিশনারি স্কুল ও বোর্ডিংয়ে কাটে তাঁর স্কুলজীবন। ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। বিএ করেন কলকাতা কলেজে। তারপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতকোত্তর শেষে স্কুলশিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। বর্তমানে তিনি আনন্দবাজার পত্রিকা ও দেশ পত্রিকার সঙ্গে জড়িত।

জানা-অজানা শীর্ষেন্দু:

* যৌবনে ভয়ানকভাবে বিষণ্নতায় আক্রান্ত হন শীর্ষেন্দু মুেখাপাধ্যায়, জীবনের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেন এবং একসময় আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেন। শেষ পর্যন্ত মা–বাবা তাঁকে শ্রীশ্রী অনুকূলচন্দ্র ঠাকুরের কাছে নিয়ে যান। ঠাকুরের সান্নিধ্যে জীবন বদলে যায় তাঁর।

* তাঁর জীবনের প্রথম দুটি গল্প ফেরত এসেছিল দেশ পত্রিকার দপ্তর থেকে। তৃতীয়টি পাঠানোর পর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, যদি এটি ছাপা না হয়, তাহলে লেখালেখিই ছেড়ে দেবেন। ‘জলতরঙ্গ’ নামে সেই তৃতীয় গল্পটিই ছিল শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ছাপা হওয়া প্রথম লেখা।

* প্রথম উপন্যাস ঘুণপোকা লিখেছিলেন সাগরময় ঘোষের তাগাদায়। ঘুণপোকার শ্যামল চরিত্রটি অনেকটা তাঁর নিজের আদলেই গড়া।

* শিশু-কিশোর জন্য কিছু লেখার ইচ্ছা ছিল না শীর্ষেন্দুর। কিন্তু আনন্দমেলার তৎকালীন সম্পাদক ও কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর অনুরোধে লেখেন প্রথম কিশোর গল্প। এমনকি নীরেন্দ্রনাথ অনেকটা জোর করেই তাঁকে দিয়ে লিখিয়ে নেন প্রথম কিশোর উপন্যাস মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি। এই উপন্যাসে ঠাকুরমার চরিত্রটি সরোজিনী দেবী নামে তাঁর এক বিধবা ঠাকুরমার আদলে গড়া।

* তাঁর তিন বিখ্যাত কিশোর উপন্যাস গোঁসাইবাগানের ভূত, ছায়াময় ও মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি নিয়ে বানানো হয়েছে তিনটি সিনেমা এবং তিনটিই বক্স অফিস মাৎ করেছে।

* শীর্ষেন্দুর প্রিয় উপন্যাস সতীনাথ ভাদুড়ির লেখা ঢোঁড়াই চরিত মানস। এ ছাড়া কমলকুমার মজুমদারের উপন্যাসও তাঁর প্রিয়। শরৎচন্দ্রের দেবদাসকে তিনি ‘অপরিণত হাতের সৃষ্টি’ বলে মনে করেন। কিন্তু এক শ বছর ধরে দেবদাস-এর সমান জনপ্রিয়তাও তাঁকে বিস্মিত করে।

* তাঁর সৃষ্ট বিখ্যাত গোয়েন্দা চরিত্র শবর দাশগুপ্ত। ‘শবর সিরিজ’–এর প্রথম বই ঋণ। শবর চরিত্র নিয়ে পরিচালক অরিন্দম শীল বানিয়েছেন এবার শবর, ঈগলের চোখ ও আসছে আবার শবর নামে একে একে তিনটি সিনেমা।

* বাংলাদেশি নাটকের ভক্ত শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। তাঁর মতে, এ দেশের নাটকের গল্পগুলো খুব চমৎকার ও মিষ্টি। তিনি বলেন, ভারতে বাংলাদেশের চ্যানেল দেখা যায় না বটে, কিন্তু কোনো না কোনোভাবে নাটকগুলো তাঁরা দেখেন।

* সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আর শক্তি চট্টোপাধ্যায় ছিলেন তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তবে তুই-তোকারির সম্পর্ক ছিল শুধু সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের সঙ্গে। মুস্তাফা সিরাজের অতিমাত্রায় ‘কর্নেল সিরিজ’-এ ঝুঁকে পড়াকে মানতে পারেননি শীর্ষেন্দু। এ জন্য সিরাজকে ভর্ৎসনাও করতেন। কারণ তিনি মনে করতেন,‘কর্নেল সিরিজ’ লেখা কমিয়ে দিলে সিরাজের কাছ থেকে অলীক মানুষ-এর মতো আরও ভালো ভালো লেখা পাওয়া যাবে।

গ্রন্থতালিকা

তার প্রথম গল্প জলতরঙ্গ শিরোনামে ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। সাত বছর পরে ঐ একই পত্রিকার পূজাবার্ষিকীতে ঘুণ পোকা নামক তার প্রথম উপন্যাস প্রকাশিত হয়। ছোটদের জন্য লেখা তার প্রথম উপন্যাস মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি। শবর দাশগুপ্ত তার সৃষ্ট অন্যতম জনপ্রিয় চরিত্র।

উপন্যাস

যাও পাখি, উজান, কাগজের বউ, কীট, ক্ষয়, চোখ, জাল, দিন যায়, দূরবীন, পারাপার, ফুলচোর, বিকেলের মৃত্যু, মানবজমিন, ঘুণ পোকা, আশ্চর্য ভ্রমণ, রঙীন সাঁকো, পাপ, তিন হাজার দুই, নয়নশ্যামা, হৃদয়বৃত্তান্ত, নানা রঙের আলো, গয়নার বাক্স, অসুখের পরে, গতি, প্রজাপতির মৃত্যু ও পুর্নজন্ম, দ্বিতীয় সত্তার সন্ধানে, আদম ইভ ও অন্ধকার, নিচের লোক উপরের লোক, টানাপোড়েন
ক্রীড়াভূমি, সম্পত্তি, তিথি, পার্থিব, চক্র, আলোয় ছায়ায়, আলোর গল্প ছায়ার গল্প, ঋণ, কাপুরুষ, কালো বেড়াল সাদা বেড়াল, গুহামানব, দ্বিচারিনী, নীলু হাজরার হত্যা রহস্য, পিদিমের আলো, ফজল আলি আসছে, মাধব ও তার পারিপার্শ্বিক, লাল নীল মানুষ, শ্যাওলা, শিউলির গন্ধ, সাঁতারু ও জলকন্যা, সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে, ছায়াময়, দৃশ্যাবলী, বোধন ও বিসর্জন, এই সব পাপটাপ
হাটবার, চেনা অচেনা, যুগলবন্দী, সেই আমি, বাসস্টপে কেউ নেই, কাছের মানুষ, হরিপুরের হরেককান্ড, বাঙালের আমেরিকা দর্শন, একাদশীর ভূত, ওয়ারিশ, চারদিক, গোলমাল, আক্রান্ত, ফেরীঘাট, মাধুর জন্য, জোড়বিজোড়, বড়সাহেব, নেকলেস, নরনারী কথা , খুদকুঁড়ো

অদ্ভুতুড়ে সিরিজ

মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি – ১৯৭৮
গোঁসাইবাগানের ভূত – ১৯৭৯
হেতমগড়ের গুপ্তধন – ১৯৮১
নৃসিংহ রহস্য – ১৯৮৪
বক্সার রতন – ১৯৮৪
ভুতুড়ে ঘড়ি – ১৯৮৪
গৌরের কবচ – ১৯৮৬
হিরের আংটি – ১৯৮৬
পাগলা সাহেবের কবর – ১৯৮৭
হারানো কাকাতুয়া – ১৯৮৭
ঝিলের ধারে বাড়ি – ১৯৮৮
পটাশগড়ের জঙ্গলে – ১৯৮৯
গোলমাল – ১৯৮৯
বনি – ১৯৯০
চক্রপুরের চক্করে – ১৯৯০
ছায়াময় – ১৯৯২
সোনার মেডেল – ১৯৯৩
নবিগঞ্জের দৈত্য – ১৯৯৪
কুঞ্জপুকুরের কান্ড – ১৯৯৫
অদ্ভুতুড়ে – ১৯৯৬
পাতালঘর – ১৯৯৬
হরিপুরের হরেক কান্ড – ১৯৯৭
দুধসায়রের দ্বীপ – ১৯৯৭
বিপিনবাবুর বিপদ – ১৯৯৮
নবাবগঞ্জের আগন্তুক – ১৯৯৯
ষোলো নম্বর ফটিক ঘোষ – ২০০০
গজাননের কৌটো – ২০০১
ঝিকরগাছায় ঝঞ্ঝাট – ২০০২
রাঘববাবুর বাড়ি – ২০০৩
মোহন রায়ের বাঁশি – ২০০৪
সাধুবাবার লাঠি – ২০০৫
ঘোরপ্যাঁচে প্রাণগোবিন্দ – ২০০৫
ডাকাতের ভাইপো – ২০০৭
অঘোরগঞ্জের ঘোরালো ব্যাপার – ২০০৮
উঁহু – ২০০৯
গোলমেলে লোক – ২০১০
বটুকবুড়োর চশমা – ২০১১
ময়নাগড়ের বৃত্তান্ত – ২০১১
অষ্টপুরের বৃত্তান্ত – ২০১২
মদন তপাদারের বাক্স – ২০১২
সর্বনেশে ভুল অঙ্ক – ২০১৪
ভলু যখন রাজা হল – ২০১৫
হাবু ভুঁইমালির পুতুল – ২০১৬
নন্দীবাড়ির শাঁখ – ২০১৭
জং বাহাদুর সিংহের নাতি – ২০১৭
আসমানির চর – ২০১৮
গড় হেকিমপুরের রাজবাড়ি – ২০১৯

গল্প

একটুখানি বেঁচে থাকা
গঞ্জের মানুষ
উকিলের চিঠি
ঘণ্টাধ্বনি
হারানো জিনিস
লড়াই
মশা
একটা দুটো বেড়াল
বাঘ
খানাতল্লাস
ক্রিকেট
ভেলা
চিড়িয়াখানা
শুক্লপক্ষ
হাওয়া-বন্দুক
খবরের কাগজ
তৃতীয় পক্ষ
ইচ্ছে
পুনশ্চ
কথা
পুরোনো চিঠি
হরীতকী
বনমালীর বিষয়
সূত্রসন্ধান
আশ্চর্য প্রদীপ
ঘরের পথ
প্রিয়া মধুবন
আমি সুমন
দৈত্যের বাগানে শিশু
ট্যাংকি সাফ
লুলু
ওষুধ
বন্দুকবাজ
জমা খরচ
অনুভব
সুখের দিন
গর্ভনগরের কথা
খগেনবাবু
সাঁঝের বেলা
সংবাদ
অপেক্ষা
হাওয়া বদলের চিঠি
ভাগের অংশ
দেখা হবে
সম্পূর্ণতা
খেলা
বৃষ্টিতে নিশিকান্ত
চিঠি
জ্যোৎস্নায়
মাসী
হলুদ আলোটি
প্রতীক্ষার ঘর
উত্তরের ব্যালকনি
সাপ
স্বপ্নের ভিতরে মৃত্যু
আত্মপ্রতিকৃতি
মৃণালকান্তির আত্মচরিত
ভুল
চারুলালের আত্মহত্যা
আমাকে দেখুন
কার্যকারণ
তোমার উদ্দেশে
অবেলায়
সেই আমি, সেই আমি
খেলার ছল
পটুয়া নিবারণ
সাদা ঘুড়ি
উড়োজাহাজ
কীট
বয়স
রাজার গল্প
সোনার ঘোড়া
মুনিয়ার চারদিক
ডুবুরী
নীলুর দুঃখ
সাধুর ঘর
সুখ দুঃখ
আমরা
শেষবেলায়
পুরনো দেওয়াল
চিহ্ন
বন্ধুর অসুখ
কয়েকজন ক্লান্ত ভাঁড়
ছবি
দূরত্ব
ঝড়
সাইকেল
সম্পর্ক
মনে থাকা
পয়মন্ত
দুর্ঘটনা
দৌড়
বিয়ের রাত
মুহূর্ত
লক্ষ্মীপ্যাঁচা
ঘরজামাই
নবদূর্গা
হ্যাঁ
জন্ম
সংসার
বানভাসি
হাতুড়ি
সংলাপ
কৈখালির হাটে
ক্রীড়াভূমি
রাজার বাগানে
নসিরাম
বুদ্ধিরাম

চলচ্চিত্র

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের বহু উপন্যাস চলচ্চিত্রায়িত হয়েছে। তার সৃষ্ট শবর চরিত্রটি নিয়ে তৈরী হয়েছে তিনটি রহস্য চলচ্চিত্র। এছাড়াও অদ্ভুতুড়ে সিরিজ অবলম্বনে বিভিন্ন সিনেমা তৈরী হয়েছে। তার কাহিনী অনুসারে বানানো চলচ্চিত্রগুলি হলঃ

আজব গাঁয়ের আজব কথা
বাশিওয়ালা
পাতালঘর
গোঁসাইবাগানের ভূত
দোসর
কাগজের বৌ
গয়নার বাক্স (চলচ্চিত্র)
ছায়াময়
সাধুবাবার লাঠি
মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি
ঈগলের চোখ
আসছে আবার শবর
হীরের আংটি
আশ্চর্য প্রদীপ (চলচ্চিত্র)
এবার শবর

পুরস্কার

বিদ্যাসাগর পুরস্কার (১৯৮৫) – শিশুসাহিত্যে অবদানের জন্য।
আনন্দ পুরস্কার (১৯৭৩ ও ১৯৯০)
সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার (১৯৮৮)- মানবজমিন উপন্যাসের জন্য।
বঙ্গবিভূষণ (২০১২)

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top