ফসলের জাকাত বা উশর আদায় মুসলমানদের জন্য কেবল শরিয়াহর বিধানের দিক দিয়েই অপরিহার্য বা ফরজ নয়, বাংলাদেশের মতো কৃষিপ্রধান দেশে উশর আদায় করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। এ দেশের বিশাল জনগোষ্ঠী গ্রামে অত্যন্ত দরিদ্র অবস্থায় বাস করে। এ দেশের দারিদ্র্য দূর করা, দরিদ্রদের পুনর্বাসন এবং তাদের স্বাবলম্বী করা উশর আদায় করার ওপর অনেকাংশে নির্ভর করে। কিন্তু অত্যন্ত বেদনার কথা হলো, বাংলাদেশের জনগণ উশর সম্পর্কে তেমন অবগত নন। তাই তারা উশর আদায় করেন না। এভাবে শরিয়াহর একটি গুরুত্বপূর্ণ হুকুম বাংলাদেশে পালিত হচ্ছে না এবং তার ফায়দা থেকে দেশের জনগণ বঞ্চিত হচ্ছে।
উশর ফরজ হওয়ার দলিল : কুরআন ও হাদিস থেকে জানা যায়- আল্লাহ পাক ইরশাদ করেছেন, তিনি আল্লাহ যিনি নানা প্রকারের গুল্মলতা ও গাছগাছালিসংবলিত খেজুর বাগান সৃষ্টি করেছেন, ক্ষেতখামার বানিয়েছেন; যা থেকে নানা প্রকারের খাদ্য উৎপাদন করা হয়, জয়তুন ও আনারের গাছ তৈরি করেছেন, যার ফলে দেখতে সাদৃশ্যসম্পন্ন ও স্বাদে বিভিন্ন হয়ে থাকে, তোমরা সবাই খাও এর উৎপাদন- যখন তা ধরবে এবং আল্লাহর হক আদায় করো, যখন তার ফসল কেটে তুলবে (সূরা আনয়াম : আয়াত ১৪১)।
ইমাম আবু হানিফা, আবু ইউসুফ, মুহাম্মাদ আল শায়বানী, ইমাম মালিক, সাঈদ ইবনুল মুসাইয়েব, তাউস, কাতাদাহ ও দাহহাকসহ বেশির ভাগ মনীষীর মতে, এ আয়াতে আল্লাহর হক বলতে ফসলের জাকাত উশরকে বুঝানো হয়েছে।
কী কী ফসলের উশর হয় : সূরাতুল বাকারা এবং সূরাতুল আনয়ামের উপরিউল্লিখিত আয়াত এবং রাসূলুল্লাহ সা: থেকে বর্ণিত সহি হাদিসের সাধারণ তাৎপর্যের আলোকে, জমির সব ধরনের উৎপাদনের ওপর উশর ফরজ। এসব আয়াতে ও হাদিসে বিভিন্ন ধরনের ফসলের মধ্যে পার্থক্য করা হয়নি। এ জন্য ইমাম আবু হানিফা, দাউদ জাহেরি, ইবরাহীম নখয়ী, ওমর ইবনে আবদুল আজিজ, মুজাহিদ ও হাম্মাদ ইবনে আবু সালমান মত প্রকাশ করেছেন, জমির সব ধরনের উৎপাদনের ক্ষেত্রেই উশর আদায় করতে হবে।
নিসাবের পরিমাণ কী? নিম্নে উল্লিখিত হাদিসের ভিত্তিতে ইমাম মালিক, শাফেয়ি, আহমদ ইবনে হাম্বল, আবু ইউসুফ, মুহাম্মদসহ বেশির ভাগ আলেম মত প্রকাশ করেছেন, পাঁচ ওয়াসাকের পরিমাণে কোনো জাকাত হবে না। ‘পাঁচ ওয়াসাক’ বলতে কী পরিমাণ বুঝাবে এ ক্ষেত্রে কিছুটা মতভেদ আছে। ৬০ ছা-এ এক ওয়াসাক হয়ে থাকে। মতভেদের কারণ হচ্ছে ছা-এর পরিমাণ। এ প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনার পর ড. ইউসুফ আল কারজাভি মত দিয়েছেন, পাঁচ ওয়াসাক সমান ৬৫৩ কিলোগ্রাম অর্থাৎ ১৮ মণের মতো।
উশর ও খারাজ : জমহুর ফিকাহবিদেরা মুসলমানের মালিকানাধীন সব জমির ওপর উশর ফরজ বলেছেন। কেননা কুরআন ও সুন্নাহের স্পষ্ট আয়াত ও দলিলের ভিত্তিতে কোনো মুসলমানই উশর আদায় থেকে অব্যাহতি পেতে পারেন না। তারা আরো মনে করেছেন, সরকার কর্তৃক যদি কোনো ভূমিকর বা খারাজ ধার্য করা হয় তা দিলেও উশর দিতে প্রত্যেক মুসলমান বাধ্য। খারাজ ও উশর দুই ভিন্ন প্রকৃতির হক। খারাজ হওয়ার কারণ হচ্ছে জমি ব্যবহার করার অধিকার। অন্য দিকে উশর আদায়ের কারণ হচ্ছে, জমির ফসল লাভ।
এ যুগের একজন বড় হানাফি আলেম ও তাফসিরকারক মুফতি মুহাম্মদ শফী এ সম্পর্কে বলেছেন, (সরকার) জমির যে সরকারি খাজনা আদায় করে, তা উশর বা খারাজের শরয়ী নীতির অধীনে আদায় করে না এবং উশর ও খারাজ নামেও আদায় করে না। আবার তার খরচ করার কোনো ঘোষণা সরকারের পক্ষ থেকে দেয়া হয়নি। এ জন্য মুসলিম রাষ্ট্রের আরোপিত ইনকাম ট্যাক্স বা সরকারি খাজনা দিলে জাকাত ও উশরের ফরজ দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পাওয়া যায় না। তখনো এ দায়িত্ব বহাল থাকে এবং সম্পদের মালিকদের নিজ নিজ জাকাত ও উশর বের করে তা তার খাতে ব্যয় করা অবশ্য কর্তব্য। কাজেই বাংলাদেশের মুসলমানদের জমিকে ‘উশরি’ গণ্য করতে হবে এবং উশর দিতে হবে।
উশরের পরিমাণ : একটি স্বাভাবিক বছরে বাংলাদেশে অন্তত চার কোটি টন খাদ্যশস্য (চাল, গম ইত্যাদি) উৎপন্ন হয়। বাংলাদেশের জনগণের একটি বড় অংশ ভূমিহীন কৃষক। তাদের হাতে জমি নেই। জমির অর্ধেক পরিমাণ রয়েছে সচ্ছল বা বড় কৃষকদের হাতে। কাজেই বাংলাদেশের উৎপাদিত খাদ্যশস্যের অন্তত অর্ধেক অর্থাৎ দুই কোটি টন উৎপাদন করে থাকেন সচ্ছল কৃষকেরা এবং তাদের প্রত্যেকের উৎপাদনের পরিমাণ নিসাবের অতিরিক্ত হয়ে থাকে, যা জাকাতযোগ্য। যদি এই দুই কোটি টনের ওপর অর্ধ-উশর (৫%) আদায় করা হয়, তবে উশরের পরিমাণ হবে ১০ লাখ টন, যার মূল্য কমপক্ষে পাঁচ হাজার কোটি টাকা ( প্রতি কেজি চালের দাম ৫০ টাকা হিসাবে)।
অন্য দিকে পাট, চা, রবিশস্য, তামাক ও অন্যান্য ফসল (যার জাকাতযোগ্য পরিমাণ হবে অন্তত ২০ হাজার কোটি টাকা) এর অর্ধ-উশর (৫%) আদায় করা হলে এক হাজার কোটি টাকার উশর আদায় হতে পারে। সুতরাং স্বাভাবিকভাবে ধান, চাল, পাট, গম, তামাক- সব মিলিয়ে উশর প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকা (৫ হাজার কোটি + ১ হাজার কোটি টাকা)। এ হিসাবের জন্য আমরা ধরে নিয়েছি, সব জমিতেই সেচ দেয়া হচ্ছে এবং তাই উশর (১০%) আদায় না করে অর্ধ-উশর আদায় করা হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে অনেক জমির ফসল থেকে উশর (১০%) আদায়যোগ্য হবে এবং সে ক্ষেত্রে মোট উশরের পরিমাণ আরো অনেক বৃদ্ধি পাবে।
উশর-সংক্রান্ত অন্যান্য বিষয় : উশর আদায়ে আগে জমির ফসল উৎপাদনের খরচ বাদ যাবে কি? এ পর্যায়ে আমরা জানি, সেচের খরচকে আল্লাহর রাসূল সা: বিশেষভাবে বিবেচনা করেছেন এবং যে জমিতে সেচ দিতে হয় তার ফসলের উশর ১০% না করে, ৫% নির্ধারণ করেছেন। অন্যান্য খরচ বাদ দেয়ার ব্যাপারে কোনো সহি সুন্নাহ আমাদের কাছে নেই। ইবনে হাজাম, ইমাম মালিক, ইমাম শাফেয়ি ও আবু হানিফা মত প্রকাশ করেছেন,আল্লাহ যে হক ধার্য করেছেন তা কুরআন বা প্রমাণিত সুন্নাহ ছাড়া প্রত্যাহার করা জায়েজ নয়। পাকিস্তানে জাকাত ও উশর আইন প্রণয়নের সময় আলেমদের বেশির ভাগের পরামর্শে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, ফসল উৎপাদনকারী খরচ বাবদ সর্বোচ্চ এক-চতুর্থাংশ বাদ দিতে পারবেন। অবশিষ্টের ওপর উশর (১০%) দিতে হবে। অবশ্য, সেচের ক্ষেত্রে অর্ধ-উশর (৫%) দিতে হবে।
যদি কোনো জমি বর্গা দেয়া হয়, তাহলে কী করতে হবে? সে ক্ষেত্রে জমির মালিক ও বর্গাদারকে তার নিজ নিজ অংশের উশর বা অর্ধ-উশর দিতে হবে। উশর পণ্যেও আদায় করা যায় এবং নগদেও আদায় করা যায়।
উশর আদায় করার যথাযোগ্য ব্যবস্থা করা আমাদের সমাজকে দারিদ্র্যমুক্ত করার জন্য অপরিহার্য। এ ব্যাপারে আলেম, ইসলামী চিন্তাবিদ, সমাজবিদসহ সবার উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। এ জন্য উশর-সংক্রান্ত বিস্তারিত আহকাম জনগণকে জানানো জরুরি। কেননা, জনগণ এ সম্পর্কে অবহিত নয়।
লেখক : সাবেক সচিব, বাংলাদেশ সরকার