জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম গতকাল অভিযোগ করে বলেছেন, এক হাজার ৪৪৫ কোটি টাকার ক্যাম্পাস উন্নয়ন প্রকল্পের ‘৪ থেকে ৬ শতাংশ’ চাঁদা দাবি করেছিলেন ছাত্রলীগ সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন এবং সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী।
প্রথমদিকে বেশ কয়েকটি গণমাধ্যমের কাছে বিষয়টি অস্বীকার করে আসলেও, রাব্বানী গতকাল দ্য ডেইলি স্টারের কাছে স্বীকার করেছেন যে, উপাচার্যের কাছে তারা তাদের ‘ন্যায্য পাওনা’ দাবি করেছিলেন। তবে টাকার পরিমাণটি কতো ছিলো তা জানাতে রাজি হননি। ‘ঈদের খরচ’ হিসেবে ওই টাকা দাবি করেছিলেন বলেও জানান তিনি।
জাবির উন্নয়ন প্রকল্পে বাধা হয়ে না দাঁড়ানোর জন্য বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগকে ১ কোটি ৬০ লাখ টাকা প্রদানের জন্য রাব্বানী উল্টো উপাচার্য ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছেন।
তবে উপাচার্য এবং জাবি ছাত্রলীগ সভাপতি জুয়েল রানা অভিযোগটি প্রত্যাখ্যান করেছেন।
জুয়েল বলেছেন, “গণমাধ্যমে মিথ্যা তথ্য দিয়েছেন রাব্বানী। আমাদের না জানিয়েই গত ৮ আগস্ট তিনি উপাচার্যের সঙ্গে সাক্ষাত করেছিলেন।”
জাবির মেগা প্রকল্প নিয়ে শুরু থেকেই দুর্নীতি ও অনিয়মের নানা অভিযোগ ওঠার মধ্যেই এই ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের জন্ম নেয়।
গতকাল দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে আলাপকালে উপাচার্য জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্বাচিত শীর্ষ দুজন ছাত্রলীগ নেতা গত ৮ আগস্ট তার বাসভবনে এসে চাঁদা দাবি করেছিলেন।
নিজ বাসভবনে বসে তিনি বলেন, “নির্মাণ কাজের দায়িত্বপ্রাপ্ত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে টাকা তুলে দিতে তারা আমাকে চাপ দেয়। প্রত্যাখ্যান করলে তারা আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহারও করে।”
গত ৮ আগস্ট রাব্বানীর বক্তব্যের উদ্ধৃতি দিয়ে উপাচার্য বলেন, “এক পর্যায়ে রাব্বানী বলে যে, এখনকার দিনে ১-২ শতাংশের আলাপ কোথাও নেই। ৪-৬ শতাংশ ছাড়া কি হয়?…এটি একটি বড় প্রকল্প। আপনি আমাদের সহায়তা করলে, আমরাও আপনাকে সহযোগিতা করবো।”
পুরো প্রকল্প তহবিলের ছয় শতাংশ মানে হলো ৮৬ কোটি টাকার সমপরিমাণ।
ফারজানা ইসলাম বলেন, “আমি তাদেরকে বললাম যে, আমি তবে ভবন বানাবো কী দিয়ে, এসব কথা আমার সামনে আর বলবা না..আমি যখন তাদের চাপে নতি স্বীকার করতে অপারগতা প্রকাশ করলাম, তখন তারা আমার দিকে চেঁচিয়ে ওঠলো এবং চলে গেলো।”
তিনি আরও জানান, এতেও ক্ষান্ত হয়নি ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক। গত ২৬ মে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) চিকিৎসাধীন থাকার সময়েও তার (উপাচার্য) সঙ্গে দেখা করে নিজের পছন্দ মতো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দিতে চাপ দেন রাব্বানী।
এসময় শোভনসহ অন্য ছাত্রলীগ নেতারও রাব্বানীর সঙ্গে ছিলেন। এছাড়াও হাসপাতালের নীচে কয়েক ডজন ছাত্রলীগ কর্মী অপেক্ষা করছিলো বলেও জানান তিনি।
গতবছর দ্বিতীয়বারের মতো উপাচার্য নিযুক্ত হওয়া অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম জানান, গত মঙ্গলবার তিনি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে চলমান আন্দোলন, ক্যাম্পাসে অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্প এবং কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের দাবি-দাওয়া নিয়ে আলোচনা করেছেন।
তিনি বলেন, “আমরা ৩০ মিনিটের মতো কথা বলেছি। বৈঠকে ছাত্রলীগ সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন এবং সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীকে নিয়ে কথা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন- তারা (শোভন-রাব্বানী) তোমাকেও ঝামেলায় ফেলেছে!”
এ বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী তাকে কোনো দুশ্চিন্তা না করতে বলেছেন বলেও জানান উপাচার্য।
“প্রধানমন্ত্রী আরও বলেছেন- জাবি যদি উন্নয়ন প্রকল্প না চায়, তাহলে আমরা সেখানো কোনো অর্থ ছাড় দেবো না। তবে এ নিয়ে সেখানে কোনো আন্দোলন চলতে পারবে না”, যোগ করেন উপাচার্য।
উপাচার্যের বরাত দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তার কথোপকথন নিয়ে বাংলা দৈনিক যুগান্তরও এরূপ একটি সংবাদ প্রকাশ করেছে।
আপনি প্রধানমন্ত্রীকে আগে বিষয়টি জানাননি কেনো? এমন প্রশ্নে উপাচার্য বলেন, “আমি আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা ও সচিবদের জানিয়েছি। প্রধানমন্ত্রী নিজের চিকিৎসা ও রাষ্ট্রীয় কাজে ব্যস্ত থাকায় শুরুতেই তাকে বিষয়টি জানানো সম্ভব হয়নি।”
ছাত্রলীগ সূত্রে জানা গেছে, এ বিষয়টি বিভিন্ন গণমাধ্যমের শিরোনামে ওঠে আসায় গত রবিবার রাতে উপাচার্যের বাসভবনে নিজের চারজন সমর্থককে ক্ষমা চাইতে পাঠান রাব্বানী। তবে উপাচার্য তাদের সঙ্গে দেখা করেননি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্প থেকে উপাচার্য ছাত্রলীগকে বিশাল অঙ্কের টাকা চাঁদা দিয়েছেন, এ খবর ছড়িয়ে পড়লে গত ২৩ আগস্ট থেকে ক্যাম্পাসে আন্দোলন শুরু করেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।
এর আগে, জাবি ছাত্রলীগের অন্তত ১০ নেতা-কর্মী দ্য ডেইলি স্টারকে জানিয়েছিলেন যে, গত ৯ আগস্ট উপাচার্যের সঙ্গে বৈঠক হওয়ার পর ছাত্রলীগের বিরোধপূর্ণ তিনটি অংশকে দেওয়া টাকার ভাগ তারাও পেয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী বরাবর পাঠানো এক চিঠিতে ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগকে অতিরঞ্জিত বলে দাবি করেছেন রাব্বানী।
চিঠিতে রাব্বানী লিখেছেন, “জাবি উপাচার্যের স্বামী এবং ছেলে একটি বড় অঙ্কের কমিশন পাওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ শাখাকে ব্যবহার করেছে এবং ঈদুল আজহার আগে জাবি ছাত্রলীগকে ১ কোটি ৬০ লাখ টাকা দিয়েছে।”
তবে চিঠিটি প্রধানমন্ত্রী পেয়েছেন কী না তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
খবরটি প্রকাশ হয়ে যাওয়ার পর উপাচার্য তাদের কার্যালয়ে দেখা করতে বলেছিলেন বলেও জানান রাব্বানী। যদিও উপাচার্য তা অস্বীকার করেছেন।
রাব্বানীর স্বাক্ষরকৃত হাতে লেখা ওই চিঠিতে তিনি লিখেছেন, “আমরা উপাচার্যের সঙ্গে সাক্ষাত করেছিলাম এবং তাকে জিজ্ঞেস করেছি যে- ছাত্রলীগের সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদককে না জানিয়ে তিনি কেনো জাবি ছাত্রলীগকে টাকা দিয়েছেন। তখন তিনি বিব্রত বোধ করেন। সেসময় আমরা তাকে যা বলেছিলাম তা আমাদের ঠিক হয়নি। এজন্য আমরা ক্ষমাপ্রার্থী।”
রাব্বানীর এই অভিযোগ মিথ্যা বলে জানিয়েছেন উপাচার্য।
গতরাতে দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে আলাপকালে রাব্বানী জানান যে, ১ কোটি ৬০ লাখ টাকা চাঁদা দেওয়ার ঘটনাটি তিনি জাবি ছাত্রলীগের কাছ থেকে জেনেছেন।
তিনি বলেন, “জাবি ছাত্রলীগের সদস্যরা এসে আমাকে পুরো ব্যাপারটি জানিয়েছে। জাবিতে এমন কেউ নেই যারা বিষয়টি জানে না। ক্যাম্পাসের প্রত্যেকেই পুরো ঘটনাটি জানে।”
রাব্বানী বলেন, “পরবর্তীতে আমি এবং শোভন উপাচার্যের সঙ্গে দেখা করি এবং বলি- ম্যাম, আপনি তাদের টাকা দিয়েছেন। তাহলে আমাদের ন্যায্য পাওনা কই? আমাদের ঈদ বোনাস কই?”
হতাশার সুরে ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক আরও বলেন, “জাবি প্রশাসন আমাদের কোনো টাকা না দিলেও, আমাদের নেতৃত্বের নীচে যারা রয়েছে তাদেরকে টাকা দিয়েছে। এ বিষয়ে উপাচার্য কী বলবেন? তারা আমাদের কিছুই দেয়নি। তারা জাবি ছাত্রলীগকে টাকা দিয়েছে। এতে কী কোনো ধারণা পাওয়া যায়?”
সূত্রঃ দ্য ডেইলি স্টার