(প্রতিনিধিদলের পক্ষে – ডা রাফা বিনতে নূর) : ভ্রমণকাহিনী শুনলেই দৃশ্যপটে ভেসে ওঠে আনন্দময় কিছু মূহুর্ত। ভ্রমণকে বেছে নেয় সবাই একটুখানি অবসর কাটাতে, ব্যস্ত জীবনের অবসাদমুক্তির পথ হিসেবে। কিন্তু সব ভ্রমণকাহিনী কি এক হয়?? আমাদের ভ্রমণটা কিন্তু একটু ভিন্নরকম।
দিনকাল তো চলছিল গতানুগতিক ধারায়। আশা দুরাশা নিরাশা সবকিছু তালগোল পাকিয়ে জবুথবু হয়েই যেন বসেছিলাম সবাই। এখানে ওখানে বহুখানে যাই, অনেককিছু বুঝতে পারি আবার পারিনা। সেই ৩০ এপ্রিল রেজাল্ট থেকে শুরু হয়েছে। হঠাৎ একদিন একটি চিঠি হাতে (ভার্চুয়ালি) এসে পড়ল। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একটা কড়া চিঠি। সারসংক্ষেপ- আগের চিঠির উত্তর পাওয়া যায়নি। ১৫/০৯/১৯ এর মধ্যে যদি এই চিঠির রিপ্লাই ও সংশ্লিষ্ট মহলগুলো দিতে অপারগ হয় তাহলে ধরে নেওয়া হবে তার প্রতিষ্ঠানে নতুন সংখ্যক চিকিৎসকের প্রয়োজন নেই!
কী ভয়াবহ! এরকম চিঠির উত্তর আবার দিবে না এ কি করে হয়!
প্রায়ই তো দেখি পত্রিকায়/ টিভিতে সংবাদ হয়.. অমুক উপজেলায় চিকিৎসক সংকট। তমুক উপজেলায় চিকিৎসকের অভাবে রোগীদের হয়রানি। পার্সোনাল পরিচয়ের জের ধরে জানতে পারি উপজেলায় বড্ড বেশি চিকিৎসক সংকট। এদিকে আবার এ চিঠি। প্রয়োজন অনুযায়ী নতুন পদ সৃজন করার উদ্দেশ্যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এ চিঠি। এদিকে আমরা ৮৩৬০ জন উত্তীর্ণ হয়ে বসে আছি কিন্তু পদ নাকি ফাঁকা নাই বিধায় আমাদেরকে চাকরি দেওয়া যাচ্ছে না।
মনে হল একবার নিজেরাই ভ্রমণে বেরিয়ে যাই !
তরুণ এক চিকিৎসক গোষ্ঠী সম্পূর্ণ নিজ উদ্দ্যোগে বেরিয়ে পরলাম ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেলাম জেলায় জেলায়।
গন্তব্য- সিভিল সার্জন অফিস
উদ্দেশ্য- নিজের চোখে দেখব, নিজের কানে শুনব। স্বাস্থ্যব্যবস্থার একটি খণ্ডচিত্র বুঝে আসব।
সাথে নিলাম- ঐ চিঠির এক কপি, আমাদের পক্ষ থেকে স্বাস্থ্য মন্ত্রী বরাবর একটি চিঠি এবং আরো কিছু কাগজপত্র। একে একে শুরু হল আমাদের যাত্রা।
অনেক জল্পনা কল্পনা নিয়ে গেলাম। ভাবলাম সবাইকে বুঝি গিয়ে পাব চিঠির ব্যাপারে তৎপর। জোরসে কাজ চলছে। কিন্তু বাস্তব চিত্র অনেকটাই ভিন্ন!
ভাবছি কোন বিভাগের ভ্রমণগল্প আগে বলা যায়! সর্বশেষ বিভাগ ময়মনসিংহ দিয়েই শুরু করা যাক।
ঢাকার খুব কাছে, মোটেও প্রত্যন্ত দুর্গম এলাকা নয়। গেলাম ময়মনসিংহ সিভিল সার্জন অফিসে। গিয়ে তো আক্কেলগুড়ুম! এরকম কোন চিঠির হদিস তারা জানেনই না! আমরা হয়ত বেশি এডভান্স নাকি বুঝতে পারলামনা। চিঠিই পাননি আর বাকি খবর তাই খুব একটা পেলাম না।
নেত্রকোণা সিভিল সার্জন অফিসের চিত্র আবার ভিন্ন। চিঠির ব্যাপারে তারা জানেন। জানতে পারলাম মান্ধাত্তার আমলের জনবল কাঠামো দিয়ে এখনো উপজেলাগুলো ধুকে ধুকে চলে। তার মধ্যেও আবার প্রচুর পরিমাণ পদ ফাঁকা। তারা অকপটে স্বীকার করলেন প্রচুর চিকিৎসক প্রয়োজন। শুধুমাত্র সদরেই ১২ টা পোস্ট ফাঁকা। ৮ টা সম্পূর্ণ ফাঁকা আর বাকি ৪ জন নেত্রকোণা মেডিকেল কলেজে এটাচমেন্টে।প্রতি কনসালটেন্ট এর জন্য তো সর্বনিম্ন একজন হলেও মেডিকেল অফিসার প্রয়োজন। নতুবা কি করে একজন কনসালটেন্ট রাউন্ড দিবেন/ অপারেশন করবেন!
ব্যাপারগুলো আরো খোলাসা হল জামালপুর গিয়ে! জামালপুর জেলায় মোট পদ রয়েছে ১৭৭ । তার মধ্যে কর্মরত চিকিৎসক আছেন ৮৬ জন। শূণ্য পদ রয়েছে ৯১ ! আবার ৩ টি উপজেলা ৩১ শয্যা হতে ৫০ শয্যায় উন্নীত হয়েছে। অথচ জনবল সেই ৩১ শয্যাবিশিষ্টই রয়ে গেসে। এখানে আরো ১৮ টি নতুন পদ সৃজন এমনিতেই প্রয়োজন। এতে করে সর্বমোট শূণ্য পদের সংখ্যা দাঁড়াবে ১২৯! এত ক্রাইসিসের মধ্যেও আবার প্রেষণে / অন্যত্র কর্মরত চিকিৎসক ৩৮ জন! খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ, জামালপুরে ১৭ জন সহ ঢাকা মেডিকেল কলেজ, মুগদা জেনারেল হাসপাতাল, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, শেখ হাসিনা ইনস্টিটিউট অব হেল্থ টেকনোলজি, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় প্রভৃতি জায়গায় এই ৩৮ জন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন।
দিনে দিনে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। উপজেলা হেল্থ কম্প্লেক্সে শয্যাসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। নতুন নতুন মেডিকেল কলেজ স্থাপিত হয়েছে। বিশেষায়িত হাসপাতালগুলো বেড়েছে। কিন্তু সেই ২০০৮ সালের জনবল কাঠামোতেই সবাই আটকে আছে। হয়নি পদ সৃজন। হয়নি বড় কোন নিয়োগ। এসব নতুন চাহিদাগুলো মেটাতে উপজেলা/ইউনিয়ন সাবসেন্টার থেকে এটাচমেন্টে চিকিৎসকদের নিয়ে আসা হয়। কাগজে কলমে পদ ফিলআপ থাকলেও আদতে চিকিৎসক তো উপজেলায় কাজ করতে পারছেন না।
প্রতি মাসেই নাকি শূণ্য পদ পূরণের চাহিদা চেয়ে চিঠি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে পাঠানো হয়। কিন্তু এগুলোর কিছুই কাজে দেয় না। এবারের চিঠিটাও কি তাহলে ওরকমই ?
উত্তর জানতে দ্বিগুণ উদ্যমে খোঁজ নিতে গেলাম এবার রাজশাহী বিভাগে…
(চলবে…)
[ময়মনসিংহ বিভাগের সমন্বয়কারী ছিলেন-
ডা রাফসান আব্দুল্লাহ
ডা এস এম শহীদুর রহমান
জেলা প্রতিনিধি হিসেবে ছিলেন-
ডা মো মনিরুজ্জামান
ডা আদনিন মৌরিন
ডা মনোয়ার মো ভূইয়া পুলক]