দেশের ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর সাংগঠনিক তৎপরতায় এখন তেমন বাধা নেই; তবে বাধা মাঠের রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনে। জাতীয় কিংবা রাজনৈতিক কোনো ইস্যুতে তৎপরতা চালাতে গেলেই বাধা আসে। এ কারণে বিভিন্নভাবে কোণঠাসা এই দলগুলো। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি মাঠে নামতে না পারার প্রভাব ইসলামী দলগুলোর ওপর পড়ছে বলে নেতারা মনে করছেন। তাদের মতে, দেশে রাজনীতির স্বাভাবিক পরিবেশ নেই। দেশ, জাতি এবং স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের স্বার্থেই রাজনীতিতে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনা উচিত। এটি একা কোনো দলের পক্ষে সম্ভব নয়। এ জন্য জাতীয় ঐক্য প্রয়োজন। সরকারি বাধা ভাঙার জন্য ঐক্য শক্তির প্রয়োজন। এ জন্য ইসলামী দলগুলোর মধ্যে ঐক্য নিয়ে আলোচনাও হচ্ছে। কোনো কোনো রাজনৈতিক দল সঙ্কট উত্তরণের উপায় নিয়ে চিন্তাভাবনা চালানোর কথা জানিয়েছে।
দেশের বেশ কয়েকটি ইসলামী দলের নেতার সাথে গতকাল সোমবার কথা বলে তাদের দলীয় তৎপরতা ও মনোভাবের বিষয় জানা যায়।
বিভিন্ন ধর্মীয় ও জাতীয় রাজনৈতিক ইস্যুতে একসময় মাঠে সক্রিয় ভূমিকা পালনকারী এসব দলের নেতারা জানান, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে ঘরোয়া কর্মসূচি পালনেও প্রশাসনের অনুমতি নিতে হচ্ছে। বড় কর্মসূচি পালন তো দূরের কথা, কাশ্মিরসহ আন্তর্জাতিক কিছু ইস্যুতে সীমিত পরিসরে কিছু কর্মসূচি পালনের অনুমতি মিললেও জাতীয় কোনো ইস্যু বিশেষ করে রাজনৈতিক ইস্যুতে মাঠে নামার কোনো অনুমতিই মিলছে না।
ইসলামী দলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে সংগঠিত ও প্রভাবশালী হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী প্রকাশ্য তৎপরতা চালাতে পারছে না ২০১০ সালের পর থেকেই। শীর্ষ নেতাদের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারকে কেন্দ্র করে দলটির নেতাকর্মীদের প্রকাশ্য তৎপরতা অঘোষিতভাবেই নিষিদ্ধ। কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে শুরু করে দেশব্যাপী সব অফিসই তালাবদ্ধ বছরের পর বছর। নেতাকর্মীরা গ্রেফতার হচ্ছেন যখন-তখন। অসংখ্য নেতাকর্মী আহত, নিহত এমনকি গুমও হয়েছেন। আগে দলটি ঝটিকা মিছিলসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালনের মাধ্যমে নিজেদের অস্তিত্বের জানান দিলেও সাম্প্রতিককালে এমন ঝটিকা তৎপরতাও খুব একটা নেই। তবে দলটির অভ্যন্তরীণ ও সাংগঠনিক তৎপরতা নিয়মতান্ত্রিকভাবেই চালানো হচ্ছে বলে নেতাকর্মীদের সাথে আলাপ করে জানা যায়। ঘরোয়া কর্মসূচি পালন করার সময়ই মাঝে মধ্যে জামায়াত নেতাকর্মীদের গ্রেফতারের ঘটনা ঘটছে। সম্প্রতি চট্টগ্রামে জামায়াতের মহানগর আমিরসহ ১১ জন নেতাকর্মীকে গ্রেফতারে পর দলের সেক্রেটারি ডা: শফিকুর রহমান জেনারেল এক বিবৃতি দেন। তাতেই জামায়াতের রাজনৈতিক তৎপরতার বিষয়ে তিনি মন্তব্য করেন।
ডা: শফিকুর রহমান বলেন, ১০ বছর ধরেই সরকার জামায়াতে ইসলামীকে নেতৃত্বশূন্য করার জন্য নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে নানাভাবে ষড়যন্ত্র করে আসছে। তা সত্ত্বেও আল্লাহর রহমতে জামায়াতে ইসলামী সরকারের সব ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে বাংলাদেশের জমিনে টিকে আছে।
ইসলামী আন্দোলন, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, ইসলামী ঐক্যজোট, খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস ও খেলাফত আন্দোলনের মতো দলগুলোর প্রকাশ্য সাংগঠনিক তৎপরতায় কোনো বাধা নেই। তবে মাঠের রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনে বাধা রয়েছে। হেফাজতে ইসলামের আন্দোলনকেন্দ্রিক কিছু কিছু ইসলামি দলের নেতাকে গ্রেফতারের ঘটনাও এর আগে ঘটেছে। পরে তারা মুক্তিও পান। অনেকে মামলাজনিত কারণেও নানাভাবে কোণঠাসা হয়ে আছেন। আবার হেফাজতে ইসলামের নেতাদের একটি অংশের সাথে সরকারি মহলের সুসম্পর্কও গড়ে ওঠেছে। এবারের হজে ৫৭ সদস্যবিশিষ্ট একটি ওলামা প্রতিনিধিদলকে সরকারি খরচে হজে যাওয়ার সুযোগ করে দেয়া হয়। তাদের মধ্যে হেফাজতে ইসলামের বেশ কয়েকজন নেতাও রয়েছেন।
জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামের মহাসচিব আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী তাদের রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক তৎপরতার ব্যাপারে নয়া দিগন্তকে বলেন, কাশ্মির, আসাম পরিস্থিতি এবং সীমান্ত হত্যাসহ ও জাতীয় কিছু ব্যাপারে আমার জমিয়তের উদ্যোগে সমাবেশ, মানববন্ধন, প্রেস কনফারেন্সসহ প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করেছি। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে দেশ আজ প্রতিবেশী দেশের আগ্রাসনের শিকার। এর প্রতিকার যেভাবে হওয়া দরকার ছিল সেটা আমরা পারছি না। যেখানে কোনো রাজনৈতিক প্রোগ্রাম করার অনুমতি নেই। সেখানে কিভাবে আমরা রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করব? সরকারের দমন নীতির কারণে মুক্তভাবে রাজনীতি করা এখানে অসম্ভব হয়ে পড়ছে। গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতেও কথা বলা যাচ্ছে না। তিনি বলেন, এখন প্রয়োজন জাতীয় ঐক্যের। সর্বস্তরের জনগণের রুখে দাঁড়ানোর। কিন্তু সরকার আমাদের কোণঠাসা করে রেখেছে। এই পরিস্থিতিতে বড় আকারে কোনো ভূমিকা পালন করা সম্ভব হচ্ছে না। তিনি আরো বলেন, অবশ্যই এই পরিস্থিতি মোকাবেলা করা অপরিহার্য মনে করি। যেকোনো মূল্যে সরকারি এই প্রতিরোধ ভেঙে দেশের স্বার্থে মাঠে নামা দরকার। আমরা নিজেরা চিন্তাভাবনা করছি। আন্দোলন করতে হলে সরকারের বাধা অতিক্রম করেই করতে হবে। এ জন্য ঐক্যের প্রয়োজন, শক্তির প্রয়োজন। জাতিকে এই অবস্থা থেকে মুক্ত করার জন্য কোনো রোডম্যাপ তৈরি করা যায় কি না তা নিয়ে আমরা চিন্তাভাবনা করছি।
চরমোনাইর পীরের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলনের মহাসচিব অধ্যক্ষ মাওলানা ইউনুস আহমদ নয়া দিগন্তকে বলেন, সাংগঠনিক কার্যক্রম এবং বিভিন্ন ইস্যুতে কার্যক্রম চলমান আছে। রাজনৈতিক ইস্যুগুলোতে আমরা আন্দোলনের চেষ্টা করছি। রাজনৈতিক ইস্যুতে আন্দোলনকে গুরুত্ব দিচ্ছি। বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে কখনো সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না এই বক্তব্যে আমরা অটল। বাস্তবতা হচ্ছে যেখানে বাকস্বাধীনতা নেই, কর্মসূচিতে বাধা আসে, বড় দলগুলোকেও মাঠে নামতে দেয়া হচ্ছে না, সেখানে অন্য দলগুলোর উপর প্রভাব তো পড়েই।
ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান মাওলানা আবদুল লতিফ নেজামী বলেন, দেশের রাজনীতিতে একেক সময় একেক পরিস্থিতি বিরাজ করে। এখন একরকম পরিস্থিতি বিরাজ করছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে ইসলামী ঐক্যজোট সাংগঠনিকভাবে যেসব কাজ সেগুলো চালিয়ে যাচ্ছে। বিষয়টা হচ্ছেÑ সরকারে যারা থাকে তারা বলে দেশের পরিস্থিতি ভালো এবং বিরোধী দলে যারা থাকে তারা বলে পরিস্থিতি খারাপ। এটা তো ঠিক যে, যেখানে প্রধান বিরোধী দল বিএনপিই আন্দোলনে সক্রিয় হতে পারছে না সেখানে তার প্রভাব তো অন্য দলে পড়ে। সেজন্যই অন্যরাও সক্রিয় হতে পারছে না। বিএনপি তো কিছুই করতে পারছে না। এ কারণেই বলা চলে রাজনীতিতে একটা নিস্তব্ধতা চলে এসেছে।
খেলাফত মজলিসের মহাসচিব ড. আহমদ আবদুল কাদের বলেন, সাংগঠনিক তৎপরতা চলছে, কোনো সমস্যা হচ্ছে না। আর মাঠের তৎপরতা বিভিন্ন ইস্যুতে মাঝে মধ্যে চালানোর চেষ্টা করছি। এক সময়তো সবকিছুই যখন তখন করা যেত।
এখন তো সেটা করা যায় না। মানে পুলিশের বাধা, প্রতিটি কাজই পুলিশকে জানিয়ে করতে হয়। মানববন্ধন করতেও পারমিশন নিতে হয়। একটা মিছিল করতেও যদি পুলিশের অনুমতি নিতে হয় তাহলে ছোট দলের কর্মকাণ্ড সীমিত হয়ে আসবেই। দেশে স্বাভাবিক রাজনৈতিক পরিবেশ না হলে রাজনৈতিক তৎপরতা এভাবেই চলতে থাকবে। তিনি বলেন, স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার কাজটি সবাই মিলে করতে হবে। কারণ ঘোষিত বা অঘোষিত, প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ বিধিনিষেধ বিভিন্নভাবে আছে। এগুলো ভাঙতে হলে দেশে সুষ্ঠু রাজনীতি নিয়ে আসা খুব জরুরি। বর্তমানে দেশে বদ্ধ একটা ভীতিকর অবস্থা বিরাজমান। সরকার সবাইকে চাপের মুখে রাখার চেষ্টা করছে। এই সরকার যতদিন থাকবে ততদিন দেশে ভালো পরিবেশ তৈরি হবে বলে মনে হয় না। আমরা দলীয়ভাবে চেষ্টা করছি। পাশাপাশি সব দল ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করলে একটা রেজাল্ট আসবে। একাকী করলে ভালো রেজাল্ট পাওয়া যাবে বলে মনে করি না।
বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক তনয় মাওলানা মাহফুজুল হক বলেন, আমরা তো কাশ্মির ইস্যুতে প্রোগ্রাম করেছি। সর্বদলীয় ব্যাপারে ঐক্যবদ্ধভাবেও প্রোগ্রাম করেছি। আমরা বসেছিলাম। আমাদের দলগুলোর মধ্যে আরো মজবুতি অর্জন বিশেষকরে কিভাবে ভারতের বিভিন্ন আগ্রাসী মনোভাবের বিরুদ্ধে তৎপরতা চালাতে পারি-এগুলো নিয়ে আমরা ভালোভাবেই কাজ করার চেষ্টা করছি। আসলে জাতীয় ইস্যুতে এই মুহূর্তে খুব তৎপরত আমরা থাকতে পারছি না। চেষ্টা আছে। জাতীয় বহু সমস্যা। কিন্তু পরিবেশ নেই। রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক বাধা তো বড় বিষয়। মাঠে প্রোগ্রাম করাই জটিল। করতে গেলেই বাধা। এটা থেকে উত্তরণের জন্যই আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার চেষ্টা করছি। এই কাজ এককভাবে করা যায় না। দেশের মধ্যে যখন একটা অস্বাভাবিক পরিস্থিতি হয়, বড় বড় দল যখন ভূমিকা রাখতে ইতঃস্তত বোধ করে তার প্রভাব অন্যদের ওপর পড়ে কিছুটা। এ ক্ষেত্রে আবার ভিন্ন কৌশল নিতে হয়। আমরা সেই কৌশলেরও ফিকির করছি।
বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের নায়েবে আমির মাওলানা মুজিবুর রহমান হামিদী বলেন, ইসলামী দলগুলো কোণঠাসা অবস্থায় আছে। কোনো বড় কর্মসূচি পালন করতে গেলেই বাধা আসে। দেশে রাজনৈতিক তৎপরতার সেই পরিবেশ এখন নেই। বড় দলগুলোও মাঠে নামতে পারছে না। সেটার প্রভাব অন্য দলসহ ইসলামী দলগুলোর ওপরও পড়ছে। তিনি বলেন, এই অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় ঐক্যবদ্ধ তৎপরতা। কিন্তু সেই ঐক্যের চেষ্টাও এখন আর সেভাবে নেই। তবে অনেকে ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার বিষয়টি বলছেন। Source: Daily Nayadiganta