সাবেক দু’জন শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তার আত্মীয়স্বজনের নামে ঢাকায় বেশ কিছু বাস রয়েছে। যদিও ওই বাসগুলোর প্রকৃত মালিক ওই দুই পুলিশ কর্মকর্তাই বলে জানা গেছে। দু’টি কোম্পানির ব্যানারে ওই বাসগুলো ঢাকায় চলাচল করছে। পুলিশেরই মাঠপর্যায়ের একাধিক সদস্য বলেছেন, ওই বাস দু’টির চালকরা এতটাই বেপরোয়া, তারা কখনো কিছুই তোয়াক্কা করে না। ইচ্ছেমতো গাড়ি চালায়। তাদের ধারণা ওই গাড়ি কোনো পুলিশ আটক করতে পারবে না। এভাবে যে গাড়ির মালিক যত ক্ষমতাধর; সেই গাড়ির চালকও ততটাই বেপরোয়া। এমন কথাই বললেন অনেকে।
দাপুটে এই মালিকদের মধ্যে পুলিশ কর্মকর্তাই নন; রাজনৈতিক নেতা, ধনাঢ্য শিল্পপতি-ব্যবসায়ী, সরকারি কর্মকর্তাÑ অনেকেরই পরিবহন রয়েছে। এই ‘পদমর্যাদার’ লোকদের সুবিধা হলোÑ তাদের গাড়ি থেকে চাঁদা দিতে হয় না, কাগজপত্র ঠিক না থাকলেও বিআরটিএ কিছু বলে না, রাস্তায় পুলিশি হয়রানির শিকার হতে হয় না। এমনকি; রাস্তায় পিষে মানুষ মেরে ফেললেও তাদের কোনো কৈফিয়ত দিতে হয় না। মন্ত্রী-এমপিদেরও অনেক গাড়ি রয়েছে, যা নির্বিঘেœ রাস্তায় চলছে। আবার অনেকে রয়েছেন যাদের একটি গাড়িও নেই কিন্তু পরিবহন কোম্পানি খুলে বসেছেন। কোম্পানির নামে তারা বিভিন্ন ব্যক্তি মালিকানাধীন গাড়ি চালান। বিনিময়ে তারা পান মাসোয়ারা। কোনো পুঁজি বিনিয়োগ না করেই তারা বসে বসে গাড়ি প্রতি দিনে ৫০০-১০০০ টাকা নিয়ে যান।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, সরকারি কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ীসহ অর্ধশতাধিক প্রভাবশালী ব্যক্তি পরিবহন ব্যবসায় জড়িত। এর মধ্যে বেশ কয়েকজন রয়েছেন পুলিশ কর্মকর্তা। শীর্ষ সারির সাবেক দুই পুলিশ কর্মকর্তা রয়েছেন যাদের বিভিন্ন কোম্পানিতে বেশ কিছু বাস রয়েছে। আর এসব ব্যক্তির গাড়িতেই বেশি দুর্ঘটনা ঘটছে। এ ছাড়া এই পরিবহন ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে আরো অনেক অভিযোগ রয়েছে। রাজধানীর মিরপুর থেকে চলাচলকারী চয়েজ, সিল্কসিটি, বিকল্প, বিহঙ্গ, শিখর, ইটিসি, ইউনাইটেড, দিশারী, নিউভিশন, সুপার সিটিং, শিকড়সহ বিভিন্ন কোম্পানির মিনিবাস সিটিং সার্ভিস হিসেবে চলছে। এ ছাড়া বিমানবন্দর সড়কে চলাচল করছে প্রভাতী, আজমেরী ও গাজীপুর পরিবহন। গুলিস্তান-ধামরাই রুটের বাস দিশারী, গাবতলী মিনিবাস মালিক সমিতি, নিউভিশন,প্রƒঁইয়া, মৌমিতা, তেঁতুলিয়া, ঠিকানা, সাভার, নূরজাহান মানিকগঞ্জ, ফুলবাড়িয়া, প্রজাপতি, লাব্বাইক, আশীর্বাদ, প্রজাপতি, হিমাচল ও বসুমতী, মতিঝিল থেকে মোহাম্মদপুরগামী মৈত্রী, এটিসিএল, দিপন পরিবহনের বাসগুলোও যাত্রী হয়রানির ক্ষেত্রে শীর্ষে রয়েছে। এর অধিকাংশের মালিক হলেন প্রভাবশালী ব্যক্তি ও রাজনৈতিক ব্যক্তি। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের সাথে তারা কোনো না কোনোভাবে সম্পৃক্ত রয়েছেন। আবার কখনো কখনো দেখা গেছে রাজনৈতিক বৈরী হাওয়ায় রাতারাতি এসব কোম্পানির মালিক পরিবর্তন হয়েছে। পরিবহন সূত্র বলেছে, শুধু ব্যবসা করার জন্যই এই খোলস পরিবর্তন।
রাতারাতি কোম্পানির নাম পরিবর্তনের ঘটনাও ঘটেছে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরপর কনক পরিবহন মিরপুর থেকে আগারগাঁও, মহাখালী, কাকলী হয়ে আবদুল্লাহপুর পর্যন্ত রুটে ১৫টি বাস নামানোর অনুমতি পায়। এরূপ আরো বেশ কয়েকটি পরিবহন কোম্পানি রয়েছে; যার সাথে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা সরাসরি জড়িত আছেন। প্রজাপতি পরিবহনের মালিক আওয়ামী লীগের মিরপুরের এক সাবেক এমপি। বসুমতী পরিবহন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহর। আজিমপুর থেকে উত্তরা পথে চলাচলকারী ‘সূচনা-বিআরএফ’ পরিবহনে রয়েছে সাবেক এক প্রতিমন্ত্রীর ছেলের বাস। একজন প্রভাবশালী এমপির চাচাতো ভাইয়ের বাসও চলে ‘সূচনা-বিআরএফ’ পরিবহনে। রাজধানীতে গাড়িচাপায় সর্বোচ্চ সংখ্যক মানুষ হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত হচ্ছে তেঁতুলিয়া পরিবহন। মোহাম্মদপুর থেকে মিরপুর হয়ে আবদুল্লাহপুর রুটে পরিচালিত এই পরিবহনে অনুমোদিত গাড়ি আছে মাত্র ৫০টি। অথচ একই সাইনবোর্ডে ১৩০টিরও বেশি গাড়ি চলাচল করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। তেঁতুলিয়া পরিবহন কোম্পানির চেয়ারম্যান ভোলার এক এমপি এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসুম মিয়া। জানা যায়, মাত্র আড়াই বছরে তেঁতুলিয়া গাড়ির চাকায় পিষ্ট হয়ে ও বেপরোয়া চালানোজনিত দুর্ঘটনায় শতাধিক ব্যক্তির মৃত্যু ঘটেছে। প্রভাবশালী হওয়ায় এই পরিবহনের কোনো চালককে আইনের আওতায় নেয়া যায় না।
আজিমপুর, মিরপুর-১২, কুড়িল ও সদরঘাট রুটে চলাচলকারী বিহঙ্গ নামের পরিবহনের গাড়ির সংখ্যা ৩০০ এর উপরে। তবে সবই লক্কড়-ঝক্কড় মার্কা। বিহঙ্গ পরিবহন কোম্পানির চেয়ারম্যান স্বেচ্ছাসেবক লীগের একজন শীর্ষ নেতা এবং এমডি পরিবহন মালিক খোকন মিয়া। মালিক সমিতির অনেক নেতা রয়েছেন যাদের গাড়ি নিয়মিত দুর্ঘটনা ঘটায়। কিন্তু তারপরেও কোনো বিচার হয় না। এসব পরিবহন দুর্ঘটনা ঘটালে রাতারাতি কোম্পানির নাম পরিবর্তন হয়ে যায়। জাবালে নূর পরিবহন এয়ারপোর্ট রোডে ফুটপাথে তুলে দিয়ে ছাত্র হত্যার ঘটনা ঘটায়। চলতি বছরের মার্চ মাসে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার প্রবেশমুখে সুপ্রভাত পরিবহনের একটি বাস আবরার আহমেদ চৌধুরী নামে এক বিশ^বিদ্যালয় ছাত্রকে চাপা দিয়ে হত্যা করে। আন্দোলনের মুখে এক সময় এই সুপ্রভাত পরিবহন কোম্পানির নিবন্ধন বাতিল করা হয়। সুপ্রভাত কোম্পানি বন্ধ হলেও ওই কোম্পানির বাস কিন্তু বন্ধ হয়নি। বিভিন্ন কোম্পানিতে সেগুলো ভাগ ভাগ হয়ে ঠিকই এখন রাস্তায় সেই বাসগুলো চলছে। এর কিছু বাস ভিক্টর পরিবহন কোম্পানিতে যুক্ত হয়েছে।
এই বাসটি টঙ্গি থেকে কুড়িল বিশ^রোড হয়ে সদরঘাট পর্যন্ত চলাচল করে। গত ৫ সেপ্টেম্বর উত্তরায় ভিক্টর পরিবহনের চাপায় নিহত হন সঙ্গীত পরিচালক পারভেজ রব। এ ঘটনায় গত শনিবার উত্তরার কামারপাড়ায় একটি সালিসি বৈঠক চলছিল। সেখানে ভিক্টর পরিবহনের কর্মকর্তারা এবং রবের স্বজনরা উপস্থিত হয়েছিলেন। এক পর্যায়ে সেই বৈঠকে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়লে সেখানে ভিক্টর পরিবহনের একটি গাড়ি রবের স্বজনদের ওপর দিয়ে চালিয়ে দেয়। এতে রবের ছেলে ইয়ামিন আলভী (১৯) গুরুতর আহত হন। আর আলভীর বন্ধু মেহেদী হাসান ছোটন (২০) নিহত হন। আলভীর অবস্থাও গুরুতর। তার মেরুদণ্ডের হাড় ভেঙে গেছে। বিষয়টি এখন ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা চলছে বলে অভিযোগ উঠেছে। জানা গেছে, এই কোম্পানিটির এমডি দিপু সরকারের একজন প্রভাবশালী ব্যক্তির ছেলে। যে কারণে এই কোম্পানির বাসগুলোও রাস্তায় খুবই বেপরোয়া।
বেসরকারি সংগঠন নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক আশীষ কুমার দে নয়া দিগন্তকে বলেন, চালকরা এমনিতেই বেপরোয়া। আর যে গাড়ির মালিক যত ক্ষমতাধর সেই গাড়ির চালক ততটাই বেপরোয়া হবে; এটাই স্বাভাবিক।