স্টাফ রিপোর্টার : পর্দার আড়ালের আলোচনায় জাতীয় পার্টির (জাপা) বিরোধ আপাতত মিটেছে। রওশন এরশাদ হবেন বিরোধীদলীয় নেতা। জিএম কাদের থাকবেন জাপার চেয়ারম্যান। বিরোধীদলীয় উপনেতার পদেও বসবেন তিনি। পরস্পরকে মেনে নেবেন রওশন ও কাদের। এসব শর্তে সমঝোতা হয়েছে দেবর-ভাবির।
গতকাল শনিবার মধ্যরাত পর্যন্ত চলা রওশন ও কাদেরের প্রতিনিধিদের বৈঠকে এ সমঝোতা হয়। সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের মধ্যস্থতায় এ বৈঠক হয় বলে জানা গেছে। এতে সিদ্ধান্ত হয়, আজ রোববার দুপুরে জাপার সংসদীয় দলের সভায় সব এমপি যোগ দেবেন। রওশনকে বিরোধীদলীয় নেতা ও কাদেরকে উপনেতা নির্বাচিত করা হবে।
তবে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যুতে শূন্য রংপুর-৩ আসনে রওশনপুত্র রাহাগীর আল মাহি সাদ জাপার মনোনয়ন পাবেন কি না, তা এখনও নিশ্চিত নয়। রওশনপন্থিরা দাবি করেছেন, সাদই মনোনয়ন পাবেন। কাদেরপন্থিরা এ দাবি নাকচ করেছেন।
জাপার চেয়ারম্যান ও বিরোধীদলীয় নেতার পদ নিয়ে এরশাদের মৃত্যুর পর থেকেই রওশন ও কাদেরের মধ্যে টানাপড়েন শুরু হয়। বিরোধীদলীয় নেতা হতে চেয়ে গত মঙ্গলবার জিএম কাদের স্পিকারকে চিঠি দিলে বিরোধ চরমে পৌঁছে। রওশনও পাল্টা চিঠি দেন। এরশাদপত্নীকে জাপার চেয়ারম্যান ঘোষণা করেন তার অনুসারীরা। দলীয় প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষমতা চেয়ে দু’জন পাল্টাপাল্টি চিঠি দেন নির্বাচন কমিশনে। ছিল পাল্টাপাল্টি বহিস্কারের হুমকিও।
গত চার দিন দুই পক্ষের এসব পাল্টাপাল্টি পদক্ষেপ ও বক্তব্যে ষষ্ঠবারের মতো ভাঙনের মুখে পড়ে এরশাদ প্রতিষ্ঠিত জাপা। কিন্তু গতকাল পরিস্থিতি হঠাৎই বদলে যায়। দিনভর পর্দার আড়ালে চলে সমঝোতার চেষ্টা। জাপা সূত্র জানিয়েছে, সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের মধ্যস্থতায় শেষ পর্যন্ত সমঝোতা হয়। সরকারের তরফ থেকে সমঝোতার দায়িত্ব দেওয়া হয় জাপার মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গাঁকে। তিনি দু’পক্ষেরই আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিত।
গতকাল রাত ৯টার দিকে রাজধানীর বারিধারা ক্লাবে বৈঠকে বসেন জাপার বিবদমান দুই পক্ষের প্রতিনিধিরা। এতে জিএম কাদের অংশে ছিলেন দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ, জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু, সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা, গোলাম কিবরিয়া টিপু ও লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী। রওশন এরশাদ অংশের পক্ষে ছিলেন প্রেসিডিয়াম সদস্য ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, মুজিবুল হক চুন্নু, ফখরুল ইমাম এবং এস এম ফয়সাল চিশতি। দুই পক্ষের মাঝে ছিলেন রাঙ্গাঁ। রাত ১২টা পর্যন্ত চলে বৈঠক।
বৈঠক সূত্র জানিয়েছে, শুরুতেই আসে দলের চেয়ারম্যান প্রসঙ্গ। আনিসুল ইসলাম প্রস্তাব দেন, আগামী কাউন্সিল পর্যন্ত জিএম কাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান থাকবেন। কাউন্সিলে স্থায়ী চেয়ারম্যান নির্বাচিত হবেন। আবু হোসেন বাবলা এর প্রতিবাদ করে বলেন, ‘জিএম কাদেরকে চেয়ারম্যান না মানলে বৈঠক হবে না।’ আনিসুল ইসলাম তখন বলেন, ‘গঠনতন্ত্র অনুযায়ী কাউন্সিল ছাড়া চেয়ারম্যান নির্বাচনের পথ নেই।’ জবাবে ফিরোজ রশীদ বলেন, ‘গঠনতন্ত্র দেখাবেন না।’
বাদানুবাদে বৈঠক উত্তপ্ত হয়ে উঠলে রাঙ্গাঁর হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি শান্ত হয়। জিএম কাদেরকে চেয়ারম্যান পদে মেনে নিতে রাজি হন রওশনপন্থিরা। এরশাদের মৃত্যুর চার দিনের মাথায় জিএম কাদেরকে দলের চেয়ারম্যান ঘোষণা করেছিলেন রাঙ্গাঁই। জিএম কাদেরকে চেয়ারম্যান ঘোষণার পর থেকেই রওশনপন্থিরা বলে আসছিলেন, তিনি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান।
বৈঠকের দ্বিতীয় আলোচ্যসূচি ছিল, বিরোধীদলীয় নেতা নির্বাচন। আবু হোসেন বাবলা প্রস্তাব করেন, রওশনকে বিরোধীদলীয় নেতার পদে মেনে নিতে তাদের আপত্তি নেই। তবে উপনেতা নির্বাচিত করতে হবে জিএম কাদেরকে। পরে রওশনপন্থিরা জিএম কাদেরকে উপনেতা হিসেবে মেনে নিতে রাজি হন।
সাদের মনোনয়ন নিয়ে দীর্ঘ দুই ঘণ্টা আলোচনা হয়। আনিসুল ইসলাম ও ফয়সাল চিশতি বলেন, রওশন এরশাদ তার ছেলেকে প্রার্থী করতে চান। এটাই তার মুখ্য দাবি। জিএম কাদেরপন্থিরা জবাবে বলেন, সাদকে রংপুরের নেতারা মানবেন না। তবে জিএম কাদের ও রাঙ্গাঁ রংপুরের নেতাদের রাজি করাতে পারলে সাদকে মনোনয়ন দিতে আপত্তি নেই।
মসিউর রহমান রাঙ্গাঁ বলেছেন, আজ রোববার সকাল ১১টায় বনানী কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে সমঝোতা আলোচনার বিস্তারিত জানাবেন।
আবু হোসেন বাবলা বলেছেন, রওশন তাদের মায়ের মতো। তাকে বিরোধীদলীয় নেতা করতে কখনোই আপত্তি ছিল না। এখনও নেই। জিএম কাদের চেয়ারম্যান থাকবেন। তিনি উপনেতা হবেন। সাদের বিষয়ে এখনও চূড়ান্ত কিছু হয়নি। তবে ফয়সাল চিশতি দাবি করেন, সাদের মনোনয়ন নিশ্চিত হয়েছে। তিনিই এরশাদের আসনে লাঙ্গলের প্রার্থী হবেন।
সাদ দলীয় মনোনয়ন ফরম নিলেও গত শুক্রবার পার্লামেন্টারি বোর্ডের কাছে সাক্ষাৎকার দেননি। সাদকে বহিরাগত আখ্যা দিয়ে তার বিরোধিতা করছেন রংপুর সিটি করপোরেশনের মেয়রসহ স্থানীয় জাপা নেতারা। জাপা সূত্রের খবর, সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের সমর্থন থাকায় সাদই মনোনয়ন পেতে যাচ্ছেন।
এদিকে, আগামী ৩০ নভেম্বর জাপার জাতীয় কাউন্সিল হবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন জিএম কাদের। গতকাল তিনি বনানী কার্যালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, কাউন্সিলে আগামী দিনের নেতৃত্ব নির্বাচন করবেন দলের নেতাকর্মীরা। পদ-পদবির জন্য রাজনীতি করেন না বলেও দাবি করেন তিনি।
এদিকে গতকাল জাপার বনানী ও কাকরাইল কার্যালয়ে ছিল না আগের চার দিনের উত্তাপ-আঁচ। সকাল থেকেই ছিল সমঝোতার সুর। রওশন এরশাদকে পাল্টা চেয়ারম্যান ঘোষণা করায় আনিসুল ইসলাম ও ফখরুল ইমামকে দলীয় পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিল জিএম কাদেরপন্থিদের শুক্রবারের যৌথ সভায়। গতকাল এ সিদ্ধান্ত সংবাদ সম্মেলন করে জানানোর কথা ছিল। শেষ পর্যন্ত ওই সংবাদ সম্মেলন হয়নি। গতকাল বিকেলে গুলশানের বাসভবনে সংবাদ সম্মেলন করার কথা ছিল রওশনের। তার সংবাদ সম্মেলনও স্থগিত করা হয়। রংপুর-৩ আসনে প্রার্থী মনোনয়নে আজ দুপুরে রওশন এরশাদের গঠিত ‘পার্লামেন্টারি বোর্ড’-এর বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। ওই বৈঠকও স্থগিত করা হয়েছে। তখনই আভাস আসে সমঝোতা হতে যাচ্ছে দেবর-ভাবির।
সংসদ অধিবেশন শুরুর আগে আজ দুপুরে জাপার সংসদীয় দলের সভা ডেকেছেন বিরোধীদলীয় উপনেতা রওশন। গত শুক্রবার কাদেরপন্থিদের যৌথ সভায় জাপার ১৬ এমপি জানিয়েছিলেন, তারা রওশনের ডাকা বৈঠকে যাবেন না। তবে রাতের সমঝোতা বৈঠকের পর ফিরোজ রশীদ সমকালকে জানিয়েছেন, সব এমপি সভায় যাবেন। যদিও তিনি দিনের বেলায় জানিয়েছিলেন, সভায় যাবেন না।
একাদশ সংসদ নির্বাচনের পর এরশাদ নিজেই বিরোধীদলীয় নেতা হয়েছিলেন। উপনেতা করেন জিএম কাদেরকে। পরে তাকে সরিয়ে এ পদে রওশনকে বসান। মৃত্যুর আগে ভাইকে জাপার ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করেন। জিএম কাদের তার অবর্তমানে চেয়ারম্যান হবেন বলে লিখিত নির্দেশনা দিয়ে যান। দুই পক্ষের নেতারা জানিয়েছেন, এরশাদের সূত্র মেনেই আপাতত সমঝোতা হয়েছে। তবে বারবার অভ্যন্তরীণ বিরোধের জন্য আলোচনায় থাকা জাপায় কতদিন এ সহাবস্থান টিকে থাকবে তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। দেবর-ভাবির দুই যুগের বিরোধ সহজেই মিটবে বলে মনে করছেন না তারা।