ময়মনসিংহ লাইভ ডেস্ক : আমাদের দেশে গ্রামীণ কর্মশক্তির ২০ শতাংশ প্রাণিসম্পদ খাতের সাথে জড়িত। বর্তমানে এ খাত থেকে ৪৪ শতাংশ আমিষ পাওয়া যাচ্ছে। পুষ্টি, খাদ্যনিরাপত্তার দিক থেকেও খাতটি গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু চাহিদার সাথে কুলিয়ে উঠতে পারছে না বিভিন্ন সংক্রামক রোগের কারণে। ব্রুসেলোসিস বাংলাদেশে প্রাণিসম্পদ খাতে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি সাধন করছে। এ ক্ষতি থেকে খামারীদের রক্ষার জন্য গত পাঁচ বছর থেকে গবেষণা করে যাচ্ছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারি অনুষদের মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড হাইজিন বিভাগের প্রফেসর ড. মোঃ আরিফুল ইসলাম। তিনি বাংলাদেশে প্রথমবারের মত এ রোগের জন্য দায়ী ব্যাকটেরিয়া সনাক্তকরণ এবং ওই ব্যাকটেরিয়ার জীবন রহস্য উন্মোচন করেছেন। ফলে এ রোগের অধিকতর গবেষণা, চিকিৎসা পদ্ধতির উন্নয়ন, কার্যকরী ভ্যাক্সিন উদ্ভাবন এবং রোগটি থেকে গবাদিপশুকে মুক্ত রাখতে করনীয় নির্ধারণ করা সম্ভব হবে। গবেষণায় সহসোগী হিসেবে ছিলেন প্রফেসর ড. মোছা. মিনারা খাতুন ও পিএইচডি ফেলো হিসেবে ছিলেন মো. ছাদেকুল ইসলাম। শনিবার সকাল সাড়ে দশটায় এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি তার গবেষণায় সাফল্যের কথা তুলে ধরেন। বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমি এবং যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগের (BAS-USDA) অর্থায়নে গবেষণাটি পরিচালিত হয়েছে।
ড. মোঃ আরিফুল ইসলাম বলেন, ব্রæসেলোসিস ব্যাকটিরিয়া জনিত একটি জুনোটিক রোগ যা প্রাণীর দেহ থেকে মানুষের দেহে সংক্রামিত হয়। রোগটি ব্রুসেলা গনের গ্রাম নেভেটিভ ব্যাকটিরিয়া দ্বারা হয়ে থাকে। গৃহপালিত প্রাণী যেমন গরু, মহিষ, ভেড়া, ছাগল, শুকুর এবং কুকুর এ রোগের পোষক। পাঁচটি প্রজাতির ব্রæসেলা ব্যাকটিরিয়ার দ্বারা গৃহপালিত প্রাণীতে ব্রæসেলোসিস হয়ে থাকে। ব্রæসেলা এবোর্টিস গরু ও মহিষে, ব্রæসেলা মেলিটেন্সিস ছাগলে ও ভেড়ায়, ব্রুসেলা অভিস ভেড়ায় এবং ব্রæসেলা ক্যানিস কুকুরে ব্রæসেলোসিস রোগের জন্য দায়ী। ব্রুসেলোসিস রোগ গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া ও শূকরের গর্ভাবস্থার শেষের দিকে গর্ভপাত ঘটায়। গর্ভপাত, দুগ্ধ উৎপাদন হ্রাস, বাচ্চার মৃত্যু, প্রজননে ব্যাঘাত, গর্ভফুল আটকে যাওয়া, জরায়ু প্রদাহের জন্য রোগটি দায়ী। ফলে দুগ্ধখামার ব্যাপক আর্থিক ক্ষতি সম্মুখীন হয়।
তিনি জানান, গবেষনায় ব্রুসেলা রোগের ব্যাকটিরিয়া সফল ভাবে পৃথকীকরণ এবং সনাক্তকরণ সম্পন্ন হয়েছে। এ গবেষনায় বাংলাদেশের গবাদি পশুতে ব্রুসেলা এবোর্টিস বায়োভার-৩ ব্যাকটিরিয়া সনাক্ত করা হয়েছে। এ ব্যাকটিরিয়ার পূর্ণ জীবন বৃত্তান্ত উন্মোচন করা হয়েছে এবং জিন ব্যাংকে জমা করা হয়েছে। গবেষণা কর্মটির বৈজ্ঞানিক স্বীকৃতিস্বরুপ আন্তর্জাতিক জার্নাল মাউক্রোবায়োলজি রিসোর্স এনাইন্সমেন্ট (Microbiology Resource Announcements) এ প্রকাশিত হয়েছে। ফলে বাংলাদেশে গরুতে ব্রæসেলোসিস রোগ নির্ণয় পদ্ধতি এবং এর কার্যকর টিকা উদ্ভাবনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। বাংলাদেশ থেকে ব্রæসেলোসিস নিধনে এটি সম্ভাবনার একটি নতুন দ্বার উন্মোচিত করবে।
গবেষক জানান, গর্ভপাতের সময় ব্যাকটিরিয়াটি গাভীর জরায়ু থেকে বাহির হয়ে গবাদি পশুর খামারের মাটি, পানি, ও খাদ্যকে দূষিত করে এবং এসবের মাধ্যমে অন্যান্য গবাদি পশু এ রোগে আক্রান্ত হয়। আক্রান্ত পশুর সঙ্গে যৌন মিলন এবং সরাসরি সংস্পর্শে এসে খামারের অন্যান্য সুস্থ প্রাণী এ রোগ আক্রান্ত হয়। অন্যদিকে ব্রুসেলোসিস রোগ খাদ্য, আক্রান্ত পশুর সংস্পর্শের মাধ্যমে মানুষে ছড়াতে পারে। আক্রান্ত পশুর কাঁচা ও স্বল্প জাল দেয়া দুধ খাওয়ারে মাধ্যমে অথবা নির্গত পদার্থের বা আক্রান্ত প্রাণীর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সংস্পর্শে মানুষের এ রোগ হতে পারে। গর্ভপাত এবং মৃত বাচ্চা প্রসবকারী প্রাণীর পরিচর্যাকারী খামারী এবং চিকিৎসা প্রদানকালে প্রাণী চিকিৎসক এ রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে।
তিনি বলেন, গবাদি পশুতে এ রোগ সনাক্ত করণের জন্য অনেক পরীক্ষা রয়েছে। এদের মধ্যে রোজ বেঙ্গল প্লেট টেস্ট, এলাইজা পদ্ধতি ও মিল্ক রিংক টেস্ট অন্যতম। এ পরীক্ষা দ্বারা প্রাণীর রক্ত বা দুধে এই রোগের এন্টিবডির উপস্থিতি নির্ণয়ের মাধ্যমে ব্রæসেলোসিস রোগ সনাক্ত করা হয়। তবে এই পরীক্ষা গুলো অনেক সময় আক্রান্ত প্রাণীতে সঠিকভাবে ব্রæসেলোসিস রোগ নির্ণয় করতে পারে না। তাই কোন প্রাণীতে ব্রæসেলোসিস নিশ্চিত করার সবচেয়ে উত্তম পদ্ধতি হলো আক্রান্ত প্রাণী থেকে এ রোগের ব্যাকটিরিয়া পৃথক করা এবং কোন ব্যাকটেরিয়া তা সনাক্ত করা।
ড. মোঃ আরিফুল ইসলাম বলেন, প্রাণীতে এ রোগ নিয়ন্ত্রনের জন্য সারা দেশব্যাপী রোগটির নজরদারী কর্মসূচি গ্রহণ করা প্রয়োজন। খামারে নতুন প্রাণী প্রবেশের পূর্বে এবং বিদেশ থেকে প্রাণী আমদানী করার ক্ষেত্রে রোগ মুক্ত কি না যাচাই করতে হবে। খামারের গাভীতে গর্ভপাতের কারণ অনুসন্ধানের জন্য প্রাণী সম্পদ বিভাগকে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ ও রোগ সনাক্ত করণের জন্য প্রয়োজনীয় পরীক্ষাগার সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। খামারে স্বাস্থ্যবিধি এবং স্যানিটারি পদ্ধতি সম্পর্কে খামারীকে ব্যবহারিক প্রশিক্ষণ দিতে হবে। গবাদি পশুতে ব্রুসেলোসিস রোগ প্রতিরোধ এবং নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি কার্যকরী উপায় হলো টিকা প্রদান। তবে বাংলাদেশে গবাদি পশুতে এই রোগের প্রতিরোধের জন্য কোন টিকা প্রদান করা হয় না।
তিনি আরও বলেন, জনস্বাস্থ্য বিবেচনায়ও রোগটি একটি উল্লেখযোগ্য জুনোটিক রোগ। গবাদি পশুতে এরোগ নিয়ন্ত্রন করলে মানুষেও এ রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব এ ক্ষেত্রে উপযুক্ত জৈব নিরাপত্তা হাইজিন ও স্যানিটেশন ব্যবস্থা গ্রহণ করলে গবাদিপশুতে এ রোগ নিয়ন্ত্রন করা সম্ভব। টিকা প্রদানের মাধমে এ রোগ নিয়ন্ত্রন করা অপেক্ষাকৃত কম ব্যয় বহুল হলেও বাংলাদেশের গবাদিপশুতে এ রোগের টিকা প্রদান করা হয় না। দেশের গবাদিপশুতে বিদ্যমান ব্যাকটিরিয়া হতে টিকা উদ্ভাবন করে নিরাপত্তা ল্যাবরেটরি এ্যানিমেলে ফিল্ড ট্রায়ালে টিকার কার্যকারিতা যাচাই করে গবাদি পশুতে ব্যবহার করতে হবে। ব্রæসেলোসিস রোগ প্রতিরোধের জন্য এ রোগ বিস্তারের কারণ অনুসন্ধান, আক্রান্ত পশু থেকে এ রোগের জীবাণু পৃথকীকরণ, চারিত্রিকিকরণ, সঠিক রোগ নির্ণয় পদ্ধতি এবং কার্যকরী টিকা উদ্ভাবন করতে আরও গবেষনা কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। দুগ্ধ খামারী ও ভেটেরিনারিয়ানদের মধ্যে সহযোগীতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে।দেশের গবাদিপশুতে বিদ্যমান ব্যাকটিরিয়ার জীবন রহস্য উন্মোচনের ফলে টিকা উদ্ভাবন ও উন্নয়ন করা সহজ হবে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।