ডাবলু ক্লাস সেভেনে পড়ে। বয়সের তুলনায় হঠাৎ বেড়ে উঠেছে বেশী। প্রয়োজনের চেয়ে বেশী লম্বা আর মোটা হবার কারণে তাকে তার প্রেস্টিজ নিয়ে বেশ বেকায়দায় থাকতে হয়। শুধু এই দুঃখে পড়ে সে ক্লাসে সবার পেছনে বসে। শ্রেণীকক্ষে শিক্ষক আসলে মাথাটাকে নিচু করে নিজেকে আড়াল করে। ত্রিশজন ছাত্রের ক্লাসের ভিতর থেকে স্যরের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তাকে ঠিকই খুঁজে বের করে ফেলে।
-এই কুমড়ো দাড়া।
ভারী গলায় আদেশ করলেন পরিমল স্যার। নামটাও সেই স্যরের দেয়া। ডাবলু প্রতিবাদ করতে পারে না। প্রতিবাদ করার কথা তার মনেও হয় না কখনও। মনে মনে ভাবে সে- তার শরীর মোটা আর মুখটা থ্যাবড়ানো কুমড়ার মত হবার কারণে স্যারে হয়তো এমন করে বলে। স্যরের কুমড়া বলা নিয়ে তার কোন সমস্যা নেই। যত গোলমাল তার সহপাঠীদের নিয়ে। ক্লাসের ভিতরে তাকে দেখে সবার মুখে চাপা হাসি ফুটে উঠে। যেন খুব কষ্ট করে মুখটাকে চেপে ধরে রেখেছে। দেখলে রাগে গা জ্বলে যায়। আর রাস্তাঘাটে দেখা হলে তো কথাই নেই। প্রথমে কুমড়া বলে একটু হেসে নেবে, তারপরে অন্য কথা।
ডাবলু শিক্ষকের আদেশ পেয়ে দাড়িয়ে যায়। দাড়িয়ে দাড়িয়ে পড়া বলতে শুরু করে গড়গড় করে। তার মুখস্থ পড়া বলা শুনে ক্লাসের সবাই নাক চেপে খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসি দেয়। হাসির কারণও আছে। ডাবলুর নিজের মতন করে বানিয়ে বানিয়ে পড়া বলা শুনে স্যারও একটু হেসে দেন। কিন্তু পরক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়ে গর্জে উঠেন- এই চুপ। কুমড়োর কুমড়ো। আবারও ছাত্রদের নাকচাপা হাসি।
-কুমড়ো তুই কান ধরে বেঞ্চির উপর দাড়াই থাক। পুরা পঁয়তাল্লিশ মিনিট।
স্যরের আদেশ পেয়ে ডাবলু বেঞ্চির উপরে দাড়িয়ে থাকে নিষ্ঠার সাথে। ঘণ্টা পড়ে গেলেও কান ছাড়ে না। স্যার চলে যাবার আগ পর্যন্ত বেঞ্চি থেকে নামে না ডাবলু। কারণ এইটা পরিমল স্যার। তাকে দেখে বাঘে গরুতে একঘাটে পানি খায়। আজকে বোধকরি স্যরের মনটা খারাপ। চেহারা কেমন মলিন দেখাচ্ছে। অন্যদিন হলে কুমড়োকে চাপকিয়ে মনের ঝাল মেটাতো। ডাবলুর কপাল ভাল। তাই সে বেঁচে যায়। এমনি করে ডাবলু ওরফে কুমড়োর দিনকাল ভালমন্দে মিশিয়ে কেটে যেতে থাকে তরতর করে।
দেশে মহামারী শুরু হয়েছে। ডেঙ্গুর মহামারী। ছেলে বুড়ো সবার চোখে মুখে আতঙ্ক। ঢাকায় বেশী খুলনায় কম। মারাও যাচ্ছে অনেকে। খুলনায় কম হলেও ক্লাসের সব বন্ধুদের কথাবার্তায় ভয়ের চিহ্ন। ডাবলু বাস করে খুলনায়। খুলনা ঢাকা যেখানেই হোক, ডাবলুর এতে কোন ছেদভেদ নেই। তার ফুটবল খেলার মাঠ হলে, কিংবা হাতে একটা বাঁশি থাকলে আর কিছু চাই না। হা একটা কথা এখনও বলা হয়নি। ডাবলু কিন্তু খুব ভাল ফুটবল প্লেয়ার এবং ভাল বাঁশিও সে বাজাতে পারে। প্রত্যেকবার স্কুলের প্যরেন্টস ডেতে সে দুটো পুরষ্কার পায়। একটা দলীয়ভাবে ফুটবলে, আরেকটা বাঁশি বাজিয়ে। ডাবলু স্কুলে আসা ছেড়ে দিতে পারে, কিন্তু বাঁশি আর ফুটবল সে মরে গেলেও ছাড়তে পারবে না। এতটা সাজিয়ে গুছিয়ে সে বন্ধুদের কাউকে এসব বিষয়ে বলতে পারে না, কিন্তু নিজেকে বলে, মনে মনে বলে। তার অনেক বন্ধু- ফুটবল খেলার বন্ধু, তার বাঁশির সুর শোনা ভক্ত বন্ধু। এই তো গত পরশুদিন জন তার বাঁশি শুনে মুগ্ধ চোখে বলেছিল- বড় হয়ে তুই অনেক বিখ্যাত বংশীবাদক হবি, ইন্ডিয়ার চৌরাশিয়ার মতন। চৌরাশিয়া কে ডাবলু চেনে না, তবে জন চেনে। জনের কাছে কোন দিন তার জিজ্ঞেস করা হয়নি। শেষে না জানার জন্যে যদি প্রেস্টিজ পাংচার হয়ে যায়! এমনি তো কুমড়ো নাম নিয়ে সবার সামনে বেঁচে বর্তে থাকতে হচ্ছে। মনে বড় বেশী কষ্ট তার।
প্রায় চার পাঁচ দিন হয়ে গেল ডাবলু ক্লাসে আসে না। তার শেষ বেঞ্চির শূন্য আসনটা কেমন জানি খা খা করে। ক্লাস শুরু হবার আগে সবাই একবার সেদিকে তাকায় আর ভাবে, আজকে বুঝি কুমড়োটা এলো। কিন্তু সে আসে না। এসেম্বলির আগে মাঠে দাড়িয়ে কিসলু, কামাল, রোমিও, সামি, রফিক গোল হয়ে আজকে আলাপ করছিল- ডাবলুকে নাকি দেখা গেছে ওদের বাড়ির পাশের বড় বস্তিতে। সেখানে সে মশার প্রজনন ক্ষেত্রগুলো, আবর্জনার স্তূপ, ছোট ছোট ডোবা নালা পরিষ্কার করছে বস্তির ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের নিয়ে। টেলিভিশনে দেখে সে নাকি এইসব কাজে মেতেছে। ডাবলুর এই গুণটার কথা অনেকেই কমবেশি জানতো। তবে ডাবলুকে জিজ্ঞেস করলে বেমালুম চেপে যেত।
ক্লাসে পরিমল স্যার এইমাত্র এস বসেছেন। তার চেহারাটা বেশ থমথমে। ক্লাসের সবার মন খারাপ আজকে। পরিমল স্যার কিছু একটা বলার জন্যে গলা খাখারি দিলেন।
-এই তুমরা শোন। একটা খারাপ খবর আছে। ডাবলুর ডেঙ্গু হয়েছে। আমি দেখতে গিছিলাম। অবস্থা খুব বেশী ভালও না, আবার খুব বেশী খারাপও না। ক্লাসের পরে তুমরা সবাই দেখতি যাবা। সেখানে যেয়ে কেউ আবার তারে কুমড়ো বলে না। মানুষ অসুস্থ হলে তারে ভালবাসা দিতে হয়। ঠিকাছে?
মিল্লাত বসেছিল সেকেন্ড বেঞ্চিতে। সবাই তাকে গুডবয় বলে। স্যরের দেয়া নাম। পরিমল স্যরের কথা শুনে সে ভেউ ভেউ করে কেঁদে দিলো।
-এই তুই কান্দিস ক্যন?
স্যার এগিয়ে গেলেন তার দিকে।
-স্যার কুমড়ো বাঁচবে তো?
তার মুখে এমন এক পরিবেশে কুমড়ো বলা শুনে ক্লাসের সবাই হোহো করে হেসে দিল।
প্রায় পঁয়ত্রিশ দিন পরে ডাবলু এলো ক্লাসে। তার বাবা তাকে রিকশা করে এগিয়ে দিয়ে গেছেন। প্রথম ক্লাস হাবিব স্যরের। তা শুরু হতে এখনও পনেরো মিনিট বাকী। কি কারণে উনার আসতে একটু দেরী হচ্ছে। ক্লাসের সবাই ঘিরে ধরলো ডাবলুকে। ডাবলুকে চেনা যাচ্ছে না। সেই মোটা তাজা থলথলে শরীরটা নেই। পোশাকের বাইরে থাকা হাড়গুলো দেখা যায়। চোখদুটো কোটরে। মুখটা শুকিয়ে ছোট্ট হয়ে আছে। সবাই তাকে ঘিরে ধরে নানান প্রশ্ন করছে- এই ডাবলু কোন হাসপাতালে ছিলি? ওই ডাবলু রক্ত দেয়া লাগছিল নাকি? ইত্যাদি হাজার প্রশ্ন। ডাবলু এত প্রশ্নের উত্তর দিতে না পেরে রোগে ভোগা ক্ষীণ কণ্ঠে অচেনা সুরে কেঁদে উঠলো। চোখ মুছতে লাগলো ঘনঘন। সবাই একসাথে প্রশ্ন করলো- এই ডাবলু তুই কাঁদছিস কেন? ডাবলু ভাঙ্গা গলায় উত্তর করলো- তোরা আমাকে কুমড়ো বলছিস না কেন? কুমড়ো তো বলবি! কারও মুখে কোন কথা নেই। জন ছিল সবার পিছে। ক্লাসের সবাই তাকে জোকার বলে জানে। সে ভিড় ঠেলে একেবারে ডাবলুর কাছাকাছি এসে বললো- তরে কেউ কুমরা কইবে না রে ডাবলু। তোর গায় সেই মাংস নেই। শুকাই কাঠ হইছস। আমি তর নাম দিলাম লৈট্টা শুটকি। বরফে জমে যাওয়া ক্লাসরুমটা হোহো হাসিতে ফেটে পড়লো। এরই মধ্যে স্যার এসে গেছেন। তবে হাবিব স্যার নয়, পরিমল স্যার। হাবিব স্যরের ক্লাসটা তিনিই নিবেন আজকে।
-এই কী হচ্ছিল এখানে? তবে আমি কারণ কিছুটা বুঝতে পারছি।
সবাই যার যার সিটে গিয়ে বসলো। গলা খাখারী দিয়ে কথা বলা শুরু করলেন স্যার।
-তুমরা শোন, কুমড়ো মরতে মরতে বেঁচে গেছে। আবার আমাদের মাঝখানে ফিরে এসেছে। সে আমাদের গর্ব। এই মহামারীর সময় সে অনেক কাজ করেছে মানুষের জন্যে। তুমরা খবর রাখোনি। তুমরা কুমড়োর মতন হবা। একসাথে বলো- আমরা সবাই কুমড়ো। পুরো ক্লাসের সবগুলো কণ্ঠ একসাথে গর্জে উঠলো শ্রেণীকক্ষ কাঁপিয়ে, স্কুল বিল্ডিংটাকে কাঁপিয়ে, খেলার মাঠটাকে কাঁপিয়ে- আমরা সবাই কুমড়ো, আমরা সবাই কুমড়ো, রা রা রা।