অ্যাডাম স্মিথ অষ্টাদশ শতকের একজন স্কটিশ দার্শনিক ও পণ্ডিত। স্কটল্যান্ডের কার্কক্যাল্ডিতে ১৭২৩ সালে তিনি জন্ম নেন। বাবার নামেই তার নাম রাখা হয়েছিল অ্যাডাম স্মিথ। পুত্রের জন্মের ৬ মাস আগে পিতার মৃত্যু হয়। তার পর তার মা-ই তাকে বড় করেন, লেখাপড়া শেখান। প্রাথমিক বিদ্যাশিক্ষার পর প্রথমে তিনি গ্লাসগো ও পরে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেন। অক্সফোর্ড থেকে ফিরে আসেন গ্লাসগোতে, ১৭৫১ থেকে ১৭৬৪ সাল পর্যন্ত সেখানে নৈতিক দর্শনশাস্ত্রের অধ্যাপক ছিলেন। ১৭৭৬ সালে অ্যাডাম স্মিথের কালজয়ী গ্রন্থ, ‘ওয়েল্থ অফ ন্যাশন্স’ প্রকাশিত হয়। ওই সময় থেকে এই বই আধুনিক পলিটিক্যাল ইকোনোমির প্রথম কিতাব হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে।
এখানে তিনি মুক্তবাজার অর্থশাস্ত্রের মূল তত্ত্বকথাগুলো একটার সাথে আরেকটার সামঞ্জস্য রেখে সুশৃঙ্খল সমন্নয়ের মাধ্যমে প্রণালীবদ্ধভাবে বোঝার মতন করে সর্বপ্রথম ‘ওয়েল্থ অফ ন্যাশন্স্’-এর মাধ্যমে সুধী সমাজের সামনে তুলে করেন। তার দেয়া তত্ত্ব আড়াই শ’ বছর আগে যেমন প্রাসঙ্গিক এখনো তেমনই আছে। আর তাই তাকে আধুনিক অর্থশাস্ত্রের জনক বলা হয়ে থাকে।
জ্ঞানচর্চা, গবেষণা ও লেখালেখিজীবনের একপর্যায়ে তিনি ইংল্যান্ড থেকে ফ্রান্সে চলে যান। সেখান থেকে আবার ফিরে আসনে গ্লাসগোতে। প্রথম জীবনে তার টাকা পয়সার টানাটানি ছিল। শেষ বয়সে বই বিক্রির আয় থেকে তিনি প্রচুর অর্থবিত্তের মালিক হন এবং মাকে নিয়ে তৎকালীন গ্লাসগোর অভিজাত আবাসিক এলাকা ‘ক্যানন গ্যাট’-এ স্বচ্ছল জীবনযাপন শুরু করেন। মা মারা যাওয়ার কয়েক বছর পর, ১৭৯০ সালে অ্যাডাম স্মিথের জীবনাবসান হয়। মৃত্যুর সময় তিনি নিজ সম্পদের প্রায় সবই গরিবের কল্যাণে দান করে যান এবং তার সৃষ্ট নতুন নতুন ধারণা, দর্শন ও জ্ঞানভা-ার রেখে যান চিন্তাশীল মানুষদের জন্য।
১. ‘ওয়েল্থ অফ ন্যাশন্স’-এর আগে প্রকাশিত হয় স্মিথের প্রথম সাড়া জাগানো বই ‘দি থিওরি অফ মোর্যাল সেন্টিমেন্টস্’। এই বইয়ে তিনি একটা চমৎকার নৈতিক ধারণা টেনে এনেছেন। ক্রেতা-বিক্রেতারা যাবতীয় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও লেনদেনের সময় মনে করে একজন অদৃশ্য কাল্পনিক দর্শক আছেন। তিনি যাবতীয় ব্যবসাবাণিজ্য এবং অর্থনৈতিক লেনদেন সার্বক্ষণিকভাবে পর্যবেক্ষণ করেন। তিনি সব খবর রাখেন। তিনি ন্যায় বিচারক এবং নিঃস্বার্থ। এর ওপর সকল প্রকার লেনদেনের ক্ষেত্রে তিনি বিশেষ করে গরিব ও দূর্বল পক্ষের প্রতি সহনুভূতিশীল এবং দরদি (সিম্পেথেটিক টু দ্যা উইক অ্যান্ড পুওর)। অ্যাডাম স্মিথ এ রকম একজন দর্শকের কল্পনা করেছেন। আসলে কি তিনি কাল্পনিক? না, তিনি কাল্পনিক নন। তিনি বাস্তব, তিনি চিরঞ্জীব, চির জাগ্রত, তিনি পবিত্র, তিনি সর্বজ্ঞানী এবং সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। ব্যবসা-বাণিজ্যে এবং অর্থনৈতিক লেনদেনে অংশগ্রহণকারী ক্রেতা-বিক্রেতারা স্মিথের কথামতো যদি সার্বক্ষণিক এই দর্শকের কথা মনে রাখে, তাহলে অসদাচরণ ও দুর্নীতি কমে মানুষের দুর্ভোগ দূর হয় এবং দেশ ও সমাজ উপকৃত হয়।
২. স্মিথের দ্বিতীয় বই ‘ওয়েল্থ অফ ন্যাশন্স’-এর কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করছে আধুনিক মুক্তবাজার অর্থনীতির মূল কথা। স্মিথ বলছেন, মুক্তবাজার ব্যবস্থার মধ্যে এমন এক অন্তর্নিহিত শক্তি আছে যা কিনা নিজ থেকে আপনা আপনি পণ্য উৎপাদন বৃদ্ধি এবং সাথে সাথে তার মূল্য কমিয়ে রাখার নিশ্চয়তা দেয়। এ ভাবে বাইরের হস্তক্ষেপ ছাড়া সফল এবং কার্যকর ভাবে বাজার নিজেকেই নিজে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। ব্যাপারটা উদাহরণ দিয়ে তিনি এ ভাবে বোঝাবার চেষ্টা করেছেন। কোনো কারণে যদি বাজারে কোনো পণ্যের ঘাটতি দেখা দেয়, তা হলে তার দাম বাড়বে। দাম বাড়লে বিক্রেতাদের মুনাফা বেড়ে যাবে। বাড়তি মুনাফার লোভে মুক্তবাজারে নতুন নতুন উদ্যোক্তারা অঅসবে এবং পণ্য উৎপাদন বাড়বে। উৎপাদন বাড়ার সাথে সাথে বাজারে সরবরাহ বৃদ্ধি পাবে। এবং যেই সরবরাহ বাড়বে, আস্তে আস্তে দাম নামতে থাকবে। এবং দ্রব্যমূল্য তার স্বাভাবিক জায়গায় আসার আগ পর্যন্ত এ প্রক্রিয়া চলতে থাকবে।
ঠিক উল্টোভাবে, কোনো কারণে যদি বাজারে কোনো পণ্যের সয়লাব দেখা দেয় তা হলে তার দাম কমে যাবে। দাম কমলে প্রথম দিকে বিক্রেতাদের মুনাফা কমবে এবং অবশেষে তারা লোকসান গুনতে বাধ্য হবে। বেশি দিন লোকসান চলতে থাকলে বাজার থেকে উদ্যোক্তা ও উৎপাদনকারীরা নিজেদেরকে গুটিয়ে নেবে। বাজারে পণ্যের উৎপাদন ও সরবরাহ কমে যাবে। সরবরাহ কমার সাথে সাথে বাড়তে থাকবে, এবং দাম তার স্বাভাবিক জায়গায় আসার আগ পর্যন্ত এ প্রক্রিয়াও অব্যাহত থাকবে। স্মিথ বাজারের এই অন্তর্নিহিত ব্যবস্থার নাম দিয়েছেন, ‘ইনভিজিবল হ্যান্ড’ বা ‘অদৃশ্য শক্তি’। অর্থাৎ কোনো সময় কোনো কারণে বাজারে অস্বাভাবিক অবস্থা দেখা দিলে ‘ইনভিজিবল হ্যান্ড’ নিজ গুণে ও শক্তিতে এটাকে মেরামত করে সঠিক স্থানে নিয়ে আসবে।
৩. এই বইয়ে স্মিথ প্রথমে মার্কেন্টাইলিস্ট এবং ফিজিওক্রেটদের ভুল ধরিয়ে দেন। স্মিথের আগে মার্কেন্টাইলিস্টরা, সাধারণ জনগণ ও ভোক্তাদের চেয়ে উদ্যোক্তা এবং উৎপাদকদের স্বার্থকে অনেক বড় করে দেখতেন। তাদের মতে, উৎপাদকরা পণ্য উৎপাদন করে রফতানির মাধ্যমে দেশে সোনা-দানা ও টাকা-পয়সা মজুদ করে এবং দেশের সম্পদ বাড়ায়। অন্য দিকে ভোক্তারা কোনো কিছু সৃষ্টি না করে সব খেয়ে দেয়ে অথবা খরচ করে ধ্বংস করে ফেলে। স্মিথ তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে বুঝিয়ে দেন, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের আসল সোনা-দানার পাহাড় গড়ে তোলা নয়, বরং তার মূল লক্ষ্য উৎপাদিত পণ্যের সুষম বন্টন এবং ব্যবহারের মাধ্যমে মানুষের প্রকৃত কল্যাণ নিশ্চিত করা। সাধারণ জনগণ ও ভোক্তারা তাদের চাহিদা দিয়ে উৎপাদনকে উৎসাহিত করে বলেই পণ্য উৎপাদন বৃদ্ধি পায় এবং মানুষের ব্যবহারের মাধ্যমে দেশ ও জাতির কল্যাণ উত্তরোত্তর বাড়তে থাকে। সুতরাং উৎপাদকদের চেয়ে সাধারণ জনগণ এবং ভোক্তারাই বড়।
স্মিথ যে এ-কথা একেবারে নতুন বলেছেন তাও ঠিক নয়। স্মিথ হয়তোবা জানতেন না যে অনেক অনেক আগে ধার্মিক লোকেরা প্রাচীন কিংবদন্তিতুল্য ধনকুবের ও কৃপণ কারুনের মতো টাকা-পয়সা এবং সোনা-দানা জড়ো করে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলাকে সরাসরি নাকচ করে গেছেন এবং পণ্যের উৎপাদন, সুষম বন্টন, ব্যবহার ও দান-খয়রাতের মাধ্যমে মানুষের ও সমাজের কল্যাণ বৃদ্ধি করার ব্যাপারে যথেষ্ট জোর দিয়েছেন।
মার্কেন্টাইলিস্টদের আরেকটা ভুল ধারণা ছিল যে, যে সব দেশ সোনা-দানার বিনিময়ে পণ্য রফতানি করে তারা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য থেকে লাভবান হয় আর যারা পণ্য আমদানি করে তারা মূল্যবান ধনরত্ন হারিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। রফতানিকারকদের লাভ আমদানিকারকদের ক্ষতির সমান, তাই আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে নিট লাভ শূন্য। স্মিথ প্রমাণ করলেন, সোনা-দানা জড়ো করাই একটা দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির মাপকাঠি নয়। তিনি বললেন, মুক্তবাণিজ্যে আমদানি এবং রফতানিকারক দু’দেশই উপকৃত হয়। তিনি আরো বললেন, সোনা-দানা সংগ্রহ করার উদ্দেশ্যে যখন রাষ্ট্র ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে যোগসাজস তৈরি হয়, তখন সাধারণ জনগণের স্বার্থ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিষয়টি যে আজকের জন্য সত্য, তা আর কেউ না হলেও ইদানীংকালে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। তিনি আরো বলেন, একটা জাতির সবচেয়ে বড় সম্পদ তার সোনা-রুপা, জমি, পুঁজি ইত্যাদি নয়, বরং শ্রমিকের সৃষ্টিশীলতা ও উৎপাদন ক্ষমতাই হলো জাতির সবচেয়ে বড় সম্পদ।
৪. স্মিথের আরেকটি অতি মূল্যবান কথা হলো, তৃণমূল পর্যায়ে উৎপাদন ও লেন-দেনের ব্যবস্থা সঠিক ও সফলভাবে কাজ করার জন্য উপর থেকে কোনো ধরনের আগাম পরিকল্পনা চাপিয়ে দেয়ার দরকার পড়ে না। যেটা পরবর্তী পর্যায়ে সমাজতান্ত্রিক দেশে খুব একটা সার্থক প্রমাণিত হয়নি। তার মতে, ক্রেতা-বিক্রেতাকে বাইরের হস্তক্ষেপ ছাড়া মুক্ত বাজারে ছেড়ে দিলে, তারা নিজেরাই স্বভাবিক ভাবেই উৎপাদন, বন্টন ও লেন-দেন কাজ সমাধা করতে পারে।
৫. এখানে একটা কথা পরিষ্কারভাবে মনে রাখা দরকার – মজুতদারী, একচেটিয়া ব্যবসা ও অসৎ উপায়ে সিন্ডিকেট অথবা অন্য কোনো কারসাজির মাধ্যমে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা স্মিথের ‘ইনভিজিবল হ্যান্ড’ ও সকল প্রকার সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় আইনের পরিপন্থী। সংক্ষেপে মোটামুটিভাবে স্মিথের অর্থনৈতিক তত্ত্ব এ রূপ। স্মিথের ‘ইনভিজিবল হ্যান্ড’-এর ধারণাও যে একেবারে নতুন ও ষোল আনা তাঁর নিজস্ব তাও নয়। স্মিথেরও অনেক আগে কোনো কোনো সমাজ চিন্তক স্মিথের মতো বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করতে না পারলেও সাধারণভাবে বলে গেছেন, বাজারে জিনিসের দাম প্রাকৃতিক ও স্বাভাবিক নিয়মেই স্থির হয়ে থাকে এবং এখানে কারো কিছু করার নেই। এখানে আবারো বলছি, এটা সাধারণভাবে সঠিক, যদি বাজারব্যবস্থায় মজুতদারী, মাস্তানী, সরকারি সহযোগিতা অথবা অন্য কোনো ছলচাতুরির মাধ্যমে উন্মুক্ত প্রতিযোগিতা ও সরবরাহকে নিয়ন্ত্রণ করার কোনো সুযোগ না থাকে।
বাজার যদি বাইরের হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত থাকে, প্রতিযোগিতা থাকে অবাদ এবং ক্রেতা-বিক্রেতার সংখ্যা থাকে অনেক, তাহলে বাজারে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী কোনো প্রভাব ফেলতে পারে না এবং দরদাম স্বাভাবিক থাকে – অতিরিক্ত বাড়েও না আবার কমেও না। বিক্রেতারা লোকসান গুনে না আবার অতিরিক্ত মুনাফাও কামাই করতে পারে না। ক্রেতা/ভোক্তারা চাহিদা মতো জিনিস পায়। তবে সরকারি আনুকুল্যে অথবা অন্য কোনো কৃত্রিম কিংবা অসৎ উপায়ে বাজারে যদি কেউ একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তার করে তবে স্মিথের মুক্তবাজার অর্থনীতি সঠিকভাবে কাজ করে না এবং তা নিঃসন্দেহে একটি গর্হিত সামাজিক অপরাধ এবং রাষ্ট্রকে সেটা তাৎক্ষণিকভাবে শক্ত হাতে দমন করতে হয়। স্মিথ সব সময় একচেটিয়া ব্যবসায়ী বা মনোপলিস্টদের থেকে সাবধান থাকতে বলেছেন।