স্টোকস কী এমন টেস্ট ম্যাচের স্মৃতি কখনো ভুলবেন?

এ যেন ২০১৯ বিশ্বকাপের প্রতিচ্ছবি। দল যখন নিশ্চিত হারের মুখে সেখানে লাড়াই করে একাই দলকে জয়ের পথ দেখালেন বেন স্টোকস। অবিশ্বাস্য এক টেস্ট ম্যাচ দেখলো বিশ্ব ক্রিকেট। শেষ (দশম) উইকেটে ৭৬ রানের জুটিতে অ্যাশেজ সিরিজে তৃতীয় টেস্টে এক উইকেটেরে ঐতিহাসিক পেলো ইংল্যান্ড। স্টোকস খেললেন ১৩৫ রানের অপরাজিত এক দুর্দান্ত ইনিংস। আর এ জয়ে সিরিজে সমতায় ফিরলো ইংলিশরা।

১৮৮৮ সালে লর্ডস টেস্ট আর সেটিও ছিল এবারের মতো অ্যাশেজ সিরিজ। তারই প্রথম টেস্টে নিজেদের দ্বিতীয় ইনিংসে ৬০ রানে অল আউট হয়েছিল অস্ট্রেলিয়া। আর প্রথম ইনিংসে ১১৬ রান তুলেছিল পার্সি ম্যাকডনেল-অ্যালেক বানারম্যানের অস্ট্রেলিয়া। দুই ইনিংসে এত কম সংগ্রহ নিয়েও অস্ট্রেলিয়া কিন্তু ম্যাচটা জিতেছিল!

চার্লি টার্নার ও জে জে ফেরিসের তোপে ইংল্যান্ড প্রথম ইনিংসে তুলেছিল ৫৩ আর দ্বিতীয় ইনিংসে ৬২। প্রায় দেড় শতাব্দী আগের সে ম্যাচের প্রসঙ্গ এখন উঠে আসার কারণ দ্বিতীয় ইনিংসে ইংল্যান্ডের দৃঢ়তা আর প্রথম ইনিংসে ন্যূনতম ৭০ রানের নিচে অল আউট হওয়া। টেস্ট ম্যাচে এক ইনিংসে ৭০ রানের নিচে অলআউট হয়েও কোনো দলের জয়ের সেটাই সবশেষ নজির ছিল। ১৩১ বছর পর এবার অস্ট্রেরিয়াকে হারিয়ে সে রেকর্ড গড়ল ইংলিশরা।

টেস্ট ইতিহাসে প্রথমবারের মতো চতুর্থ ইনিংসে সাড়ে তিনশোর বেশি রান তাড়া করে জিতল ইংল্যান্ড। অ্যাশেজ ইতিহাসে মাত্র দ্বিতীয়বার এবং টেস্ট ইতিহাসে ১১তম বারের মতো সাড়ে তিনশ রানের বেশি তাড়া করে জেতার নজির দেখল ক্রিকেট বিশ্ব।

৩৫৯ রানের জয়ের লক্ষ্যে তৃতীয় দিন শেষে ইংল্যান্ড করেছিলো ৩ উইকেটে ১৫৬ রান। ফলে চতুর্থ দিনে জয়ের জন্য ইংলিশদের প্রয়োজন ছিলো ২০৩ রান। হাতে সাত উইকেট। দিনের শুরুর দিকেই ফিরে যান জো রুট। বড় স্কোরের আশা দেখিয়েও মাত্র ৭৭ রানে নাথান লিওনের স্পিনে কাবু হন তিনি। ৩৬ রানে ফেরেন জনি বেয়ারস্টো।

জস বাটলার ও ক্রিস ওকস দুজনই মাত্র এক রান করে ফিরে যান। দলকে ফেলে যান অথৈ সাগরে। এক প্রান্তে স্টোকস একাই লড়তে থাকেন এই ঝড়ের বিপক্ষে। জোফরা আর্চার ১৫ রান করলেও ব্রড রানের খাতা না খুলেই ফিরে যান।

২৮৬ রানের মাথায় নবম উইকেট পতনের পর অস্ট্রেলিয়ার জয়টা মনে হচ্ছিলো সময়ের ব্যাপার মাত্র। কিন্তু বেন্ স্টোকস নাছোড় বান্দা। বিশ্বকাপের মতোই কারিশমা দেখালেন একাই।  শেষ উইকেটে দলের প্রয়োজন ৭৩ রান। সেখানে শেষ ব্যাটসম্যান জ্যাক লিচকে নিয়ে মাত্র ৬২ বলে যোগ করলেন ৭৬ রান। দশম উইকেট জুটিতে আসা ৭৬ রানের মধ্যে ৭৪ রান একাই করেছেন স্টোকস। দলের জয়ের জন্য যখন প্রয়োজন মাত্র ২ রান, তখন সিঙ্গেল নিয়ে স্কোর সমান করার পাশাপাশি নিজের রানের খাতা খোলেন লিচ। সে ওভারেই এক্সট্রা কভার দিয়ে চার মেরে অবিশ্বাস্য জয়টি নিশ্চিত করেন স্টোকস।

২১৯ বলে ১১ চার ও ৮ ছক্কায় ১৩৫ রানে অপরাজিত থাকেন স্টোকস।

দ্বিতীয় ইনিংসে অস্ট্রেলিয় বোলারদের মধ্যে জস হেজেলউড ৪টি, নাথান লায়ন ২টি, পেট কামিন্স ও জেমস প্যাটিনসন একটি করে উইকেট শিকার করেন।

অস্ট্রেলিয়ার দ্বিতীয় ইনিংস…

অস্ট্রেলিয়াকে প্রথম ইনিংসে মাত্র ১৭৯ রানে গুটিয়ে দিয়েছিল ইংল্যান্ড। কিন্তু জবাব দিতে নেমে চরম লজ্জার মুখে পড়লো বর্তমান ওয়ানডে বিশ্ব-চ্যাম্পিয়নরা। মাত্র ৬৭ রানেই গুটিয়ে যায় তাদের প্রথম ইনিংস।

দ্বিতীয় ইনিংসেও যে অস্ট্রেলিয়া খুব ভালো ব্যাটিং করেছে এমন নয়। তবে প্রথম ইনিংসের বড় লিডের সুবাদে ঠিকই ইংল্যান্ডকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে টিম পেইনের দল। জিততে হলে নিজেদের দ্বিতীয় ইনিংসে ৩৫৯ রানের বড় সংগ্রহ তাড়া করতে হবে জো রুট বাহিনীকে।

প্রথম ইনিংসের মতো দ্বিতীয় ইনিংসেও অস্ট্রেলিয়াকে বড় বিপদ থেকে বাঁচিয়েছেন স্মিথের বদলি হিসেবে সুযোগ পাওয়া মার্নাস লাবুশচানে। প্রথম ইনিংসে করেছিলেন ৭৪, দ্বিতীয়বার নেমে ৮০ রান করে রানআউটের কবলে পড়েছেন এই ব্যাটসম্যান। বাকিদের কেউ হাফসেঞ্চুরিও করতে পারেননি। ম্যাথু ওয়েড ৩৩ আর ট্রাভিস হেড করেন ২৫ রান।

ইংল্যান্ডের পক্ষে ৩টি উইকেট নিয়েছেন বেন স্টোকস। ২টি করে উইকেট শিকার জোফরা আর্চার আর স্টুয়ার্ড ব্রডের।

ইংল্যান্ডের প্রথম ইনিংস…

দ্বিতীয় টেস্টে বাক-বিতণ্ডে অ্যাশেজের তৃতীয় টেস্ট হয়ে উঠে উত্তপ্ত। স্মিথকে নিয়ে তোপের মুখে থাকা জোফরা আর্চার হয়ে ওঠেন আরো অগ্রাসী। তার বোলিং তোপেই হেডেংলিতে প্রমম ইনিংসে ১৭৯ রানে গুটিয়ে যায় অস্ট্রেলিয়া।

কিন্তু ইংলিশ অ্যাকশনের পাল্ট জবাব দিতে দেরি করেনি অজিরাও। জস হেজেলউড, পেট কামিন্স ও প্যাটিনসনের আগুনঝরা বোলিংয়ে ২৭.৫ ওভারে ৬৭ রানেই প্রথম ইনিংসে অল আউট হয়ে যায় ইংল্যান্ড।

অজিদের বোলিং দেখে মনে হলো, আর্চার-ব্রড-ওকসরা যদি হয় ‘সের’। হেজেলউড, কামিন্স, প্যাটিনসনরা ‘সোয়া সের’!

প্রথম ইনিংসে একমাত্র জো ডেনলি (১২ রান) ছাড়া আর কোনো ইংলিশ ব্যাটসম্যান দুই অঙ্কের ফিগারে পৌঁছাতে দেননি অস্ট্রেলিয় বোলাররা।

অজি বোলারদের মধ্যে হেজেলউড ৫টি, কামিন্স ৩টি ও প্যাটিনসন ২টি উইকেট শিকার করেন।

অস্ট্রেলিয়ার প্রথম ইনিংস…

ইংল্যান্ডের ডান-হাতি পেসার জোফরা আর্চারের আগুন ঝড়ানো বোলিং-এ অ্যাশেজ সিরিজের তৃতীয় টেস্টের প্রথম দিনই ১৭৯ রানে অলআউট হয়েছে সফরকারী অস্ট্রেলিয়া। ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় টেস্ট খেলতে নেমে বল হাতে ১৭ দশমিক ১ ওভার বল করে ৪৫ রানে ৬ উইকেট নেন আর্চার। লর্ডসে গত ম্যাচ দিয়ে টেস্ট অভিষেক হয়েছিলো আর্চারের।

লিডসে বৃষ্টিবিঘ্নিত সিরিজের তৃতীয় টেস্টে টস জিতে প্রথমে ফিল্ডিং বেছে নেয় ইংল্যান্ড। ব্যাট হাতে নেমে ২৫ রানের মধ্যে ২ উইকেট হারিয়ে বসে অস্ট্রেলিয়া। ওপেনার ক্রিস হ্যারিস ও তিন নম্বরে নামা উসমান খাজা ৮ রান করে ফিরেন। হ্যারিসকে শিকার করেন আর্চার। আর খাজাকে আউট করেন ব্রড।

শুরুতে ২ উইকেট হারানোর ক্ষত দ্রুতই ভুলিয়ে দেন আরেক ওপেনার ডেভিড ওয়ার্নার ও মার্নাস লাবুশেন। রানের ক্ষুধায় থাকা ডেভিড ওয়ার্নারের সাথে ১১১ রানের জুটি গড়েন লাবুশেন। ৭টি চারে ৬১ রান করা ওয়ার্নারকে তুলে নিয়ে এই জুটিতে ভাঙ্গন ধরান আর্চার। ফলে ১৩৬ রানে তৃতীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে আউট হন ওয়ার্নার।

এরপর অস্ট্রেলিয়ার মিডল-অর্ডারে তিন ব্যাটসম্যান ট্রাভিস হেড-ম্যাথু ওয়েড-টিম পাইনকে দ্রুত তুলে নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার চাপ বাড়িয়ে দেন ব্রড-আর্চার-ওকস। হেড-ওয়েড শুন্য রানে ও পাইন ১১ রান করে ফিরেন। ফলে দ্রুতই গুটিয়ে যাবার শংকায় পড়ে অস্ট্রেলিয়া। আর সেই কাজটি করে ফেলেন আর্চার। অস্ট্রেলিয়ার শেষ তিন ব্যাটসম্যানকে বিদায় দিয়ে প্রতিপক্ষকে ১৭৯ রানে গুটিয়ে দেন আর্চার। মাঝে লাবুশেনকে ৭৪ রানে শিকার করে আর্চারের কাজটি সহজ করে দেন বেন স্টোকস। ১০টি চারে ১২৯ বলে নিজের ইনিংসটি সাজান লাবুশানে।

Share this post

scroll to top