শরতের প্রথম দিন। দুপুর গড়িয়ে বিকেল। থেমে থেমে হচ্ছিল বৃষ্টি। আকাশের কান্না কিছুটা থামল। নীল রঙ মাখানো শরতের আকাশে তখনো কালোর ছোপ। বইছে অল্প অল্প হাওয়া। সে হাওয়া ছোট ছোট ঢেউ তুলেছে হাওরের বুকে। যেন হাওরজুড়ে ছন্দের দুলুনি। এই দুলুনির মধ্যেই পানি কেটে কেটে ছুটে চললো ইঞ্জিনচালিত নৌকা। নৌকার ছাদে বসা জাপানি পর্যটক তমোকাজু তাকাহাসি, বেলজিয়ামের পর্যটক মেরি মেরেন, কানাডার পর্যটক শন মাফতি। তাদের ‘দিল্লির আখড়া’ দেখাতে নিয়ে এসেছেন বাংলাদেশের ট্যুর পরিচালনা প্রতিষ্ঠান ‘তাবু ট্যুর’-এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জাফর হায়দার তুহিন। পর্যটকদের সাথে এ প্রতিবেদকও।
মিঠামইন হাওরের বিচ্ছিন্ন গ্রামগুলো ঘেঁষে নৌকা এগিয়ে চলছে। যাওয়ার পথে চোখে পড়ল পানির নিচ থেকে জেগে ওঠা ছোট ছোট করচের বন, হাঁসের ডিমের মতো সাদা ফল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বরুন গাছ, মিঠা পানিতে শুশুকের লাফ-ঝাঁপ!
দিল্লির আখড়ার উদ্দেশে ছেড়ে আসা নৌকাটি ধুকপুক ধুকপুক শব্দে চলে এসেছে কদমচাল বাজারের কাছে।
বাজারটি মিঠামইন উপজেলার পূর্ব শেষ সীমানা পেরিয়ে। বাজারে পাশ ঘেঁষে একটু উত্তরের দিকে নৌকার নাক ঘুরাতেই সবুজ হাতছনি দিয়ে ডাকল হিজল গাছ। শত শত হিজল গাছ! গাছগুলোর কোনোটা কোমর পর্যন্ত ডুবে আছে পানিতে। একটু ছোট যেগুলো, সেগুলোর শরীরের অর্ধেকটাই ডুবে আছে পানিতে। ছোট গাছগুলো আবার পানিতে গলা ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অনাদিকাল ধরে ইকোসিস্টেম মেনে পানির মধ্যে বেঁচে আছে এই গাছগুলো। এ যেন এক অদ্ভুত এক জলাবন! বনের ভেতর ঢুকতেই দেহ মনে কেমন এক আরামদায়ক শীতলতা স্পর্শ করলো। ঘন হয়ে জন্মানো গাছগুলোর কারণে আলো-আঁধারির এক ধরণের মাদকতাময় খেলা যেন জমে ওঠেছে এখানে। বনের ভেতর চলছে পাখিদের ‘ডুবো খেলা’। ডালে ডালে চড়ে বেড়াচ্ছে নানা প্রজাতির বন্যপ্রাণী। চোখে পড়লো বেশ কয়েকটি কাঠবিড়ালি। হিজলের ফল নিয়ে কাড়াকাড়ি করছে তারা। গুই সাপ সাঁতরিয়ে উঠছে ডালে। বনের ভেতর দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ভোদরের দল। দেখা হলো বনবিড়ালের সাথেও। এসব দেখে বিনোদিত হতে হতে লগি ফেলে আখড়ার দিকে নৌকা এগিয়ে নেয়ার সময় বেশ কয়েকবার গাছের ডালপালার সাথে আটকে যেতে হলো। এই সুযোগে গাছে উঠে বিদেশি পর্যটকদের সাথে তুলে নেয়া হলো ক্লিক ক্লিক সেলফি।
হিজল গাছের ডালপালা হাত দিয়ে সরিয়ে সরিয়ে এক সময় পৌঁছা গেল কাঙ্খিত সেই দিল্লির আখড়ায়!
চার শ’ বছরের পুরনো এই আখড়া সম্পর্কে সুন্দর একটি গল্প আছে। এক সাধক নাকি এখানে এসেছিলেন ধ্যান করতে। তার ধ্যান ভাঙার জন্য কিছু দৈত্য তাকে নানাভাবে বিরক্ত করত। একদিন এই সাধক মহাবিরক্ত হয়ে তার দীক্ষাগুরুর মন্ত্রবলে এই দৈত্যগুলোকে হিজল গাছ বানিয়ে রাখেন। সাধুর বানিয়ে রাখা সেই হিজল গাছগুলোই নাকি এগুলো। হিজল গাছের সারি তিন শ’ একরের পুরো আখড়া এলাকাজুড়েই!
প্রথম যারা আসবেন দেখলে ধারণা হতেই পারে, একসময় এগুলো সত্যি সত্যিই দৈত্য ছিলো! সারা বর্ষায় এগুলো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকে।
জায়গাটির নাম দিল্লির আখড়া কিভাবে হলো? সে আরেক গল্প। দিল্লির সম্রাট জাহাঙ্গীরের লোকজন নাকি একদিন ওই ধ্যানমগ্ন সাধকের পাশ দিয়ে নৌকার বহর নিয়ে নদীপথে যাচ্ছিলেন। এ সময় সোনার মোহর ভর্তি একটি নৌকা পানিতে ডুবে যায়। নৌকার যাত্রীরা মোহর তোলার জন্য নদীপাড়ে আসে। ডুব দিয়ে তারা দু-একটি মোহর তুলেও আনে। কিন্তু সেই মোহরগুলোও চোখের ইশারায় পানিতে ফেলে দেন ওই সাধক। পরে নৌকার যাত্রীদের অনুরোধে তিনি সোনার মোহরগুলো মাছের ঝাঁকের মতো পানির উপর ভাসাতে থাকেন। মোহরগুলো তুলে নেন যাত্রীরা। এই ঘটনা শুনে সম্রাট জাহাঙ্গীর অভিভূত হন। পরে তিন শ’ একর জমি তাম্রলিপির মাধ্যমে সেই সাধুর আখড়ার নামে দান করে দেন। সেই থেকে এটি দিল্লির আখড়া।
হিজলের বন ভেদ করে আখড়ায় পৌঁছতেই দেখা গেল সেই সাধুর স্মৃতি! আখড়ার নির্জনতায় মনে হলো, সত্যি এটি ধ্যান করার মতো চমৎকার একটি স্থান বটে।
আখড়ায় রয়েছে ধর্মশালা, নাটমন্দির, অতিথিশালা, পাকশালা ও বৈষ্ণবদেব থাকার ঘর। বর্তমানে আখড়ায় মোহন্ত নারায়ণ দাসসহ তিনজন বৈষ্ণব আছেন। এখানে আশ্রিত হয়ে আছে ৪০-৫০ জন শ্রমজীবী মানুষ। সবাই নিরামিষভুজি। থাকে একটি যৌথ পরিবারের মতো। রাতে এখানে দর্শনার্থীদের থাকারও ব্যবস্থা আছে। আখড়ার পাশে রয়েছে ঘের দেয়া দুটি পুকুর। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামল। পুকুরের ঘাটলায় বসে বিদেশি পর্যটকদের নিয়ে বসা হলো আড্ডায়। পুকুর দুটির চারপাশে দেশি বিদেশি বিভিন্ন গাছ ও ঝোপ-ঝাড়ের ঠাস বুনন। পাখিরা সন্ধ্যায় ঝাঁকে ঝাঁকে এখানে এসে আশ্রয় নিচ্ছে। পাখির কিচিরমিচির শব্দে আড্ডা আরো জমে উঠলো। এর মধ্যে দেখা গেল দু-একটা বানর এ গাছ থেকে ও গাছে ছোটাছুটি করছে। চোখে পড়ল সাদা বক, কানি বক, মাছরাঙ্গা, টিয়া, বুলবুলি, পানকৌড়ি, ঘুঘু, চিলসহ নানা জাতের পাখি।
এবারের বর্ষায় অন্যবছরের চেয়ে হাওরে পানি তুলনামূলকভাবে বেশি এসেছে। দিল্লির আখড়া দেখতে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসছেন অনেকে। কেউ আসছেন পরিবার স্বজন নিয়ে। কেউবা আবার বন্ধুদের সঙ্গে। বাংলা পঞ্জিকা অনুযায়ি বর্ষাকাল এখন শেষ। তবে হাওরে এখনো টইটম্বুর পানি। পানি রয়েছে পুরো আখড়া এলাকা জুড়েই। জলের মধ্যে ভেসে থাকা সবুজ হিজল গাছ, তার মাঝ দিয়ে নৌকায় করে আখড়া এলাকায় ঘুরে বেড়ানো যায় মাত্র এক থেকে দেড় ঘণ্টায়। চাইলে আরও বেশি সময় কাটানো যায়। হাতে সময় থাকলে একবার আপনিও ঘুরে ঘুরে আসতে পারেন অপূর্ব সুন্দর এই দিল্লির আখড়া থেকে।
যেভাবে যাবেন :
কিশোরগঞ্জে বেশ কয়েকটি রুটে দিল্লির আখড়ায় যাওয়া যায়। তবে সহজ হলো সায়েদাবাদ বা গোলাপবাগ থেকে বাসে অথবা কমলাপুর থেকে ট্রেনে সরাসরি কিশোরগঞ্জ শহরে। স্টেশনে নেমে রিকশায় মিনিট পাঁচেক। এর পর একরামপুর। ওখান থেকে অটো-রিকশায় করে চামড়াঘাট। চামড়াঘাট থেকে নৌকায় উঠতে হবে। এর পর ধুকপুক ধুকপুক করে নৌকা আড়াই থেকে তিন ঘন্টার মধ্যে আপনাকে নিয়ে পৌঁছাবে দিল্লির আখড়ায়। এ সময়টা কাটবে হাওরের ভাসা পানিতেই। খুব সকালে রওনা হলে আপনি চাইলে দিনে দিনে আখড়া ঘুরে জেলা শহরে ফিরতে পারবেন। ফিরতে না পারলেও সমস্যা নেই।
এ পরিস্থিতিতে বৃষ্টি না হলে আখড়া এলাকায় ট্রলারের ছাদেই রাত কাটিয়ে দিতে পারেন। তা ছাড়া আখড়ায় তো থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা আছেই। ইচ্ছে করলে আখড়া থেকে ফিরে এসে মিঠামইন উপজেলার ডাকবাংলোতেও রাত কাটানো যাবে। এরপর ভোরে ভাসমান তাবু নিয়ে ধুকপুক করতে করতে নৌকার নাক ঘুরিয়ে দিতে পারেন জেলা শহরের দিকে।