মুসলিম উম্মাহর সর্ববৃহৎ ধর্মীয় জমায়েতের অন্যতম মাধ্যম পবিত্র হজ। এই ফরজ ইবাদতের মূল আনুষ্ঠানিকতা আজ শনিবার শুরু হয়েছে।
সেলাইবিহীন দুই টুকরা সাদা কাপড় পরিহিত লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসল্লির কণ্ঠে ধ্বনিত হচ্ছে, ‘লাব্বাইক, আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইকা লা শারিকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হামদা ওয়ান নি’মাতা লাকা ওয়াল মুলক, লা শারিকা লাকা (আমি হাজির, হে আল্লাহ আমি হাজির, আপনার কোনো শরিক নেই, সব প্রশংসা ও নিয়ামত শুধু আপনারই, সব সাম্রাজ্যও আপনার, আপনার কোনো শরিক নেই)।
আজ পবিত্র হজ। সৌদি আরবে হিজরি মাস গণনা অনুযায়ী আজ ৯ জিলহজ শনিবার হাজীদের ‘উকুফে আরাফা’ বা আরাফাতের ময়দানে অবস্থানের দিন। বিশ্ব মুসলিমের মহাসম্মিলনের দিন। আজ বিশ্বের ১৬০টির বেশি দেশের ২৫ লাখ হাজীর কণ্ঠে উচ্চারিত ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লা-শারিকালাকা লাব্বাইক’ ধ্বনিতে প্রকম্পিত হবে আকাশ-বাতাস। এক জান্নাতি আবহ তৈরি হবে পুরো ময়দানে। সবার পরনে সাদা দুই খণ্ড বস্ত্র। সবার দীন বেশ। দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ, রহমতপ্রাপ্তি ও নিজের গুনাহ মাফের জন্য আল্লাহ তায়ালার কাছে অশ্রুসিক্ত ফরিয়াদ জানাবেন সমবেত মুসলমানেরা। সব হজযাত্রী ও বিশ্বমুসলিমের জন্য প্রদান করা হবে খুতবা। যাতে থাকবে মুসলিম উম্মাহর জন্য দিকনির্দেশনা। বিশ্বভ্রাতৃত্বের এক অনুপম দৃশ্যেরও অবতারণা হবে আজ এই ময়দানে।
আজ জোহরের নামাজের ওয়াক্তের আগেই বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসা মুসলমানরা সমবেত হবেন মসজিদুল হারাম থেকে প্রায় ২২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ঐতিহাসিক আরাফাতের ময়দানে। ১৪০০ বছর আগে এই ময়দানেই রাসূল সা: লক্ষাধিক সাহাবিকে সামনে রেখে ঐতিহাসিক বিদায়হজের ভাষণ দিয়েছিলেন। এই ময়দানেই ইসলামের পরিপূর্ণতার ঘোষণা দিয়ে কুরআনের আয়াত নাজিল হয়েছিল।
আরাফাতের ময়দান হেরেম এলাকার বাইরে কাবা শরিফ থেকে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে অবস্থিত। এই ময়দান প্রায় সাড়ে ১০ কিলোমিটার বিস্তৃত।
হাজীরা আজ আরাফাতের বিশাল প্রান্তরে অবস্থান করে মসজিদে নামিরাহ থেকে প্রদত্ত খুতবা শুনবেন এবং একসাথে জোহর ও আসরের নামাজ একই ইমামের পেছনে জোহরের ওয়াক্তে আদায় করবেন। সূর্যাস্তের পর ময়দান ত্যাগ করবেন।
৮ জিলহজ থেকে টানা পাঁচ দিন ধরে হজের আরো অনেক করণীয় থাকলেও আজ ৯ জিলহজ আরাফাতের ময়দানে অবস্থানের দিনকেই হজের দিন বলা হয়। হজের কার্যাদি আনুষ্ঠানিকভাবে পালন শুরু হয়েছে গতকাল ৮ জিলহজ শুক্রবার মিনার তাঁবুতে অবস্থানের মধ্য দিয়ে। ভিড় এড়াতে অনেক হাজী আগের দিন বৃহস্পতিবার রাত থেকেই মিনায় যাওয়া শুরু করেন। মিনায় হাজীদের জন্য তিন লাখ ৫০ হাজার শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত তাঁবু স্থাপন করা হয়েছে। পুরুষ ও মহিলাদের থাকার জন্য আলাদা তাঁবু রাখা হয়েছে। গতকাল মিনায় তালবিয়া, জিকির, নফল নামাজ, হজের মাসলা-মাসায়েল আলোচনার মধ্য দিয়ে সময় অতিবাহিত করেন হাজীরা। আজ ফজরের নামাজের পর সূর্যোদয়ের পর থেকে আরাফাতের ময়দানের উদ্দেশে হাজীদের রওনা হওয়ার নিয়ম। তবে ভিড় এড়াতে অনেকে গত রাতেই আরাফাতের উদ্দেশে রওনা হন এবং সেখানে গিয়ে অস্থায়ী তাঁবুতে অবস্থান নেয়া শুরু করেন। বাসে, পায়ে হেঁটে হাজীরা সেখানে পৌঁছান। বাকিরা আজ সকালে মিনা থেকে সরাসরি আরাফাতের ময়দানে চলে যাবেন। সূর্য পশ্চিমাকাশে হেলে পড়ার পর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্তÍ আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করা হজের অন্যতম ফরজ। কেউ এই সময়ের মধ্যে এই ময়দানে অবস্থান করতে না পারলে হজ আদায় হবে না।
এই ময়দানে জোহরের সময় পর পর জোহর ও আসরের নামাজ জামাতের সাথে আদায় করবেন হাজীরা। মুসাফির হওয়ার কারণে নামাজ কসর করবেন (চার রাকাতের স্থলে দুই রাকাত)। নামাজের আগেই মসজিদে নামিরাহ থেকে খুতবা দেবেন নির্ধারিত খতিব। এর আগে পরে হজযাত্রীদের কণ্ঠে উচ্চারিত ‘লাব্বাইক’ ধ্বনিতে মুখরিত হবে পুরো ময়দান। আমির-ফকির, ধনী-গরিব, সাদা-কালোর ভেদাভেদ থাকবে না সেখানে। সবার পরনে একই ধরনের সেলাইবিহীন কাপড়, আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্বের ঘোষণা, আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ এবং তারই কাছে গুনাহ মাফ ও রহমত প্রাপ্তির আকুতি।
সূর্যাস্তের সাথে সাথেই আবার মিনায় ফেরার পথে মুজদালিফা নামক স্থানে রাতে অবস্থান নেবেন হাজীরা। ওই স্থানে রাতে অবস্থান করবেন খোলা আকাশের নিচে। সেখানে মাগরিব ও এশার নামাজ এক সাথে আদায় করবেন। মিনায় জামারাতে শয়তানের প্রতিকৃতিতে নিক্ষেপের জন্য এখান থেকেই কঙ্কর সংগ্রহ করবেন তারা। রাতে সেখানে অবস্থানের পর কাল ১০ জিলহজ রোববার ফজরের নামাজ শেষে সূর্যাস্তের আগেই মিনার দিকে রওনা হবেন।
কাল ১১ আগস্ট রোববার সৌদি আরবে ঈদুল আজহা উদযাপিত হবে। মিনায় গিয়ে জামারাতে রোববার বড় শয়তানকে কঙ্কর নিক্ষেপ এবং কোরবানি করবেন। মিনায় কোরবানি করার পর হাজীরা মাথা মুণ্ডন করে অথবা চুল ছোট করে ইহরাম ভেঙে ফেলবেন। এরপর তাওয়াফে জিয়ারাহ করার জন্য মক্কায় যাবেন। সেখানে হেরেম শরিফ সংলগ্ন সাফা-মারওয়া নামক পাহাড়দ্বয়ের মধ্যে দৌড়াবেন (সায়ি করবেন)। জিলহজের ১১, ১২ তারিখ মিনার তাঁবুতে অবস্থান করেই জামারাতে কঙ্কর নিক্ষেপ করার নিয়ম। ১২ জিলহজ হজের আনুষ্ঠানিক কার্যাদির সমাপ্তি ঘটবে। কেউ ১২ তারিখ মিনা ত্যাগ না করলে ১৩ তারিখও তাকে জামারাতে কঙ্কর নিক্ষেপ করতে হবে। মিনার তাঁবুতে অবস্থান করেই পাঁচ দিনের হজের কার্যাদি সম্পন্ন করবেন হাজীরা।