সংসারের মাসিক খরচ বাঁচিয়ে গত ১৫ বছর ধরে গাছের চারা বিতরণ করে আসছেন হাটহাজারীর এক বৃক্ষপ্রেমিক। গ্রামে বসবাসকারী অন্য দশজনের মত বাবুল একজন সাধারণ মানুষ। এ সাধারণ মানুষটি এলাকার জন্য করেছেন অসাধারণ চিন্তা। তিনি পরিবেশ রক্ষার জন্য এলাকায় এলাকায় বৃক্ষরোপণ করছেন। অন্যকেও বৃক্ষ রোপণে আগ্রহী করে তুলেছেন।
বর্ষা মৌসুম এলেই নিজে গাছ লাগান এবং স্কুল,কলেজ, মাদরাসা ও বাড়িতে গিয়ে তিনি চারা বিতরণ করে অন্যদেরকেও গাছ লাগাতে উৎসাহ যোগান। শুধু নিজ গ্রাম আর নিজ উপজেলায় নয় নিজ এলাকা ছাড়িয়ে পার্শ্ববর্তী উপজেলা ফটিকছড়িতে গিয়েও তিনি চারা বিতরণ করেছেন। এ জন্য এলাকায় তিনি বৃক্ষ বাবুল নামে পরিচিত।
বাবুল হাটহাজারী উপজেলার ১২নং ছিকনদন্ডী ইউনিয়ন ফতেয়াবাদ গ্রামের মৃত মো. ইসহাক মিয়ার পুত্র। তার পুরো নাম নুরুল হক বাবুল। পেশায় একজন ব্যবসায়ী। বাড়ির পাশে ফতেয়াবাদে রয়েছে একটি রয়েছে একটি ছোট খাট আসবাব পত্রের দোকান। ছোট বেলা থেকেই ছওয়াব বা ছদকায়ে জারিয়া মনে করে চারা বিতরণ করে আসছেন বাবুল।পরে এক সময় তিনি জানতে পারেন গাছ পরিবেশ রক্ষায়ও অতুলনীয় ও অসীম ভুমিকা রাখে। সে জন্যে গাছের চারা বিতরণে তিনি আরো উৎসাহী হয়ে উঠেন। গাছের চারা আর তার দু সন্তানের মধ্যে কোন পাথক্য তিনি দেখেন না।
বাবুল জানান,‘আমি দু‘সন্তানের জনক। একজন জিয়াউল হক (১০) চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে অপর জন বায়েজেদুল হক (৫) নুরানী মাদরাসায় প্রথম শ্রেণিতে পড়ে। এ দু’সন্তানের মতোই আমার স্নেহ মমতা জড়িয়ে আছে গাছের সাথে’।
ইচ্ছা থাকলে অল্প উপার্জন করেও একজন ব্যক্তি মানব কল্যাণ ও পরিবেশ রক্ষায় কাজ করতে পারে বাবুল তার একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। কৈশোরে চারা বিতরণ করার সময় অনেকে অনেক মন্তব্য ছুড়ে দিতেন। তখন সেগুলোতে কান দিতেন না বাবুল। বিয়ের পর স্ত্রী মনোয়ার বেগম চারা বিতরণে অনুৎসাহিত করলেও বর্তমানে তিনিও গাছের চারা বিতরণে সহায়তা করে থাকেন বলে বাবুল জানান।
কী কী গাছের চারা বিতরণ করেন জানতে চাইলে বাবুল জানান, ‘আমি নারকেল গাছের চারা সবচেয়ে বেশি বিতরণ করি। অর্থনৈতিক ও ফলজ গাছ হিসেবে এ গাছ সবাই পছন্দ করেন । নারকেলের এ চারা স্কুল কলেজ মাদরাসার ছাত্র ও সাধারণের মাঝে বিতরণের পর স্বল্প জায়গায় তারা তা পরম যত্মে রোপন করেন।’ কোন রূপ খ্যাতি বা স্বীকৃতির জন্য নয়, প্রকৃতির সাথে তার যেন এ হৃদ্যতার বন্ধন। বর্ষা মৌসুম এলেই হাতে নারিকেল গাছের চারা নিয়ে বিতরণে বের হয়ে পড়েন বাবুল।
মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মানুষের মাঝে গাছের চারা বিতরণ করে যেতে চান বাবুল। তার অনুপস্থিতে এই কাজের ধারাবাহিকতা যেন ধরে রাখতে পারে সেজন্যে তার সন্তানদেরকেও চারা বিতরণে উৎসাহী ও শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছেন তিনি।
এক সময় আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে মধ্যপ্রাচ্যে পাড়ি জমান বাবুল। সেখানেও তিনি গাছের উপকারিতা ও গাছ লাগানো সম্পর্কে বাঙ্গালী অবাঙ্গালী সবাইকে উৎসাহিত করতেন। তাই দেশি বিদেশী অনেকে বাবুলকে গাছ বিতরণে আর্থিক সহায়তা দিয়েছেন। দেশে ফিরে তিনি আবার বৃক্ষ রোপণ ও বৃক্ষের চারা বিতরণ অব্যাহত রেখেছেন। স্বল্প আয়ের টাকা থেকে বৃক্ষপ্রেমিক বাবুল বিগত ১৫ বছরে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়া সংগঠনকে স্থানীয় ফতেয়াবাদের বিভিন্ন নার্সারী থেকে কয়েক হাজার হাজার চারা বিতরণ করেছেন।
প্রাথমিক বিদ্যালয় পাশের পর নানা কারণে আর পড়া শোনা করতে পারেনি বাবুল। ছোটবেলা থেকে বাবুল লুকিয়ে লুকিয়ে বৃক্ষ বিতরণ করা শুরু করেন। তিনি জানান, ‘আমি যখন দ্বিতীয় কি তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ি তখন থেকেই চারা বিতরণ শুরু করি। কিন্তু তখন লুকিয়ে লুকিয়ে বন্ধুদেরকে চারা দিতাম।’ এরপর থেকে থেমে থাকেনি তার চারা বিতরণ। দেশের প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করতে উদ্বুদ্ধ হয়ে নিজের খরচে নারিকেল গাছের চারা ক্রয় করে বিতরণে ব্যক্তিগত এ উদ্যোগে সাড়া দিয়ে ফতেয়াবাদ নার্সারির স্বত্বাধিকারী মোঃ জসিম উদ্দিনও তাকে গাছ বিতরণে সহায়তা করেন।
বাবুলের বৃক্ষপ্রেম দেখে পরিবেশ সচেতন ব্যক্তিরা অনুপ্রাণিত হয়েছেন। উৎসাহী হয়ে এলাকার অনেকে এখন স্ব উদ্যোগে চারা লাগানো ও চারা বিতরণ শুরু করছেন। এদের মধ্যে রয়েছেন স্থানীয় গাড়ী ব্যবসায়ী নাজমুল ইসলাম (৩৮) ও শাহজালাল প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য পাশ করা আবদুল মান্নান(২৫)।
স্থানীয় ফতেয়াবাদের ফুটন্ত গোলাফ নামের একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন নুরুল হক বাবুলের মহতী কাজের জন্য তাকে সংবর্ধনা দেয়। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হিসাব বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক কাউছার হামিদ সংবর্ধিত বাবুলের হাতে ক্রেষ্ট তোলে দেন। এ সময় বাবুল তার অনুভুতি ব্যক্ত করে বলেছেন,প্রত্যেক মানুষ যদি নিজের দায়বদ্ধতা থেকে মানুষের কল্যাণে এগিয়ে আসেন তাহলে সমাজ ও দেশ সুন্দর হবে।
যে সময়ে জনসংখ্য বৃদ্ধি জনিত কারণে মানুুষের অবাসনের ব্যবস্থা করতে ও ইট পোড়ানোতে যে হারে গাছ-গাছালী নিধন প্রতিযোগিতা চলছে, মানুষ ও প্রাণীকুল বেঁচে থাকার পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে , সে সময়ে পরিবেশ সুরক্ষায় বাবুলে এ অনন্য উদ্যোগটি অবশ্যই প্রশংসনীয়।স্বল্প উপার্জন করেও যে ইচ্ছা থাকলে মানুষ ও পরিবেশের কল্যাণ করা যায় তার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত বৃক্ষপ্রেমিক বাবুল।