সুইস ব্যাংক কী, কিভাবে কাজ করে?

বাংলাদেশের গণমাধ্যমে সুইস ব্যাংক নিয়ে প্রায়ই আলোচনা-সমালোচনা প্রকাশ হতে দেখা যায়। সম্প্রতি দেশের গণমাধ্যমে আবারো সুইস ব্যাংক নিয়ে বেশ আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। কারণ বিগত এক বছরে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশীদের আমানত জমা বেড়ে গেছে ২৮ দশমিক ৩৩ শতাংশ। অন্য হিসাবে ২০১৮ সালে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশীদের আমানতের টাকা আগের বছরের তুলনায় এক হাজার ২৭৪ কোটি টাকা বেড়ে দাঁড়িয়েছে পাঁচ হাজার ৩৪১ কোটি টাকা, যা সুইস ফ্রাঙ্কের অঙ্কে ৬১ কোটি ৭৭ লাখ ২০ হাজার। সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ‘সুইস ন্যাশনাল ব্যাংক’(এসএনবি) ‘ব্যাংকস ইন সুইজারল্যান্ড’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে। কোন দেশের নাগরিকদের কত অর্থ সুইস ব্যাংকে জমা আছে, তা এই প্রতিবেদনের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়। তবে এককভাবে কোনো অ্যাকাউন্টের তথ্য প্রকাশ করা হয় না। সুইজারল্যান্ডে ব্যাংকের সংখ্যা ২৪৮টি। অনেকের ধারণা, সুইস ব্যাংক বলতে সুইজারল্যান্ডের সুনির্দিষ্ট কোনো একটি ব্যাংককে বুঝায়। আসলে তা নয়, সুইস ব্যাংক বলতে দেশটির ২৪৮টি ব্যাংকের যে কোনোটিকে বুঝায়। সত্যিকার অর্থে সুইস ব্যাংক বলতে একটি ব্যাংকিং নেটওয়ার্ককে বোঝানো হয়। সুইস ব্যাংকের হিসাব আর ১০টি ব্যাংকের মতোই। তবে পার্থক্যটা হচ্ছে, এটি গ্রাহকদের ও হিসাবের তথ্যের গোপনীয়তা কঠোরভাবে রক্ষা করে থাকে।

সাধারণ্যে একটি ধারণা বদ্ধমূল রয়েছে, অবৈধ আয় ও কর ফাঁকি দিয়ে জমানো টাকাই সুইস ব্যাংকে জমা রাখা হয়। তা কিছুটা সত্য বটে। তবে বৈধ অর্থও অনেকে সুইস ব্যাংকে জমা রাখেন। তবে গ্রাহকদের অ্যাকাউন্ট সম্পর্কিত তথ্য কাউকে দিতে সুইস ব্যাংক বাধ্য নয়। এটি সে দেশের ব্যাংকের নীতি ও আইনবিরুদ্ধ। সে জন্য গ্রাহক তথ্য গোপন রাখার জন্য সুইস ব্যাংকের খ্যাতি বিশ্বজুড়ে। সে জন্যই বিশ্বের ধনী ও বিখ্যাত লোকেরা সুইস ব্যাংকে টাকা রাখতে পছন্দ করেন। সেই সাথে কালো টাকার মালিকেদেরও পছন্দ এই সুইস ব্যাংক।

প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশীদের আমানত জমার পরিমাণ কেন বাড়ছে? বিশেষজ্ঞজনেরা বলছেন, গত বছরেরর ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচন নিয়ে তৎসময়ে চলা অনিশ্চয়তার মধ্যে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশীদের এই আমানত জমার পরিমাণ বেড়েছে। তা ছাড়া গ্রাহকদের তথ্যগোপনের বিষয়টিও বাংলাদেশী গ্রাহকদের মাথায় নিশ্চয় রয়েছে।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডএসের সিনিওর রিসার্চ ফেলো ড. নাজনীন আহমেদের মতে, চার কারণে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশীদের টাকা বাড়ছে। প্রথমত দেশে বিনিয়োগ পরিস্থিতি অনুকূলে না থাকা ও বিনিযোগ বৈচিত্র্য আনতে অনেকে টাকা বিদেশে নিয়ে যান। আর সেই টাকাই হয়তো তারা রাখছেন সুইস ব্যাংকে। তিনি মনে করেন, সুইস ব্যাংকে যে টাকা জমা হয়, তা মূলত ধনীদের জমানো টাকা। বাংলাদেশে বড় ধরনের যারা ধনী, তাদের টাকাও সেখানে জমা হচ্ছে। আর প্রয়োজন অনুযায়ী সেখান থেকে টাকা তুলে যখন-তখন যে কোনো দেশে বিনিয়োগ করা যাচ্ছে।

তার মতে, দ্বিতীয় কারণ হলো, যাদের হাত কালো টাকা রয়েছে তারা এ দেশে ঘোষণা দিয়ে বিনিয়োগ করতে চান না। ধারণা করা হয়, যিনি কালো টাকা বিনিয়োগ করবেন, তিনি চিহ্নিত হয়ে থাকবেন। এর ফলে তিনি সরকারের বিভিন্ন অ্যাজেন্সির মাধ্যমে হয়রানির শিকারে পরিণত হতে পারেন। এ কারণে কালো টাকার মালিকেরা সুইস ব্যাংকে টাকা রাখাটা অধিকতর নিরাপদ মনে করেন।
তৃতীয় কারণ হচ্ছে, বৈধ পথে আয় করা টাকাও অনেকে বিভিন্নি ধরনের প্রয়োজনে, যেমন ছেলেমেয়েদের বিভিন্ন দেশে লেখাপড়া করানোর জন্য সুইস ব্যাংকে টাকা রাখছেন। কারণ বাংলাদেশ থেকে টাকা পাঠাতে অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়। সে ঝামলা এড়াতেও অনেকে সুইস ব্যাংকে টাকা জমা রাখছেন।

চতুর্থ কারণ দেশে বিনিয়োগ করার মতো আর কোনো জায়গা না থাকায় অনেকে সুইস ব্যাংকে টাকা জমান। তিনি আরো উল্লেখ করেন, এখন বাংলাদেশে একটি ধনিক শ্রেণী তৈরি হয়েছে। এরা দেশের ভেতরকার সব ধরনের সুযোগ ইতোমধ্যেই নিয়ে ফেলেছেন। নেয়ার মতো আর কোনো সুযোগ তাদের জন্য অবশেষ নেই। ফলে অনেকে বিনিয়োগে বৈচিত্র্য আনতে টাকা দেশের বাইরে নিয়ে যাচ্ছেন।

অপর দিকে, ‘বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইনটেলিজেন্স ইউনিটের (বিআইএফইউ) প্রধান আবু হেনা মোহাম্মদ রাজি বলেন, অনেকে মনে করেন সুইস ব্যাংকে টাকা নেয়া মানেই খারাপ। আসলে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের ব্যবসায়-বাণিজ্য বেড়ে যাওয়ার কারণে সুইস ব্যাংকে আমাদের টাকার পরিমাণ বাড়ছে। তিনি বলেন, এই অর্থে সব অবৈধ অর্থই যে সেখানে গেছে তা বলা যাবে না। তবে কেউ যদি অবৈধভাবে সেখানে টাকা নিয়ে থাকেন তবে সেটা আমরা দেখব। যেহেতু আমরা এগমন্ট গ্রুপের সদস্য, সেহেতু প্রয়োজনে তাদের কাছে চিঠি লিখব। তিনি জানান, এর আগেও তাদের কাছে তথ্য চেয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে। উল্লেখ্য এগমন্ট গ্রুপ হলো বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ফিন্যান্সিয়াল ইনটেলিজেন্স ইউনিটের (এফআইইউ) সমন্বয়ে গঠিত একটি আন্তর্জাতিক ফোরাম। এই ফোরাম মুদ্রাপাচার ও সন্ত্রাসে অর্থায়নসংক্রান্ত তথ্য নিয়ে কাজ করে।

সুইস কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঘোষণা অনুযায়ী নাগরিকত্ব গোপন রেখেছেন, এমন বাংলাদেশীদের জমা রাখা অর্থ এই হিসেবের মধ্যে রাখা হয়নি। গচ্ছিত সোনা কিংবা মূল্যবান সামগ্রীর আর্থিক মূল্যমানও এ হিসাবের বাইরে রাখা হয়েছে। পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৬ সাল থেকে টানা ছয় বছর সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশীদের জমার পরিমাণ বাড়ছে।

সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশীদের টাকা বেড়ে চলার কারণে আরো বিভিন্ন মতামত রয়েছে। কারো মতে, সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশীদের টাকা বাড়ে সাধারণত দুটি পরিস্থিতিতে : যখন দেশ থেকে মুদ্রাপাচারের পরিমাণ বেড়ে যায় এবং যখন অনাবাসী বাংলাদেশী ও ব্যবসায়ীরা এসব ব্যাংকে টাকা জমা রাখেন। অনেকের অভিমত, গত বছরের জাতীয় নির্বাচনসম্পর্কিত অনিশ্চয়তার কারণে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশীদের টাকার পরিমাণ বেড়েছে। তা ছাড়া, গত বছর বাংলাদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা দেশের বাইরে চলে গেছে ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে। গত বছরের শেষ দিকে আমদানিপ্রবণতা লক্ষ করলে এ বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যায়। গত বছরে আমদানির পরিমাণ বেড়ে গেলেও এ বছরে আবার তা কমে গেছে। এ ধরনের প্রবণতা থেকে জানা যায়, অর্থ দেশের বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। অনুমান করা হয়, অবৈধভাবে দেশের বাইরে নিয়ে যাওয়া এসব অর্থ সুইস ব্যাংকেই জমা করা হয়। করবহির্ভূত অর্থও জমা হয় সুইস ব্যাংকে। তবে অনেকের অভিমত, সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশীদের জমা করা সব টাকাই অবৈধ তা বলা যাবে না।

তবে এ কথা ঠিক, বিশ্বের বড় অঙ্কের অবৈধ অর্থের একটি বিরাট অংশ নিরাপদে জমা হচ্ছে সুইস ব্যাংকে। বিগত কয়েক দশক ধরে সুইস ব্যাংক বিশ্বের বড় বড় ধনীদের সুযোগ করে দিয়েছে দেশের বাইরে তাদের টাকা নিরাপদে রাখার জন্য। অফশোর অ্যাকাউন্ট অবৈধ নয়, কিন্তু অনেক লোক তা ব্যবহার করে তাদের অর্থ করের আওতার বাইরে রাখার অসৎ উদ্দেশ্যে। এসব নানা কারণে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সুইস ব্যাংক আন্তর্জাতিক চাপের মুখে পড়েছে। কারণ ভারতসহ বেশ কয়েকটি দেশ কালো টাকা-বিরোধী বিভিন্ন পদক্ষেপ জোরদার করেছে। ইউরোপের নেতৃত্বে করফাঁকি ও দুর্নীতিবিরোধী অভিযানও চালু করা হয়েছে। তা সত্ত্বেও বিশেষজ্ঞজনেরা বলছেন, ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি’ (জিএফআই)-এর তথ্য-পরিসংখ্যান অনুসারে এখনো বিভিন্ন দেশ থেকে মুদ্রাপাচার চলছে ব্যাপকভাবে। জিএফআই রিপোর্ট মতে, বাংলাদেশ থেকে ২০১৪ সালে ৬০০ থেকে ৯০০ কোটি ডলারের অবৈধ অর্থ দেশের বাইরে চলে গেছে। জিএফআই গত জানুয়ারিতে এর সর্বশেষ রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। এই রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০১৫ সালে বাংলাদেশ থেকে ৫৯০ কোটি ডলার মুদ্রা পাচার হয়েছে। আর এই মুদ্রা পাচার হয়েছে ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে।

যুক্তরাষ্ট্রে সুইস ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা কিংবা অন্য কোনো অফশোর ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খোলার বিরুদ্ধে কোনো ধরনের বিধিনিষেধ নেই। কিন্তু বিদ্যমান আইআরএস রেগুলেশন অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রের একজনকে ফরেন অ্যাকাউন্ট সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য প্রকাশ করতে হয়, যখন এরা বিদেশী অ্যাকাউন্টের ওপর ১০ হাজার ডলারের বেশি অঙ্কের করের ফাইল দাখিল করেন। তা ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের একজন নাগরিক, গ্রিন কার্ডধারী কিংবা অন্য কোনো ধরনের নাগরিক হিসেবে ট্যাক্স কর পরিশোধ করে এমনকি সুইস ব্যাংকের মাধ্যমে আমেরিকান সিকিউরিটিজেও বিনিয়োগ করা হয়, তখন তা জানাতে হবে আইআরএসকে।

বিশ্বের কোনো দেশের সাথে তেমন কোনো চুক্তি না থাকলেও, ২০০৩ সালের জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্র ও স্জুারল্যান্ড ট্যাক্স ইনফরমেশন বিনিময়ের ব্যাপারে একটি চুক্তি করে। এই চুক্তির লক্ষ্য, সুইস ব্যাংকে রাখা তহবিল কর ফাঁকি দেয়ার ক্ষেত্রে সেইফ হেভেন কিংবা অবৈধ তহবিলের আধার যেন না হয়ে ওঠে। এর ফলে সুইস ব্যাংককে অ্যাকাউন্ট ও অ্যাকাউন্টধারীর ইনফরমেশন সরবরাহ করতে হয়, যখন যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা কোনো অ্যাকাউন্ট বা অ্যাকাউন্টধারীকে করফাঁকি সম্পর্কে কোনো ধরনের সন্দেহ পোষণ করেন। এই চুক্তির একাংশে বলা আছে, এটি বোধগম্য যে, তথ্য চেয়ে পাঠালে সংশ্লিষ্ট দেশটিকে তথ্য সরবরাহ করতে হবে, যেখানে চিঠি দেয়া দেশটির কাছে এমন গ্রহণযোগ্য কারণ রয়েছে, যার ফলে দেশটি করফাঁকির কিংবা এ ধরনের কোনো অপরাধ সংঘটনের ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করতে পারে। এ ধরনের সন্দেহের ব্যাপারে তথ্য-প্রত্যাশী দেশটির সন্দেহ পোষণের ভিত্তি হতে হবে : ০১. প্রমাণিত বা অপ্রমাণিত দলিলপত্র, বিজনেস রেকর্ড, অ্যাকাউন্ট বুকস অথবা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ইনফরমেশন; ০২. করদাতর কাছ থেকে পাওয়া কোনো টেস্টিমনিয়াল ইনফরমেশন; ০৩. কোনো তৃতীয় পক্ষ থেকে পাওয়া তথ্য, এবং ০৪. পরিস্থিতিগত সাক্ষ্যপ্রমাণ।

সুইস আইন অনুসারে, সুইজারল্যাণ্ডের অনাবাসী যে কেউ কমপক্ষে ১৮ বছর বা তার চেয়ে বেশি বয়সী হলে তিনি একটি সুইস ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলতে পারবেন। এ ছাড়াও আছে আরো বেশ কিছু বিধিনিষেধ। আপনার অ্যাকাউন্ট হতে পারবে যে কোনো দেশের মুদ্রায়। একটি বিষয় মনে রাখতে হবে, আপনি যদি আপনার অ্যাকাউন্টের গোপনীয়তা নিয়ে না ভাবেন তবে আপনি এমন একটি সুইস ব্যাংক বেছে নিতে পারেন, যেটির ব্যাংক শাখা আপনার নিজ দেশে চালু রয়েছে। ব্যাংক শাখাগুলোকে সংশ্লিষ্ট দেশের আইন মেনে চলতে হবে। ব্যাংকটির করপোরেট শাখা যে দেশেই থাকুক না কেন, সে দেশের আইনই মানতে হবে। উদাহরণত যুক্তরাষ্ট্রের একটি সুইস ব্যাংক শাখাতে তেমন গোপনীয়তার সক্ষমতা নেই, যেমনটি আছে যুক্তরাষ্ট্রের একটি ব্যাংক শাখার। আপনি কী ধরনের অ্যাকাউন্ট ধারণ করবেন, তা নির্ভর করবে বিনিয়োগের পরিমানের ওপর। বিনিয়োগ সেবা যত বিপুল হবে, অ্যাকাউন্ট খুলতে টাকাও তত বেশি লাগবে। সুইস ব্যাংকে আপনার প্রবেশ থাকবে সেইফ ডিপোজিট বক্সেও। সুইস ব্যাংকে টাকা জমা রাখতে সামান্য পরিমাণে সুদ পাওয়া যায়। তা থেকে অবশ্য সুইস উইথহোল্ডিং ট্যাক্স দিতে হবে। সে জন্য যারা সুইজারল্যান্ডে থাকেন না, তারা ইউএস ডলার, ব্রিটিশ ডলার ও ইউরোতে সুইস ব্যাংকে অর্থ জমা রাখেন। এমনটি করা হলে আপনি আপনার অর্থ অর্থবাজারের তহবিলে রাখতে পারবেন, যেখানে আপনি সুদ অর্জন করতে পারবেন।

অনেকের ধারণা, কেউ চাইলেই সুইস ব্যাংকে টাকা জমা রাখা যায়। আসলে ব্যাপারটি তেমন নয়। সুইস ব্যাংকে ব্যক্তিগতভাবে হাজির হয়ে অ্যাকাউন্ট খোলাটাই উত্তম। তবে সুইস ব্যাংক ই-মেইলের বা ফ্যাক্সের মাধ্যমেও অ্যাকাউন্ট খোলার সুযোগ দেয়। অনেক ফার্ম রয়েছে, যেগুলো মানুষকে অফশোর অ্যাকাউন্ট খোলায় সহায়তা করে। যেহেতু সুইস অ্যান্টি-মানি-লন্ডারিং আইন মতে আপনাকে প্রমাণ করতে হবে, আপনার টাকার উৎস কী, তাই আপনাকে অ্যাকাউন্ট খুলতে অনেক সার্টিফাইড ডকুমেন্ট দাখিল করতে হবে। এসব ডকুমেন্টের মধ্যে রয়েছে, আপনার পাসপোর্টের সত্যায়িত কপি, ট্যাক্স রিটার্ন, কোম্পানি ডকুমেন্টস, পেশাগত লাইসেন্স, ইত্যাদি। যদি আপনি অ্যাকাউন্ট খুলতে যান মেইলে, তবে ব্যাংকের পাঠানো ফরম পূরণ করতে হবে আপনাকে। সেই সাথে উপরে উল্লিখিত ডকুমেন্টে আপনাকে স্বাক্ষর করতে হবে।

আপনি চাইলে যেকোনো সময় আপনার সুইস ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দিতে পারেন। এতে নেই কোনো বিধিনিষেধ ও খরচাপাতি। তাৎক্ষণিকভাবে আপনি আপনার অ্যাকাউন্টের টাকা পেয়ে যাবেন। লিকুইডেটেড হওয়া মাত্র আপনার বিনিয়োজিত টাকা পাবেন।

শুধু সুইস ব্যাংকই নয়, বিশ্বে আরো অনেক সিক্রেট ব্যাংক রয়েছে যেগুলো অ্যাকাউন্টের গোপনীয়তা কঠোরভাবে রক্ষা করে এবং ট্যাক্স হেভেন হিসেবে কাজ করে। এ ধরনের সবচেয়ে সুপরিচিত যেসব সিক্রেট ব্যাংকের নাম করা যেতে পারে সেগুলোর মধ্যে আছে : অ্যাংগুলিয়া, বেলিজ, বাহামাস, ক্যামান আইল্যান্ডস ও পানামার ব্যাংকগুলো। অ্যাংগুলিয়া হচ্ছে একটি পূর্ব ক্যারিবিয়ান ব্রিটিশ টেরিটরি। এটিকে বিবেচনা করা হয় একটি অফশোর বিজনেস সেন্টার ও ট্যাক্স-ফ্রি জোন হিসেবে। বেলিজ অফশোর ব্যাংকিংয়ের সুযোগ দিয়ে আসছে সেই ১৯৯৫ সাল থেকে। এসব ব্যাংকের অ্যাকাউন্টগুলো স্থানীয় করের আওতাভুক্ত নয়।

এর গ্রাহকদের গোপনীয়তার নিশ্চয়তা দেয়া হয়। যদি বেলিজের কোর্ট মনে করে কোনো অ্যাকাউন্টের অর্থ অসদুপায়ে আসছে তবে সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে সে ব্যাপারে তথ্য প্রকাশ করতে হয়। প্রকাশ করতে হয় হিসাবধারীর পরিচয়ও। বাহামার ব্যাংকে গোপনীয়তা অন্যান্য দেশের মতো ততটা কঠোর নয়। দেশটির নতুন ব্যাংক আইন ব্যাংকগুলোকে সুযোগ দিয়েছে হিসাবধারী ব্যক্তির ও কোম্পানির তথ্য গোপন রাখার। ক্যামান আইল্যান্ডের রয়েছে সুইজারল্যান্ডের মতো ব্যাংকসংশ্লিষ্ট জোরালো প্রাইভেসি আইন। সেখানে কোনো কর্মকর্তা হিসাবধারীর গোপনীয়তা ভঙ্গ করলে তাকে কারাগারে যেতে হয়। অনেকেই পানামাকে দেখেন ব্যাংক অ্যাকউন্টের গোপনীয়তা রক্ষার ক্ষেত্রে একটি স্থিতিশীল দেশ হিসেব।

সে যাই হোক, সেইফ হেভেন হিসেবে একক খ্যাতির দাবিদার হচ্ছে সুইস ব্যাংক। বৈধ ও অবৈধ অর্থের আধার হচ্ছে এই সুইস ব্যাংক। সে কারণে অনেকেই সুইস ব্যাংককে দেখেন ‘রেড ফ্ল্যাগ’ তথা মহাবিপদ হিসেবে। বিশেষ করে সুইস ব্যাংককে এই অভিধায় অভিহিত করেন পুঁজিবাদবিরোধীরা। কারণ এরা মনে করেন, পুঁজিবাদ সম্প্রসারণের এক লালন ক্ষেত্রও হচ্ছে এই সুইস ব্যাংক।

Share this post

scroll to top