কারাগারে দুদকের এনামুল বাছির

ঘুষ লেনদেনের মামলায় দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সাময়িক বরখাস্ত পরিচালক খন্দকার এনামুল বাছিরের জামিন নাকচ করে তাঁকে কারাগারে পাঠিয়েছে ঢাকার একটি আদালত। আজ মঙ্গলবার ঢাকার জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ আদালতের বিচারক কে এম ইমরুল কায়েস এই আদেশ দেন।

এর আগে বেলা ২টায় রাজধানীর রমনা থানা হেফাজত থেকে তাঁকে আদালতে আনা হয়। গতকাল সোমবার রাতে রাজধানীর দারুস সালাম এলাকার একটি বাসা থেকে এনামুল বাছিরকে গ্রেপ্তার করে দুদক পরিচালক ফানাফিল্লাহর নেতৃত্বে একটি দল।

সূত্র জানায়, ১৭ জুলাই মামলা করার পর থেকেই এনামুল বাছিরকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চালিয়ে আসছিল দুদক। কিন্তু বাছির আত্মগোপনে থাকায় তাকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি। গ্রেপ্তারের দিন এনামুল বাছির দারুস সালাম এলাকায় তাঁর এক ভাগ্নির বাসায় ছিলেন। সেখান থেকে একটি ফোনের মাধ্যমে স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেন তিনি। সেই ফোনের সূত্র ধরে এনামুল বাছিরের অবস্থান নিশ্চিত হয়ে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়।

এর আগে খন্দকার এনামুল বাছিরকে ঘুষ দেওয়ার মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয় পুলিশের বরখাস্ত হওয়া উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) মিজানুর রহমানকে।

এনামুল বাছিরের আইনজীবী কবির হোসাইন আদালতে দাবি করেন, এনামুল বাছির দুদকে ২৮ বছর ধরে চাকরি করছেন। চাকরি জীবনে তাঁর বিরুদ্ধে কখনো ঘুষ গ্রহণের কোনো অভিযোগ আসেনি। ন্যূনতম কোনো অসততার অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে নেই। ডিআইজি মিজান চক্রান্ত করে এনামুল বাছিরের বিরুদ্ধে ঘুষ গ্রহণের মিথ্যা অভিযোগ এনেছেন।

কবির হোসাইন আদালতে দাবি করেন, ডিআইজি মিজানের বিরুদ্ধে দুদক কর্তৃপক্ষের কাছে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পর ডিআইজি মিজান ঘুষ দেওয়ার মিথ্যা দাবি করেন। ডিআইজি মিজানের সঙ্গে এনামুল বাছির টেলিফোনে কোনো কথা বলেননি। এনামুল বাছিরের আইনজীবীরা আদালতের কাছে আরও দাবি করেন, এনামুল বাছির ডিআইজি মিজানের সঙ্গে কথা বলেছেন বলে যে দাবি করা হচ্ছে তা মোটেও ঠিক নয়। মিজানের দাবি করা অডিওতে কণ্ঠ যাচাই করার জন্য এনামুলের কণ্ঠ নেওয়া হয়নি।

মামলার বিষয়ে এনামুলের আইনজীবীরা দাবি করেন, পদোন্নতি সংক্রান্ত ব্যাপার নিয়ে এনামুল বাছির উচ্চ আদালতে রিট আবেদন করেন। এই কারণে ষড়যন্ত্র করে তাঁকে মিথ্যা এই মামলায় ফাঁসানো হয়েছে। এ মামলার একটি ঘটনাস্থল দেখানো হয়েছে রমনা পার্ক। এনামুল বাছির একজন শিক্ষিত ব্যক্তি। ডিআইজি মিজানও শিক্ষিত লোক। রমনা পার্ক এর মতো জায়গায় ঘুষের টাকার লেনদেন মোটেও বিশ্বাসযোগ্য নয়।

জামিনের আবেদন বিষয়ে এনামুলের আইনজীবীরা বলেন, এনামুল জামিন পেলে বিদেশে পালাবেন না। তিনি অসুস্থ। বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতিবেদন দিয়েছে, বেতনের টাকা ছাড়া আর কোনো টাকা তাঁর ব্যাংক হিসাবে নেই।
এনামুল বাছিরের জামিন চান তাঁর ভাই খন্দকার এনামুল খায়ের। তিনি আদালতের কাছে দাবি করেন, তাঁর ভাই চাকরি জীবনে ১০ টাকাও কারও কাছ থেকে ঘুষ নেননি। চক্রান্ত করে তাঁর ভাইকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হয়েছে।

এনামুল বাছিরের জামিনের বিরোধিতা করে আদালতে বক্তব্য তুলে ধরেন দুদকের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল। তিনি আদালতকে বলেন, হাওয়ার ওপর ভিত্তি করে পরিচালক এনামুল বাছিরের বিরুদ্ধে মামলা করেনি দুদক। ঘুষ গ্রহণ, ক্ষমতার অপব্যবহার ও অর্থপাচারের অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়ায় ডিআইজি মিজান ও এনামুল বাছিরের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। তিনি বলেন, দুদক কারও প্রতিপক্ষ নয়। যদি কেউ প্রতিপক্ষ মনে করেন, তিনি ভুল করছেন।
মোশাররফ হোসেন কাজল আদালতকে জানান, ঘুষ গ্রহণ সংক্রান্ত ডিআইজি মিজানের সঙ্গে এনামুল বাছিরের কথোপকথনের যে অডিও পাওয়া গেছে তার ফরেনসিক প্রতিবেদন এসেছে। ওই অডিওতে এনামুল বাছিরের কণ্ঠ বলে প্রতিবেদনে উঠে আসে। এনামুল বাছির গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। সেই কণ্ঠের সঙ্গে ডিআইজি মিজানের সঙ্গে কথোপকথনে এনামুল বাছিরের কণ্ঠের মিল পাওয়া গেছে।

দুদকের এই আইনজীবী আদালতকে আরও বলেন, এনামুল বাছিরকে বিপদে ফেলার জন্য দুদক এই মামলা করেনি। টাকার লেনদেন হয়েছে। এখানে রাগ-বিরাগের কোন সুযোগ নেই। তদন্ত চলমান। এনামুল বাছিরকে কারাগারে পাঠানো হোক।

আদালত উভয় পক্ষের বক্তব্য শুনে এনামুল বাছিরকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। আদালতের এই আদেশের পর এনামুলকে প্রিজন ভ্যানে তোলা হয়।

১৭ জুলাই ডিআইজি মিজান ও এনামুল বাছিরকে আসামি করে মামলা করে দুদক। মামলার এজাহারে বলা হয়, খন্দকার এনামুল বাছির কমিশনের দায়িত্ব পালনকালে অসৎ উদ্দেশ্যে নিজে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার আশায় ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন। অভিযোগ-সংশ্লিষ্ট ডিআইজি মিজানুর রহমানকে অবৈধ সুযোগ দেওয়ার উদ্দেশ্যে ডিআইজি মিজানের অবৈধভাবে অর্জিত ৪০ লাখ টাকা ঘুষ হিসেবে নিয়েছেন। ঘুষের ওই টাকার অবস্থান গোপন করেছেন। এর মাধ্যমে তিনি দণ্ডবিধির ১৬১ ধারা তৎসহ দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন, ১৯৪৭-এর ৫(২) ধারা এবং মানি লন্ডারিং আইন ২০১২-এর ৪(২) (৩) ধারায় অপরাধ করেছেন। একইভাবে ডিআইজি মো. মিজানুর রহমান সরকারি কর্মকর্তা হয়েও তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ থেকে অব্যাহতি পাওয়ার আশায় অর্থাৎ অনুসন্ধানের ফলাফল নিজের পক্ষে নেয়ার অসৎ উদ্দেশ্যে খন্দকার এনামুল বাছিরকে অবৈধভাবে প্রভাবিত করেছেন। এ জন্য ৪০ লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে পরস্পর যোগসাজশে দণ্ডবিধির ১৬৫(ক) ধারাসহ দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন, ১৯৪৭-এর ৫(২) ধারা এবং মানি লন্ডারিং আইন ২০১২-এর ৪(২) (৩) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন।

মামলার কয়েক দিন পর গত রোববার ঘুষের মামলায় ডিআইজি মিজানকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। মিজান ১ জুলাই থেকে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের মামলায় কারাগারে। গতকাল দুদকের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল সাংবাদিকদের বলেন, ঘুষ লেনদেনের মামলায় ডিআইজি মিজানকে গ্রেপ্তার দেখানোর আবেদন করে দুদক। ঢাকার জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ ইমরুল কায়েসের আদালত শুনানি নিয়ে মিজানকে এই মামলায় গ্রেপ্তার দেখানোর আদেশ দেন। গতকাল মিজানকে কারাগার থেকে প্রিজন ভ্যানে করে ঢাকার আদালতে হাজির করা হয়।

দুদকের মামলার এজাহারের তথ্য অনুসারে, ২০১৮ সালের ২৯ অক্টোবর ডিআইজি মিজানের অবৈধ সম্পদ অর্জন সংক্রান্ত একটি অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেওয়া হয় এনামুল বাছিরকে। ওই অনুসন্ধান চলমান অবস্থায় গত ৯ জুন ডিআইজি মিজান ওই অনুসন্ধান থেকে বাঁচতে এনামুল বাছিরকে ৪০ লাখ টাকা ঘুষ দিয়েছেন বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর আসে। এর পরপরই দুদকের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিকভাবে উচ্চপর্যায়ের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটি তাৎক্ষণিকভাবে খন্দকার এনামুল বাছিরের বক্তব্য গ্রহণ করে এবং পারিপার্শ্বিক বিষয় পর্যালোচনা করে ঘুষ নেওয়ার বিষয়ে প্রাথমিক সত্যতা পায়। এরপর ১৩ জুন পরিচালক ফানাফিল্ল্যাহর নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি অনুসন্ধান দল গঠন করে।

অনুসন্ধান দল ঘটনাস্থল পরিদর্শন, ঘটনার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বক্তব্য গ্রহণ, ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) বিশেষজ্ঞ মতামত গ্রহণ ও পারিপার্শ্বিক বিষয়াদি পর্যালোচনা করে। তাতে দেখা গেছে, চলতি বছরের ১৫ জানুয়ারি ডিআইজি মিজানুর রহমান একটি বাজারের ব্যাগে করে কিছু বইসহ ২৫ লাখ টাকা খন্দকার এনামুল বাছিরকে দেওয়ার জন্য রাজধানীর রমনা পার্কে আসেন। সেখানে কথাবার্তা শেষে একসঙ্গে বেরিয়ে শাহজাহানপুর এলাকায় যান। এরপর খন্দকার এনামুল বাছির ২৫ লাখ টাকাসহ ব্যাগটি নিয়ে তাঁর বাসার দিকে চলে যান। একইভাবে ২৫ ফেব্রুয়ারি ডিআইজি মিজান একটি শপিং ব্যাগে করে ১৫ লাখ টাকা নিয়ে রমনা পার্কে যান। সেখানে আলাপ-আলোচনা শেষে দুজন শান্তিনগর এলাকায় চলে যান। শান্তিনগরে এনামুল বাছির ব্যাগটি নিয়ে চলে যান। দুদকের কাছে এ ঘটনার প্রযুক্তিগত প্রমাণের পাশাপাশি চাক্ষুষ সাক্ষীও রয়েছে।

এজাহারে দুদক আরও বলেছে, এনামুল বাছির ও মিজানের কথোপকথন পর্যালোচনায় তারা দেখেছে, বাছির তাঁর ছেলেকে কাকরাইলের উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল থেকে আনা-নেওয়ার জন্য ডিআইজি মিজানুর রহমানের নিকট একটি গাড়িও দাবি করেন। এ বিষয়টি তিনি দুদকের বিভাগীয় তদন্ত কমিটির কাছে স্বীকার করেন বলে এজাহারে বলা হয়েছে।

অনুসন্ধানে আরও দেখা গেছে, ডিআইজি মিজান ও বাছির দুজনই বেআইনিভাবে দুটি পৃথক সিম ব্যবহার করে একে অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। ওই সিম দুটি ডিআইজি মিজানের দেহরক্ষী মো. হৃদয় হাসান ও আরদালি মো. সাদ্দাম হোসেনের নামে কেনা। সিমের সঙ্গে বাছিরকে একটি স্যামসাং মোবাইল সেটও কিনে দেন মিজান। ওই দুটি নম্বরের মাধ্যমে মিজান ও বাছির নিয়মিত যোগাযোগ রেখেছেন। দুদক বলছে, ডিআইজি মিজান অসৎ উদ্দেশ্যে পরিকল্পিতভাবে ঘুষ লেনদেনসংক্রান্ত কথোপকথন রেকর্ড করে সংরক্ষণ করেছেন এবং পরে সেগুলো গণমাধ্যমে প্রকাশ করেছেন।

দুদকের অনুসন্ধান দল বলেছে, অনুসন্ধানকালে বিশেষজ্ঞ মতামত, প্রত্যক্ষ সাক্ষীদের বক্তব্য, অডিও রেকর্ডে উভয়ের কথোপকথন ও পারিপার্শ্বিক বিষয় পর্যালোচনা করে প্রমাণ হয়েছে, নিজে অভিযোগের দায় থেকে বাঁচার জন্য ডিআইজি মিজানুর রহমান ঘুষ নিতে এনামুল বাছিরকে প্রভাবিত করেছেন।

Share this post

scroll to top