২০০১ সালের সংসদ নির্বাচনের তখন আর মাত্র ১৬ দিন বাকি। একটি জাতীয় দৈনিকে সিনিয়র রিপোর্টার হিসেবে নিয়োজিত থাকাকালে নির্বাচন কমিশন কভার করার দায়িত্ব পালন করছি। আমার নিজের বিশেষায়িত প্রতিরক্ষা বিট তো আছেই। সংসদ নির্বাচনের সময় নির্বাচন কমিশন সংক্রান্ত রিপোর্ট করা যে কী ঝক্কি-ঝামেলার ব্যাপার, তা ভুক্তভোগী ছাড়া অনুধাবন করা সম্ভব নয়। ওই নির্বাচনে আবার সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দিয়ে মোতায়েন করায় প্রতিরক্ষা বিষয়েও তীক্ষ নজর রাখতে হতো। সকালে বের হয়ে চলে আসতাম নির্বাচন কমিশনে। এই তথ্য, সেই তথ্য জোগাড় করার পাশাপাশি হঠাৎ হঠাৎ প্রেস ব্রিফিং তো ছিলই। আর বিশেষ রিপোর্ট করার জন্য বিশেষ তথ্য বের করতে জোঁকের মতো লেগে থাকতে হতো।
দুপুরে কোনো দিন খেতাম, কোনো দিন থেকে যেতাম অভুক্ত। বিকেলের দিকে একঝাঁক সাংবাদিকের মধ্যে বসে হাতে লিখে রিপোর্ট নির্বাচন কমিশন অফিস থেকেই ফ্যাক্সে পাঠিয়ে দিতাম পত্রিকায়। এরপর সন্ধ্যার দিকে মতিঝিলের শেষ প্রান্তে দৈনিক অফিসে যেতে হতো বাকি কাজগুলো শেষ করার জন্য। প্রতিরক্ষা বিষয়ে কোনো ব্রিফিং থাকলে বা সোর্সের কাছে যেতে হলে ওই সময়ের মধ্যেই ছুটতে হতো। এটি সঙ্গত কারণেই অনেক স্পর্শকাতর বিষয়। তাই বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হতো। কোনো কোনো দিন রাতে আবার বাসায় ফেরার পথে নির্বাচন কমিশনে ঢুঁ মারতাম সর্বশেষ অবস্থা জানার জন্য। প্রধান নির্বাচন কমিশনার আবু সাইদ প্রায়ই রাতে মিটিংয়ে বসতেন। সব মিলিয়ে তখন চোখে সর্ষেফুল দেখছি। শরীর ক্লান্তির চরম সীমায় চলে গেছে।
ঠিক তখনই রাতে সম্পাদক তার রুমে ডেকে বললেন- কাল সকাল থেকে আমাকে জাতীয় পার্টির বিটও দেখতে হবে। জাতীয় পার্টি তখন আবার তিন ভাগে বিভক্ত। সহকর্মী এম আব্দুল্লাহ এত দিন জাতীয় পার্টির বিট দেখতেন। নির্বাচনের মাত্র ১৬ দিন আগে কেন তাকে সরিয়ে আমাকে দেয়া হলো, আর এই অল্প সময়ের মধ্যে কিভাবে সোর্স তৈরি করব- জানতে চাইলাম সম্পাদকের কাছে? তিনি সাফ জানিয়ে দিলেন, আমি রংপুরের লোক ও সেনাবাহিনীর অফিসার ছিলাম, তাই জেনারেল এরশাদের কাছে বিশেষ ‘ফেবার’ পাবো, এই বিবেচনায় আমাকে জাতীয় পার্টির বিট দেয়া হয়েছে। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। কারণ অবসর নেয়ার পর যখন বিভিন্ন দৈনিকে কলাম লেখা শুরু করেছি, তখন থেকেই জাতীয় পার্টি ও এরশাদের বিরোধিতা করেছি।
আদর্শগত দিক থেকে আমি কখনোই জাতীয় পার্টির সাথে খাপ খাওয়াতে পারিনি। তাই খুব দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম। রংপুর শহরে আমার পৈতৃক বাড়ি থেকে জে. এরশাদের পৈতৃক বাড়ি ‘স্কাইভিউ’ এক কিলোমিটারের মতো দূরে। এ ছাড়া আমার আপন ছোট বোন বিয়ে করেছে এরশাদ পরিবারে। তবে আমি কখনো এরশাদ পরিবারের সাথে কোনো সখ্য বা যোগাযোগ রাখতাম না। কোনো দিন জে. এরশাদের কাছে যাইনি। তার ইমিডিয়েট ছোট ভাই এবং সে সময়ের এমপি মরহুম মোজাম্মেল হক লালু আমাদের রংপুুরের বাসায় যেতেন আব্বার সাথে দেখা করতে। তিনিও জানতেন- আমি জাতীয় পার্টি ও তার বড় ভাইকে নিয়ে ‘কী সব’ লিখেছি। তাই পুরো বিষয়টি আমার জন্য বেশ বিব্রতকর হয়ে দাঁড়াল। এসব চিন্তা করে মারাত্মক টেনশনে পড়ে গেলাম। সারা রাত কাটল দুশ্চিন্তা ও রাগে।
পরদিন বেলা ১১টায় জাতীয় পার্টির বনানীস্থ চেয়ারম্যান কার্যালয়ে জেনারেল এরশাদের প্রেস ব্রিফিং ছিল। পার্টি অফিসে একটু আগেই চলে গেলাম প্রেস সচিব সুশীল শুভ রায়ের সাথে পরিচিত হওয়ার জন্য। তিনি তার অফিসে সাদরে আমাকে অভ্যর্থনা জানালেন এবং পার্টির সিনিয়র নেতাদের ব্যাপারে ব্রিফ করলেন। ব্রিফিং শুরু হওয়ার সময় জে. এরশাদ আসার পর সুনীল দা আমাকে তার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। এরশাদ বেশ অবাকই হলেন নির্বাচনের মাত্র ১৬ দিন আগে তার দল কভার করার জন্য রিপোর্টার পরিবর্তন করার কথা শোনে। আমাকে বললেন প্রেস ব্রিফিং শেষে তার সাথে অফিসে দেখা করে যেতে। আমি আরো সঙ্কুচিত হয়ে গেলাম; ভয় পেলাম। হাজার হলেও ১৯৮৫ সালের ডিসেম্বরে তার হাত দিয়েই মিলিটারি একাডেমি থেকে কমিশন পেয়েছি। সেনাবাহিনীর সিনিয়র-জুনিয়র সম্পর্কে যে বিশেষ স্পর্শকাতরতা রয়েছে তা থেকে কোনো সেনা অফিসারের পক্ষেই কোনো দিন বের হওয়া সম্ভব নয়।
অন্য দিকে দৈনিক পত্রিকার রিপোর্টার হিসেবে একটি রাজনৈতিক দল কভার করতে গেলে প্রয়োজন হয় অনেক ইনফরমাল সম্পর্কের। দুরু দুরু বুকে প্রেস ব্রিফিং কোনো মতে শেষ করলাম। এরপর নির্দেশমতো জেনারেল এরশাদের রুমের দরজায় গিয়ে নক করলাম। ভেতরে যাওয়ার পর এরশাদের সামনে গিয়ে যখন দাঁড়ালাম, তখন অনেকটা কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থা। ভাবছিলাম, না জানি কী ধরনের কঠোর অভ্যর্থনার মুখে পড়তে হয়! কিন্তু না। তিনি অত্যন্ত অমায়িকভাবে আমার ও আমার পরিবার সম্পর্কে জানতে চাইলেন। তারপর খুব স্বাভাবিকভাবেই বললেন, তুমি তো আমার ও আমার দল সম্পর্কে পত্রিকায় বহু কিছু লিখেছ। এর অনেক কিছুই আমার দফতরে ফাইলবন্দী করা আছে। তোমার মতো এমন জাতীয় পার্টি-বিরোধী একজনকে কেন এ সময়ে আমার দল কভার করতে দেয়া হলো? তুমি তো নির্বাচনের এই জটিল সময়ে আমার পার্টির ‘বারোটা বাজিয়ে দেবে’।
আমি কী উত্তর দেবো ভাবছি। কিন্তু এরশাদ সরাসরি আমার সম্পাদককে মোবাইল ফোনে কল করে বসলেন। তার আশঙ্কার কথা বললেন। ও পাশ থেকে সম্পাদক সাহেব কী বলেছিলেন, তা জানি না। তবে ফোন শেষে এরশাদ মাথা নেড়ে নরম সুরে বললেন, ‘ঠিক আছে যাও। দেখি, তুমি কেমন রিপোর্ট করো।’ আমি তখন ওই রুম থেকে বের হয়ে আসতে পারলে বাঁচি। তবে বের হওয়ার আগে তার অনুমতি নিয়ে বললাম- স্যার, আপনার ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক অনেক সিদ্ধান্ত আমি পছন্দ করি না। ওগুলোর বিরোধিতা করি। ঠিক একইভাবে আপনার দল জাতীয় পার্টির রাজনীতিও আমার কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। তবে আপনি আমাদের সেনাপ্রধান ছিলেন, দেশের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। আপনার সেই মর্যাদা আমার কাছে সারা জীবন থাকবে। রিপোর্ট করার ক্ষেত্রে কোনো দিন দলবাজি করিনি, করবও না। যা হয়েছে বা ঘটেছে, তাই বলব। মিথ্যে বা উদ্দেশ্যমূলক কোনো রিপোর্ট আমার হাত দিয়ে হবে না।’
জে. এরশাদ চুপচাপ আমার কথা শুনলেন। রুম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে তিনি তার ব্যক্তিগত মোবাইল ফোন নম্বর দিয়ে হেসে বললেন, ‘কোনো কিছু ক্ল্যারিফাই করতে হলে আমাকে সরাসরি ফোন করবে। কেউ কিছু না বললেও আমি তোমাকে তথ্য দেবো।’ অনেকটা অবাক হয়েই রুম থেকে বের হলাম। কোথায় বকাঝকা খাওয়ার কথা, সেখানে আমার সাথে এত নম্র আচরণ করলেন? কিছুই বললেন না। আজো ভাবি, অন্য কাউকে যদি তার এবং তার দল সম্পর্কে এমন কথাবার্তা বলতাম, তাহলে আমার কী অবস্থা হতো?
খুব দ্রুত জাতীয় পার্টির মধ্যে সোর্স গড়ে তুলতে পেরেছিলাম। এরশাদের পিএস ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত মেজর খালেদ। সেনাবাহিনীর কোর্স বিবেচনায় তিনি আমার চেয়ে অনেক সিনিয়র। এরশাদ তাকে খুব স্নেহ করতেন। যেখানেই যেতেন, সাথে নিয়ে যেতেন তাঁকে। দলের অনেক সিনিয়র নেতা যে তথ্য বা ভেতরের খবর জানতেন না মেজর খালেদ তা প্রথমেই জেনে যেতেন। খালেদও আমাকে কাছে টেনে নিলেন। অল্প সময়ের মধ্যে তিনি যাবতীয় সহায়তা করেছেন। এতে এক দিকে যেমন কোনো রিপোর্ট মিস করিনি, তেমনি সেনাবাহিনীর চিরাচরিত কমরেডশিপ কাজে লাগিয়ে অনেক বেশি তথ্য পেয়েছি, যা অন্য রিপোর্টাররা হয়তো পেতেন না কিংবা পেতে বেশ কষ্ট হতো। এ দিকে জে. এরশাদ কয়েক দিনের মধ্যে আমাকে বেশ পছন্দ করা শুরু করলেন। তিনি দেখলেন, রিপোর্টে আমি সম্পূর্ণ নিরপেক্ষতা বজায় রাখছি। কয়েকবার তার অফিসেও গিয়েছি এর মধ্যে। প্রতিবারই বসতে বলে সস্নেহে চা-কফি খাইয়েছেন। মেজর খালেদ কাচ্চি বিরিয়ানি দিয়ে আপ্যায়ন করেছেন। এরশাদ ওই যে আমাকে স্নেহ করতে শুরু করলেন, তা এখনো বজায় আছে।
নির্বাচনের পর জেনারেল এরশাদ তার বাসায় দাওয়াত দিয়েছেন। টেবিলে একসাথে খেয়েছি। তার স্ত্রী বিদিশা আন্তরিকতার সাথে খাবার পরিবেশন করেছেন। এরশাদ প্রায়ই ফোন করতেন, খোঁজখবর নিতেন। রোজার মাসে, তিনি দৈনিক পত্রিকা ও টেলিভিশন চ্যানেলে জাতীয় পার্টির বিট কভার করতেন যেসব সাংবাদিক, তাদের সবাইকে তার বারিধারার প্রেসিডেন্ট পার্কের বাসায় ইফতার ও ডিনারের দাওয়াত দিতেন। নিজে আমাদের সাথে বসে ইফতার করে ছাদে গিয়ে নামাজ শেষে সবার সাথে বসে চা খেতেন আর গল্প করতেন। তাকে হাজারো বিব্রতকর প্রশ্ন করলেও তিনি কখনো রাগতেন না। সবার সব প্রশ্নের উত্তর দিতেন ভদ্র ভাষায়। আমি তাকে কখনো রাগতে দেখিনি। অনেক রাজনীতিবিদের সাথে মিশে দেখেছি যে, তাদের যদি কোনো অপ্রীতিকর প্রশ্ন করা হতো, তাহলে হয়তো আর এ দেশেই থাকতে পারতাম না।
রাজনীতি ও ব্যক্তিগত হাজারো সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও, জেনারেল এরশাদের এই গুণ অন্তত আর কারো মাঝে দেখিনি। যেদিনই বনানীর জাতীয় পার্টির অফিসে যেতাম, সেদিনই কাজী জাফর আহমদ, রুহুল আমীন হাওলাদার, অব: ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাহমুদুল হাসান, গোলাম মসিহ (বর্তমানে সৌদি আরবের রাষ্ট্রদূত)-এর মতো যাকেই পেতাম তার সাথে স্বভাবসুলভ তর্ক জুড়ে দিতাম, না হয় কোনো রাজনৈতিক ইস্যু নিয়ে বেশ কড়া জোক করতাম। এমনকি বিদিশার সাথে যখন এরশাদের সম্পর্ক খারাপ হতে শুরু করে তখন সরাসরি বিব্রতকর প্রশ্ন করলেও কেউ রাগ করতেন না। তারা সাংবাদিকদের সাথে সখ্য ও ভদ্রতা বজায় রাখতেন। মনে হয়, আমরা অনেকেই বরং এরশাদের সাথে অশোভন আচরণ করেছি, তবুও তিনি সেসব নিয়ে উচ্চবাচ্য করেননি। বিদিশার সাথে তার সম্পর্ক খারাপ হতে থাকলে কয়েকটি পত্রিকায় নিতান্ত ব্যক্তিগতভাবে এরশাদকে নিয়ে ইচ্ছেমতো লেখা হতে থাকে। এগুলোর বেশির ভাগই ছিল আপত্তিকর। কিন্তু তিনি কাউকে কিছু বলেননি, তিরস্কার করা তো দূরের কথা।
এ দিকে জাতীয় পার্টির রিপোর্টের বাইরেও যদি আমার কোনো বিশেষ রিপোর্ট তার ভালো লাগত, তিনি ফোন করে অভিনন্দন জানাতেন ও উৎসাহ দিতেন। একদিন সকাল ৮টার দিকে তার ফোন পেয়ে ঘুম ভাঙল। সেদিন পত্রিকায় আমার একটি বিশেষ প্রতিবেদন ‘লিড’ অর্থাৎ শীর্ষ রিপোর্ট হিসেবে প্রকাশিত হয়েছিল। তত দিনে বিশেষ সংবাদদাতা হিসেবে পদোন্নতি পেয়েছি। এখনো মনে আছে, রিপোর্টটির শিরোনাম ছিল ‘বন্ধুহীন হয়ে পড়ছে বাংলাদেশ’। এটা ২০০৪ সালের কথা। জে. এরশাদ ফোনে জানালেন, সকালে প্রথমেই তিনি ওই রিপোর্টটি পড়েছেন এবং আমি যা লিখেছি ঠিক তাই ঘটছে। সে সময় বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট সরকার না পারছিল যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সুসম্পর্ক রাখতে, না ছিল মুসলিম দেশগুলোর সাথে আগের সম্পর্কের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে। দীর্ঘ দিনের ঘনিষ্ঠ কৌশলগত মিত্র চীনকে ভীষণ ক্ষেপিয়ে দিয়েছিল ঢাকায় তাইওয়ানের ভিসা ইস্যুর অনুমোদন দিয়ে। এ ছাড়া ভারতের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে ছিল না বাস্তবসম্মত কোনো কূটনীতি।
যা হোক, জেনারেল এরশাদকে কাছ থেকে দেখে বেশ অবাকই হলাম। তিনি আর কোনো দিন আমার ব্যক্তিগত আদর্শিক বিষয়ে কোনো কথা বলেননি, বরং ব্যক্তিগতভাবে বেশ স্নেহ করতে শুরু করেছেন। ঈদ এলে তিনি জাতীয় পার্টির বিট কভার করা সব সাংবাদিককে উপহার পাঠাতেন। ফোন করে জিজ্ঞেস করতেন, ঈদের গিফট পেয়েছি কি না। তার তেমন একটি উপহারÑ আড়ংয়ের পাঞ্জাবি এখনো আমার কাছে আছে। পার্টির কাজে রংপুর বা কোথাও গেলে তিনি প্রায়ই সাথে নিয়ে যেতেন। ২০০৫ সালে বিদিশাকে তালাক দেয়ার কয়েক দিন পর সকালে হঠাৎ ফোন দিয়ে বললেন- ‘এখনি বনানীর কার্যালয়ে চলে এসো, দুই দিনের জন্য রংপুর যেতে হবে।’
নাশতা না করেই দৌড় দিলাম। পথে যেতে তার গাড়ি থামল টাঙ্গাইলে। সার্কিট হাউজে দলীয় নেতাকর্মীদের সাথে কথা বললেন। সাবেক রাষ্ট্রপতি হিসেবে তিনি রাষ্ট্রীয় প্রটোকল পেয়ে থাকেন। সাথে থাকে পুলিশ। টাঙ্গাইলের এসপি তার সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে এলেন। তিনি এসপির গ্রামের বাড়ি, সন্তানাদির খোঁজখবর নিলেন। এসপিকে আসার জন্য এবং প্রটেকশন দেয়ার জন্য ধন্যবাদ জানালেন। দুপুরে বগুড়া পর্যটন মোটেলে খাওয়ার সময় আমাকে ও আরো কয়েকজনকে তার টেবিলে নিয়ে বসালেন। তীক্ষè নজর রাখলেন আমরা ঠিকমতো খাচ্ছি কি না। বিকেলের দিকে তার গাড়ি যে মাত্র বগুড়া সীমান্ত অতিক্রম করে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ সীমান্তে প্রবেশ করল, তখন সড়কের দুই পাশে হাজার হাজার মানুষ।
আশপাশের গ্রাম থেকে ফসলের ক্ষেত ডিঙিয়ে ছুটে আসছে আরো অনেকে। সবার গলায় স্লোগান- এরশাদ, এরশাদ। গাড়ির গতি ধীর হয়ে গেল। রংপুর-ঢাকা সড়কে যান চলাচল হয়ে পড়ল স্থবির। পলাশবাড়ি উপজেলায় তার একটি পথসভায় বক্তৃতা দেয়ার কথা। পলাশবাড়িতে আমার গ্রামের বাড়ি। ওখানে পৌঁছে দেখি হাজার হাজার মানুষ। আমি ও প্রেস সচিব সুনীল শুভরায় গাড়ি থেকে নেমে গাড়ির পেছনে দাঁড়িয়ে এরশাদের বক্তৃতা শুনছি। সারা দেশে তখন বিদিশা ইস্যু বেশ রমরমা। ওই অবস্থায় ওটাই ছিল তার প্রথম জনসভা। রংপুুরের স্থানীয় ভাষায় তিনি বক্তব্য রাখছেন। একপর্যায়ে তিনি উপস্থিত জনতার উদ্দেশে বললেন- আইনের মধ্যে থেকে ও ধর্মীয় বিধিবিধান মেনে বিদিশাকে বিয়ে করেছিলাম। কিন্তু তার বিভিন্ন বিষয় আমি মেনে নিতে পারিনি, তার সাথে একই ছাদের নিচে থাকা আমার পোষায়নি। তাই ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী তালাক দিয়েছি। আমি কি অন্যায় করেছি? ‘হাজার হাজার মানুষ দুই হাত উঁচু করে সমস্বরে গগনবিদারী চিৎকার দিয়ে বলল- না!’
সুনীল দার দিকে তাকালাম চোখে কৌতুক নিয়ে। সুনীল দা বললেন, আপনাদের রংপুরে স্যারের এটাই কারিশমা। সন্ধ্যায় রংপুর পৌঁছানোর পর আমাদের রাখা হলো পর্যটন মোটেলে। আব্বা মারা যাওয়ার পর আমাদের রংপুরের বাসা ভাড়া দেয়া হয়েছিল, তাই অন্যদের সাথে আমাকেও মোটেলে থাকতে হলো। রাতে পার্টি মহাসচিব এসে হাজির। বললেন, এরশাদ তাকে পাঠিয়েছেন আমাদের সাথে ডিনার করতে, দেখভাল করতে। সকালে রংপুর ক্যাডেট কলেজের পাশে যে নতুন বাড়ি করেছেন, সেখানে আমাদের নাশতা খেতে বলেছিলেন এরশাদ। তার সাথে নাশতা খেলাম আমরা। রংপুরের পদাগঞ্জের আম খাওয়ালেন যতœ করে। দুপুরের খাওয়াও তার বাসায়। এরপর বদরগঞ্জ যাওয়ার কথা জনসভায় যোগ দিতে। পরদিন ঢাকায় আমার পারিবারিক গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ ছিল। স্ত্রী বারবার ফোন করছিলেন। তাই দুপুরে খাওয়ার পর স্যারকে জানালাম, আমাকে রাতের মধ্যেই চলে যেতে হবে।
কারণ শুনে তিনি সায় দিলেন। জানতে চাইলেন আমি যাবো কিভাবে? সাড়ে ৩টায় একটা এসি বাস ছাড়ে, সেটাতে যাওয়ার কথা বলায় তিনি বললেন- না, আমি গাড়ি দিয়ে দিচ্ছি, ওটাতে যাও। কোনো প্রয়োজন নেই তার বহরের দু’টি প্রাডো গাড়ির একটি আমাকে দিয়ে দেয়ার- এটা বলার পরও তিনি ড্রাইভার ডেকে আরেকজনকে সাথে নিয়ে আমাকে ঢাকায় নামিয়ে দিয়ে আসার হুকুম দিলেন। তবে জিপটি যমুনা সেতুর টাঙ্গাইল অংশ পর্যন্ত যাবে। ওই দিকে ঢাকা থেকে আরেকটি গাড়ি এসে থাকবে আমাকে বাকি পথটুকু নিয়ে যাওয়ার জন্য। এ ব্যবস্থা করা হলো, যাতে জিপটি রাতে রংপুর ফিরে আসতে পারে। তার এই বদান্যতা ওই পর্যায়ের আর কোনো মানুষের মাঝে দেখিনি। এদিকে, ২০০৫ সালের অক্টোবরে ওই দৈনিক থেকে পদত্যাগ করে দৈনিক যায়যায়দিন-এ যোগদান করি। এরপর ২০০৭ সালে ওয়ান-ইলেভেন ঘটনার পর চলে যাই দৈনিক আমার দেশ-এ। গিয়েই জেনারেল এরশাদের সমালোচনা করে একটি মন্তব্য প্রতিবেদন লিখি, যা প্রথম পাতায় বেশ বড় করেই ছাপা হলো।
তিনি ফোন করলেন। মৃদুস্বরে বললেন, তুমি আবারো আমার বিরুদ্ধে লেখা শুরু করেছ? আমি যথারীতি উত্তর দিলাম, স্যার, আগেই তো বলেছিলাম আমি আপনার রাজনৈতিক বিষয়গুলো পছন্দ করি না। এখন তো জাতীয় পার্টির বিট করছি না, তাই লিখেছি। আপনার কোনো প্রতিবাদলিপি দেয়ার থাকলে পাঠিয়ে দিন; আমরা ছাপাব গুরুত্ব দিয়ে। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, তিনি আমাদের ওখানে প্রতিবাদলিপি না পাঠিয়ে, আমি ২০০৫-এর আগে যে পত্রিকায় কাজ করতাম, সেখানে নিজ নামে একটি কলাম লেখেন আমার মন্তব্য প্রতিবেদনে উল্লিখিত বিষয়গুলোর জবাব দিতে। কিন্তু সেই লেখায় একটিবারের জন্যও আমার নাম উল্লেখ করেননি। শুধু জবাব দিয়ে গেছেন।
গত ক’বছর যখন কোনো অনুষ্ঠানে এরশাদের সাথে দেখা হতো, তিনি কাছে ডেকে কাঁধে হাত দিয়ে ঠিক বাবার মতো কুশলাদি জিজ্ঞেস করতেন। আমার স্ত্রীকে ‘মা’ কেমন আছো, ছেলে কত বড় হয়েছে, জানতে চাইতেন। তার ভাগ্নে কর্নেল এলাহী ২০০৯ সালে বিডিআর বিদ্রোহে শহীদ হওয়ার পর তিনি মারাত্মকভাবে ভেঙে পড়েন। আমাকে ফোন করে এলাহীর বাবার একটি স্মৃতিচারণমূলক লেখা আমার সম্পাদিত ডিফেন্স জার্নালে ছাপাতে অনুরোধ করেন। তার কাছে ১১ বছর ধরে ডিফেন্স জার্নাল পাঠাই। তিনি তা পড়েন এবং পত্রিকা পাঠানোর জন্য ফোন করে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। আমার আব্বা যখন ২০০৩ সালে ইন্তেকাল করেন তখন তিনি জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হিসেবে শোক বার্তা দিয়েছেন। তার ছোট ভাই মোজাম্মেল হক লালু ও তার স্ত্রী আমাদের রংপুরের বাসায় ছুটে গেছেন।
হাজারো সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও এরশাদ একজন হৃদয়বান রাজনীতিবিদ, যা বর্তমান বাংলাদেশে বেশ বিরল। চার বছর জাতীয় পার্টি কভার করার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, শুধু এরশাদের ব্যক্তিগত ইমেজে দলটি এখনো (এলাকাভিত্তিক হলেও) টিকে আছে। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, এরশাদের রাজনীতি এ দেশের জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে ভাঙন ধরিয়েছে, রাজনৈতিক অঙ্গনকে করেছে কলুষিত। তিনি ১৯৮২ সালে সম্পূর্ণ অযৌক্তিকভাবে নির্বাচিত বিএনপি সরকারকে হটিয়ে সামরিক শাসন জারি করেছিলেন। বিএনপিকে তছনছ করে দেন। অথচ ওই বিএনপির আদর্শকেই সামনে রেখে দাঁড় করান সমান্তরাল জাতীয়তাবাদী একটি দলÑ জাতীয় পার্টি। পররাষ্ট্রনীতি ও সামরিক বিষয়ে জেনারেল জিয়াউর রহমান যে দিকনির্দেশনা দিয়ে গিয়েছিলেন, এরশাদ সেগুলোই অনুসরণ করেছেন। ক্ষমতারোহণ অবৈধ হলেও তার শাসনামলে সশস্ত্র বাহিনীতে পেশাদারিত্বকে গুরুত্ব দেয়া হতো। এতে সেনাবাহিনীতে শৃঙ্খলা ফিরে আসে। সে আমলে চীন, পাকিস্তান, তুরস্ক, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েতের মতো দেশগুলোর সাথে নিবিড় সামরিক সম্পর্ক গড়ে তোলা হয়। তার দৃঢ় অবস্থানের কারণেই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জাতিসঙ্ঘ শান্তিরক্ষী মিশনে যাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়। সে সময় সেনাবাহিনীতে রাজনৈতিক বিবেচনায় পদোন্নতি দেয়া হতো না এবং প্রশাসনে যোগ্যতা বলে নিয়োগ দেয়া হতো। গার্মেন্ট শিল্পকে প্রণোদনা দিয়ে এগিয়ে নেয়া হয়েছিল।
তবে জাতীয়তাবাদী রাজনীতির আবর্তে জাতীয় পার্টি গড়ে উঠলেও দেশের বৃহত্তম জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক আকাক্সক্ষা অনুধাবনে এরশাদ ব্যর্থ হয়েছেন। তার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হলো, তিনি চাপের কাছে সহজেই নত হয়ে যান। ক্ষমতা হারানোর পর এ যাবৎ তার রাজনৈতিক দোদুল্যমানতা নিয়ে যেসব ঘটনা ঘটেছে তাতে সুস্পষ্ট যে, তিনি কোনো একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে স্থির থাকতে পারেন না। সংস্থা বা সরকারের চাপ এলেই কাত হয়ে পড়েন, মেরুদণ্ড সোজা থাকে না। একজন সাবেক সেনাপ্রধান হিসেবে যেমন দৃঢ়তা তার কাছে প্রত্যাশা করা যায়, রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সেসবের অনেক কিছুই হয়তো তার নেই। ব্যক্তিগত বিষয়েও তিনি বেশ অস্থিতিশীল। বিদিশার সাথে তার হঠাৎ বিয়ে, তারপর চকিত ছাড়াছাড়ি, মোবাইল চুরির মামলা দায়েরের ঘটনা, ইত্যাদি যতটা না ছিল তার নিজস্ব ইচ্ছের ফল; তার চেয়ে বেশি ছিল অন্তরালের চাপের পরিণতি। আমার মনে হয়েছে, সে সময়কার সরকার ও সংস্থাগুলো তাকে বাধ্য করেছিল বিদিশাকে ওভাবে তালাক দিতে আর হাস্যকর কেসে মামলা দায়ের করতে। ওই ক্ষেত্রে তার উচিত ছিল নিজ সম্মান রক্ষার্থে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো।
ভুলত্রুটি নিয়েই মানুষ। এরশাদও এর ব্যতিক্রম নন। ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক বিষয়ে তার হাজারো সীমাবদ্ধতা রয়েছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে তার অবস্থান কিভাবে নির্ণীত হবে তা ভবিষ্যৎ বলে দেবে। তবে তার ঘনিষ্ঠজনেরা তাকে একজন ‘আপাদমস্তক ভদ্রলোক, সজ্জন ও অমায়িক ব্যক্তি’ হিসেবে জানেন। চরম বিরুদ্ধ মত ও সমালোচনা সহ্যের ক্ষমতা তার অন্যসব দুর্বলতাকে চাপা দিতে সক্ষম। আজ তিনি জীবনসায়াহ্নে উপনীত। হয়তো স্বচ্ছভাবে চিন্তার ক্ষমতাও আর তার নেই। প্রার্থনা করি, আল্লাহ তার মঙ্গল করুন।
লেখক : বাংলাদেশ ডিফেন্স
জার্নালের সম্পাদক