সমগ্র মোগল আমলে উত্তর ময়মনসিংহের গৌরীপুর নামধেয় জনপদটির অস্তিত্ব ইতিহাসের পাতায় খুঁজে পাওয়া না গেলেও শাসক শক্তির প্রতিনিধি হিসেবে জমিদারদের আগমন গৌরীপুরকে জনপদ তথা ইতিহাসের পাতায় স্থান করে দিয়েছে। ব্রহ্মপুত্র নদ ছোঁয়া ময়মনসিংহ শহরের সোনালী ব্যাংক জোনাল অফিসের পাশেই গৌরীপুর লজ। গৌরীপুরের রামগোপালপুরের রাজা যোগেন্দ্র কিশোর রায়ের নির্মিত বিদ্যাপীঠ, রঙিন কাঁচের কারুকার্যের প্রাসাদ, কৃষ্ণ মন্দির ও প্রাসাদের প্রধান সুরঙ্গ পথ যে কাউকে মুগ্ধ করে।
বংশ পরম্পরায় জমিদারগণ এ জনপদে প্রায় দেড়শ’ বছর রাজত্ব করলেও ‘৪৭-এ দেশভাগের সঙ্গে সঙ্গে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ হওয়ায় অল্প কিছুদিনের মধ্যে গৌরীপুরের অধিকাংশ জমিদার দেশান্তরি হয়।
ফলে কালের বিবর্তণে প্রয়োজনীয় দেখভালের অভাবে এখানকার একাধিক জমিদার বাড়ির ঐতিহ্যের সঙ্গে বিলুপ্ত প্রায় রামগোপালপুর জমিদার বাড়ির ধ্বংসাবশেষটুকুও।
এ বাড়িতে নির্মিত রঙ্গম, চিড়িয়াখানা, বাগানবাড়ি, সাগরদিঘির কারুকার্যময় সান বাধাঁনো পুকুর ঘাটসহ ভিতর বাড়ির প্রবেশ পথে তিনতলা বিশিষ্ট তোরনদ্ধার সবই যেন আজ কেবলই স্মৃতি।
গৌরীপুরের রামগোপালপুরের জমিদার কালী কিশোরের পুত্র কাশী কিশোর রায় চৌধুরী ছিলেন বিখ্যাত জমিদার। চারিত্রিক গাম্ভীর্য ও প্রগাঢ় মনীষা ছিল কাশী কিশোর রায় চৌধুরীর অনন্য বৈশিষ্ট্য।
১২৬২ বঙ্গাব্দে তিনি পিতৃ সম্পত্তির অধিকারী হন। উন্নত রুচির অধিকারী কাশী কিশোর জমিদারির দায়িত্ব পেয়েই জমিদার বাড়ির গঠনশৈলীতে ব্যাপক পরিবর্তন সাধন করেন। বর্তমান বাড়িটিতে সৌন্দর্য্য ও শিল্প নৈপুণ্যের যতটুকু অবশেষ চিহ্ন রয়েছে তার দ্বারাই কাশী কিশোরের রুচির পরিমাপ করা যায়।
ইতিহাস
প্রায় ১৮৫০ শতকের দিকে এই জমিদার বাড়িটি প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে এই জমিদার বংশের মূল প্রতিষ্ঠাতা কে ছিলেন তা ইতিহাস থেকে জানা যায়নি। তবে এই জমিদার বংশের বেশ কয়েকজন বিখ্যাত জমিদারের নাম ইতিহাসের পাতায় উল্লেখ রয়েছে। তাদের কর্মের কারণেই আজকে ইতিহাসের পাতায় তাদের নাম। কাশী কিশোর রায় চৌধুরী রায় ছিলেন এই জমিদার বংশের একজন উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি। তার জমিদারী আমলে এই জমিদার বাড়ি অনেক উন্নত হয় ও জমিদার বাড়ির সৌন্দর্য বৃদ্ধি পায়। তার মত তার ছেলে যোগেন্দ্র কিশোরা রায় চৌধুরীও একজন উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি ছিলেন। ময়মনসিংহের গৌরীপুর ও তৎসন্নিহিত এলাকার জমিদারদের ইতিহাস “বারেন্দ্রবাহ্মণ জমিদার” গ্রন্থ রচনা করে তিনি অনেক খ্যাতি অর্জন করেন। এছাড়াও তিনি ব্রিটিশদের কাছ থেকে “রাজা” উপাধি ও “অনারারী ম্যাজিস্ট্রেট” পদ লাভ করেন। তিনি তার জমিদারীর সময়ে কারিগরি শিক্ষা বিস্তারের জন্য তার বাবা জমিদার কাশী রায় চৌধুরীর নামে “কাশী কিশোর কারিগরি বিদ্যালয়” প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি চার সন্তানের জনক ছিলেন। তারপরে চার সন্তানের মধ্যে এই জমিদারীর দায়িত্ব পান তৃতীয় জন। যার নাম ছিলো শৌরিন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী। ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, এই জমিদার বংশের অধিকাংশ লোকেরা সঙ্গীতের প্রতি অনেক দুর্বল ছিলেন। তারা সঙ্গীতকে খুবই ভালোবাসতেন। তাইতো তাদের যেকোনো অনুষ্ঠানে সঙ্গীতচর্চা অনেক গুরুত্ব পেত। এই জমিদার বংশের একজন জমিদার হরেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী ছিলেন তবলা সাধক। তিনি তবলা বাজানোতে ভালো পারদর্শী ছিলেন। তিনি ঐসময়ে সংগীত নিয়ে ইংরেজি ভাষায় একটি গ্রন্থ “দ্য মিউজিয়াম অব ইন্ডিয়া” লিখেন। যা ঐসময়ে বেশ সাড়া জাগিয়েছিল। এছাড়াও তিনি তবলা বিষয়ে উপর বিভিন্ন পত্রিকায় নিয়মিত প্রবন্ধ লিখতেন। তার আমলেই তৎকালীন ভারতবর্ষের বিখ্যাত তবলা সাধক তানসেন এর শেষ বংশধর ওস্তাদ মোহাম্মদ আলী খাঁ, দিল্লীর ওস্তাদ মসিদ খাঁ ও ওস্তাদ দবির খাঁ সহ অনেকেই এই জমিদার বাড়িতে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তবলা বাজানোর জন্য আমন্ত্রিত হতেন এবং জমিদার বাড়িতে সবসময় যাতায়াত করতেন। ভারতবর্ষ ভাগ হওয়ার পর ১৯৫৭ সালের জমিদারী প্রথা বিলুপ্তির মধ্য দিয়েই এই জমিদার বাড়ির জমিদারীর সমাপ্তি ঘটে। এরপরেই এই জমিদার বংশররা ভারতে চলে যান।
অবকাঠামো
এই বাড়িতে ছিল বসবাসের জন্য ভবন, রঙ্গম, চিড়িয়াখানা, উপসনালয় বা মন্দির, বাগানবাড়ি, সাগরদীঘির কারুকার্যময় সান বাধাঁনো পুকুর ঘাট সহ ভেতর বাড়ির প্রবেশ পথে তিনতলা বিশিষ্ট প্রবেশদ্বার।
বর্তমান অবস্থা
বাড়িটিতে বর্তমানে দুটি প্রবেশদ্বার, কয়েকটি ধ্বংসপ্রাপ্ত দেয়াল ও মন্দির ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। একটি প্রবেশদ্বার প্রায় ধ্বংসের মুখে আরেকটি কোনোরকম টিকে আছে। আর দেয়ালগুলো অধিকাংশই ধ্বংস হয়ে গেছে এবং লতাপাতায় জরাজীর্ণ হয়ে রয়েছে। তবে এখনো জমিদার বাড়ির মন্দির বেশ ভালো অবস্থায় আছে। মন্দিরে এখনো পূজোর অনুষ্ঠান হয়ে থাকে।