আজ মাহে রমজানের চতুর্থ দিবস। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাঁর প্রিয় মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উম্মতকে তাদের দেহমন পরিশুদ্ধ ও ফেরেশতাসুলভ বৈশিষ্ট্য অর্জনের সহায়ক হিসেবে এক মাস সিয়াম পালনের বিধান দিয়েছেন।
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমজানের সিয়াম পালনকে ইসলামের পাঁচ বুনিয়াদের অন্যতম বলে সাব্যস্ত করেছেন। বুখারি ও মুসলিম শরীফে হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর বরাতে বর্ণিত, রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ইসলামের ভিত্তি পাঁচটি বিষয়ের ওপরÑ এ মর্মে সাক্ষ্য দেয়া যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই ও মুহাম্মাদ সা: আল্লাহর রাসূল, সালাত আদায় করা, জাকাত দেয়া, হজ করা ও রমজান মাসে সিয়াম পালন করা।
রমজানের সিয়ামকে কেন ইসলামের ভিত্তি হিসেবে সাব্যস্ত করা হলো, তার ব্যাখ্যায় রয়েছে অনেক অভিমত। প্রথমত, মহান রাব্বুল আলামিনের প্রতি দাসত্বের পাশাপাশি অনুরাগ ও প্রেমের প্রমাণ দিতে যে কয়টি বিষয়ের ভূমিকা অনন্য, সেগুলোর মধ্যে রোজা অন্যতম। কালেমায়ে শাহাদাত পাঠের মাধ্যমে আদম সন্তানেরা মহান স্রষ্টার প্রতি নিজের দাসত্ব ও আনুগত্যের অঙ্গীকার ঘোষণা করে। আল্লাহ তায়ালার বিধান ও মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদর্শ মেনে নেয়া ও অনুসরণ করার শপথ নেয়াই কালেমায়ে তৈয়্যেবা ও কালেমায়ে শাহাদাতের মূল তাৎপর্য। সালাতে প্রকাশ্যভাবে, জাকাতে আর্থিকভাবে ও সিয়ামে সংযম পালনের মাধ্যমে মহান আল্লাহর প্রতি দাসত্বের প্রমাণ দেয়া হয়। দ্বিতীয়ত, স্রষ্টার প্রতি আনুগত্যের প্রধান বাধা অহঙ্কার দমন হয় সিয়াম পালনের মাধ্যমে।
তৃতীয়ত, আল্লাহর নির্দেশ পালনে ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে হয় সিয়ামের মধ্য দিয়ে। চতুর্থত, একজন মুসলমানের ওপর যেমন কিছু করণীয় আছে, তেমনি কিছু বর্জনীয় কর্তব্য আরোপিত হয়। বর্জনীয় কর্তব্যগুলোর প্রথমেই আসে নির্দিষ্ট সময়সীমায় পানাহার বর্জনের বিষয়, যা সিয়াম নামে অভিহিত। পঞ্চমত, মুসলমানদের পারস্পরিক সমবেদনা ও সহানুভূতির চেতনা জাগ্রত হয় সিয়ামের কারণে। আদম-হাওয়ার সন্তান হিসেবে বিশ্বের সমগ্র মানবগোষ্ঠী যে একই পরিবারের সদস্য, তার দাবি অন্যদের কষ্ট ও দুর্দশা অনুভব করা। সিয়ামের কারণে সেই অনুভূতি আসে। তাই সিয়াম আদায়ের ফলে মুমিন বান্দাদের মধ্যে যেমন তাকওয়ার গুণ সৃষ্টি হয়, তেমনি মানবসমাজে সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্য সৃষ্টিতেও এ ইবাদতের প্রভাব সুদূরপ্রসারী।
এ জন্য আগের আম্বিয়ায়ে কেরামের যুগেও সিয়ামের বিধান ছিল। এমনকি রমজানের সিয়াম ফরজ হওয়ার আগেও মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরাম কোনো কোনো বিশেষ দিন ও উপলক্ষে সিয়াম আদায় করতেন বলে জানা যায়।
বিশেষ করে মহররম মাসের দশম তারিখ বা আশুরার দিনে রোজা রাখার নিয়ম চালু ছিল প্রথম থেকেই এবং এ রোজার প্রতি গুরুত্বারোপ করা হতো বলে জানা যায়। রমজানের রোজা ফরজ হলে আশুরার রোজা নফল হিসেবে থেকে যায়। তা ছাড়া প্রতি চন্দ্র মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ, যা আইয়ামে বিজ বা উজ্জ্বল দিনগুলো নামে পরিচিত, সে দিনগুলোতে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও সাহাবিরা রোজা রাখতেন। এখনো এসব দিনের সিয়াম পালন করার ফজিলত অনেক।
আল্লাহ তায়ালা নিজের সাথে সিয়ামের সম্পর্ক ঘোষণা করেছেন। এভাবে তিনি সব ইবাদত-বন্দেগি থেকে সিয়ামকে আলাদা মর্যাদা দিয়েছেন। মুসলিম শরীফে সঙ্কলিত এক হাদিসে কুদসিতে আল্লাহ বলেন, মানুষের প্রতিটি কাজ তার নিজের জন্য; কিন্তু সিয়াম শুধু আমার জন্য, আমিই তার প্রতিদান দেবো। ‘সিয়াম পালনকারী আমার জন্যই পানাহার ও যৌনতা পরিহার করে।’
এ হাদিস দ্বারা আমরা অনুধাবন করতে পারি নেক আমলের মধ্যে সিয়াম পালনের গুরুত্ব আল্লাহর কাছে কত বেশি। হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু যখন বলেছিলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে অতি উত্তম কোনো নেক আমলের নির্দেশ দিন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তুমি সিয়াম পালন করবে। মনে রেখ এর সমমর্যাদার কোনো আমল নেই। (নাসায়ি)
সিয়ামের এত মর্যাদার একটি কারণ এই বলা যায়, সিয়াম এমন একটি আমল যাতে লোক দেখানো ভাব থাকে না। বান্দা ও আল্লাহ তায়ালার মধ্যকার একটি অতি গোপন বিষয়। সালাত, হজ ও জাকাতসহ অন্যান্য ইবাদত-বন্দেগি কে করল তা দেখা যায়। পরিত্যাগ করলেও বুঝা যায়; কিন্তু সিয়াম পালনে লোক দেখানো বা শোনানোর ভাব থাকে না। ফলে সিয়ামের মধ্যে ইখলাস বা আল্লাহর প্রতি একনিষ্ঠতা নির্ভেজালত্বও বেশি থাকে। এ জন্যই আল্লাহ বলেন, ‘সিয়াম পালনকারী আমার জন্যই পানাহার ও যৌনতা পরিহার করে।’