দুই বছর আগেও তাদের ছিলো সুন্দর গোছানে জীবন; কিন্তু ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্মম গণহত্যা শেষ করে দিয়েছে সেই সাজানো জীবন। গণহত্যা থেকে ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া মানুষ তারা। প্রাণ বাঁচাতে আশ্রয় নিয়েছেন বাংলাদেশে। এখানে রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবিরে কাটছে তাদের জীবন।
মিয়ানমারের উত্তর রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের একটি অংশ আশ্রয় নিয়েছে কক্সবাজারের উখিয়ায়। ক্যাম্পের আনন্দহীন জীবনে রমজানের রোজা খুব বেশি প্রভাব ফেলতে পারেনি। ক্যাম্পের প্রতিটি সদস্যই পরিবারের কোন না কোন স্বজনকে হারিয়েছে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হাতে। তবু ধর্মপ্রাণ মুসলমান হিসেবে রমজান মাস তাদের কাছেও বিশেষ গুরুত্ব নিয়ে হাজির হয়। উদ্বাস্তু শিবিরের সীমাবদ্ধতার মধ্যেও চেষ্টা করেন সাধ্যমত রমজানের আনন্দটুকু উপভোগ করতে।
বালুখালী ময়নাঘোনা ক্যাম্প নং ১১ এর বাসিন্দা চল্লিশ বছরের রোহিঙ্গা জাহেদুল ইসলাম বলেন, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের আগ পর্যন্ত মিয়ানমারে আরাম আয়েশে ছিলাম। সেখানে পবিত্র রমজান মাসে আমরা ছোলা, লেবুর শরবত ও সেমাই দিয়ে ইফতার করতাম।
গত বছরের তুলানায় এবার অনেকটাই সুবিধাজনক অবস্থায় আছেন উদ্বাস্তু শিবিরের রোহিঙ্গারা। বাংলাদেশ সরকার ও বিদেশী বিভিন্ন সংস্থার ত্রাণ কার্যক্রমের ফলে ক্রমশই শৃঙ্খলা ফিরে এসেছে ক্যাম্পে।
জাহেদুল বলেন, এখানে গত রমজানে আমাদের অনেক রোহিঙ্গা ভাইদের শুধুমাত্র পানি দিয়ে ইফতার করতে হয়েছিল। এখন সেই অভাব রোহিঙ্গাদের মাঝে নেই। রোহিঙ্গারা তাদের ক্যাম্পের অভ্যন্তরে দোকান দিয়ে ব্যবসা বাণিজ্য করে জীবন সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। অনেকেরই আয়ের পথ তৈরি হয়েছে। তাছাড়া বিশ্ব খাদ্য সংস্থা (ডাব্লিউএফপি) তাদের ই ভাউচার প্রোগ্রামের মাধ্যমে সকল রোহিঙ্গাদের রমজানের ইফতার সামগ্রী ছোলা, তেল, ডাল, সেমাই, পেয়াজ-রসুন চালসহ নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য সামগ্রী দিয়ে তাদেরকে সাহায্য করছেন। এ ধরনের সাহায্য সহযোগীতার ফলে রোহিঙ্গারা আগের অবস্থানে নেই। তার জীবনে কিছুটা হলেও পরিবর্তন এসেছে। তাই তারা এবারের রমজানের ইফতার তাদের ইচ্ছামতো করতে পারছেন বলে একাধিক রোহিঙ্গা জানিয়েছেন।
নাচ্ছিডং এলাকার রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবিরের বাসিন্দা ইয়াছমিন(২১), মজ্জিরিপাড়ার জুলেখা ( ২৫ ) সানজিদা বেগম (২৯) ও মায়েশা জানান, তারা প্রত্যেকে তাদের মাকে হারিয়েছেন।
প্রতি বছর রমজানের রোজা এলেই ইফতারের সময়ে মাকে ভীষণ মনে পড়ে, স্মৃতিতে ভেসে ওঠে পরিবারের সাথে ইফতার করার সেই আনন্দঘন মুহূর্তগুলো। তারা বলেন, এরপরও এখানে আমরা ভালো আছি। মিয়ানমারের জালিম সরকারের অত্যাচার থেকে বাচিঁয়ে নিজেদের জীবন নতুন করে সাজানোর চেষ্টা করছি।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এবারের ইফতারের চিত্র গত বছরের তুলনায় অনেকটা জমজমাট। ক্যাম্পের অভ্যন্তরে একটি দোকানে ইফতার সামগ্রী কিনতে আসা রোহিঙ্গা যুবক মোহাম্মদ নুর বলেন, এখানে মিয়ানমারের বিভিন্ন পণ্য দিয়ে পাঁচ মিশালি শরবত পাওয়া যায়। আমরা ক্যাম্পে মা-বোনদের সাথে ইফতার করি। মাঝে মধ্যে দোকানে বন্ধুদের সাথে নিয়ে ইফতার করি। এখানে আমরা অনেক ভাল আছি।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বেশ কয়েকটি দোকান ঘুরে দেখা গেছে, স্থানীয়রা যেমন বিভিন্ন দোকান থেকে তাদের পছন্দের পণ্য সামগ্রী ক্রয় করে থাকে ঠিক তেমনিভাবে রোহিঙ্গারাও ক্যাম্পের অভ্যন্তরে বিভিন্ন দোকান থেকে তাদের দেশীয় পণ্য সামগ্রীসহ বিভিন্ন নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য ক্রয়-বিক্রয় করছেন।
রোহিঙ্গাদের তৈরি ইফতার সামগ্রীগুরোর মধ্যে বাংলাদেশী খাবারের পাশাপাশি রয়েছে মিয়ানমারের অনেব সুস্বাদু ও মজাদার খাবার। প্রতিদিন দুপুর ২ টা থেকে মাগরিব পর্যন্ত রোজাদারদের সেবায় ব্যবসায়ীরা এই আয়োজন করেছেন। এসব দোকানে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে এক সাথে ইফতার করছেন অনেক রোহিঙ্গারা।