বিরোধী দল বিএনপির যে ক’জন গত ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে জয়ী হয়েছিলেন – তাদের সবাই শপথ নিয়ে ফেলেছেন, শুধু দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ছাড়া।
নির্বাচিত এমপিদের শপথ নেবার সময়সীমার শেষ দিনেও শপথ না নেওয়ায় তার সংসদীয় আসনটি ইতিমধ্যেই শূন্য ঘোষণা করে দিয়েছেন স্পিকার শিরিন শারমিন চৌধুরী। ওই আসনে এখন আবার নির্বাচন হতে হবে।
শুরু থেকেই শপথ না নেবার কথা বলে আসছিল বিএনপি, তাই তাদের শেষ দিনে শপথ নেয়া অনেককেই অবাক করেছে। কারণ বিএনপির লন্ডন-প্রবাসী ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এবং মির্জা ফখরুল সহ কেন্দ্রীয় নেতাদের সবাই বলছিলেন, ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন কোন নির্বাচনই হয় নি তাই এতে বিজয়ী বিএনপির নেতারা শপথ নেবেন না।
কিন্তু সে অবস্থান নাটকীয়ভাবে উল্টে দিয়ে বাকিরা শপথ নিলেও, মির্জা ফখরুলের শপথ না নেয়াটা হয়তো অনেককে আরো বেশি বিস্মিত করে থাকতে পারে।
আলমগীর যখন সংবাদ সম্মেলন করে তার দলের এমপিদের শপথ নেবার খবর জানাচ্ছেন এবং তার পক্ষে যুক্তি দিচ্ছেন, তখনও কিন্তু নিজে কখন শপথ নেবেন বা আদৌ নেবেন কিনা – এ প্রশ্নে তার জবাব ছিল অস্পষ্ট।
শেষ পর্যন্ত দেখা গেল তিনি শপথ নিলেনই না। এ সিদ্ধান্তের অর্থ কী?
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বিবিসিকে বলেছেন, ‘এক কৌশলের অংশ হিসাবে’ তিনি শপথ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
কী সেই কৌশল?
রাজনৈতিক বিশ্লেষক দিলারা চৌধুরীর কাছে প্রশ্ন রাখা হলে তিনি বলেন, “আমি তো এখানে কোন কৌশল দেখি না। কৌশল মানে কি, সরকারের কাছ থেকে কিছু আদায় করা তো? যেমন খালেদা জিয়ার জামিনে মুক্তি। তো, উনি সংসদে গেলে বা না গেলে সরকারের কী আসে যায়?”
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলছেন, এ কৌশল হচ্ছে সংসদের ভেতরে এবং বাইরে কাজ করা।
“সে কারণে সংসদের বাইরে থেকে আমি দলের জন্য কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি, এটা দলেরই একটি কৌশল…যারা শপথ নিয়েছেন তারা সংসদের ভেতরে কাজ করবেন, আমি বাইরে থেকে কাজ করবো,” বলেন বিএনপি মহাসচিব।
অন্যদিকে মীর্জা ফখরুল শপথ না নেয়া খবর ছড়িয়ে পড়লে বিএনপির কিছু নেতা ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করেন সম্পূর্ণ অন্যভাবে।
সংবাদমাধ্যমে গয়েশ্বর রায় সহ কয়েকজনের মন্তব্য দেখা যায়, যাতে তারা বলেন, যদি তারেক রহমানের সিদ্ধান্তেই পাঁচ এমপি শপথ নিয়ে থাকেন তাহলে তো শপথ না নিয়ে মির্জা ফখরুল আসলে তারেক রহমানের নির্দেশনা ভঙ্গ করেছেন।
এ কারণে তাকে মহাসচিবের পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হবে কিনা – এমন জল্পনায়ও জড়িয়ে পড়েন অনেকে।
বাংলাদেশে সংবিধান অনুয়ায়ী নতুন সংসদ শুরুর ৯০ কার্যদিবসের মধ্যে নির্বাচিত এমপিদের শপথ নেয়ার বাধ্যবাধকতা অনুসারে, মঙ্গলবার ছিল শপথ নেয়ার শেষ দিন। একেবারে শেষ মুহূর্তে সেই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করা হয় এবং বিএনপি থেকে নির্বাচিত বাকি পাঁচজন গত কয়েকদিনে শপথ নেন । সোমবার শপথ নেওয়ার পর তারা বলেন, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমানের নির্দেশে তারা শপথ নিয়েছেন।
এর আগে পর্যন্ত বিশ্লেষকদের মত ছিল, নির্বাচনে জয়ী বিএনপির অন্য নেতারা যদি দলের হাইকমান্ডের নির্দেশ ভঙ্গ করে শপথ নেন – সেক্ষেত্রে দল তাদের শৃঙ্খলাভঙ্গের জন্য বহিষ্কার করবে।
কিন্তু মির্জা ফখরুল যদি শপথ নেন – তাহলে এটা হবে বিএনপি ভেঙে যাবার শামিল, বলেন তারা।
তবে বাস্তবে দেখা গেল, ‘তারেক রহমানের নির্দেশনায়’ অন্যরা শপথ নিলেও মির্জা ফখরুল – অন্তত এখন পর্যন্ত – সংসদের বাইরেই রয়ে যাচ্ছেন।
এর ‘আসল কারণ’ বলে কিছু থাকলেও তা এখনো অজানা।
কিন্তু নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির কয়েকজন নেতার কথায় অন্য কিছু আভাস পাওয়া যায়।
আলমগীরের ঘনিষ্ঠ একজন নেতা বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, দলটির নীতিনির্ধারকদের মধ্যে আলমগীর একাই নির্বাচিত হয়েছেন, ফলে দলের জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্যদের অনেকে তার ওপর অসন্তুষ্ট ছিলেন। কারো কারো সাথে তাঁর টানাপোড়েনও সৃষ্টি হয়েছিল।
তিনি বলেন, স্থায়ী কমিটির সব সদস্যই শপথ নেয়ার বিপক্ষে কঠোর অবস্থানে ছিলেন। ফলে এখন সংসদে যাওয়ায় আলমগীরের সাথে তাদের সেই টানাপোড়েন বাড়তে পারে।
দলটির আরেকজন নেতা বলেছেন, যেহেতু মি. আলমগীর দলের পক্ষে এতদিন কঠোর অবস্থানের কথা তুলে ধরে আসছিলেন, ফলে এখন তিনিও একটা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে রয়েছেন। স্রোতের বিপরীতে সংসদে গিয়ে তার যে ভূমিকা রাখা প্রয়োজন হবে, সেটা কতটা সম্ভব হবে তা নিয়েও তাদের মধ্যে সন্দেহ রয়েছে।
ওই নেতা জানিয়েছেন, সিদ্ধান্ত নেয়ার দায়িত্ব তারেক রহমানের হলেও মি. আলমগীর তাদের দু’একজন নেতাকে জানিয়েছেন যে, বিষয়টাতে তাঁর ব্যক্তিগতভাবেও সিদ্ধান্ত নেয়ার একটা বিষয় আছে।
তাহলে কি দলের নেতৃত্বে নিজের অবস্থান ধরে রাখার জন্যই সংসদে না যাবার সিদ্ধান্ত নিলেন মি. আলমগীর?
এর জবাব দেয়া সত্যি কঠিন।
অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশের রাজনীতি এখন খুবই ‘কনফিউজিং’ বা বিভ্রান্তিকর হয়ে গেছে। “বিশেষ করে মনে হচ্ছে বিএনপি দলটির কোন দিকনির্দেশনা বা নেতৃত্ব বলতে কিছুই আর নেই। তারা যে কথা বলে সেই মতো কাজ করে না।”
“নির্বাচন নিয়ে তো বিএনপির মধ্যে আগে থেকেই মতপার্থক্য ছিল। এক পক্ষ নির্বাচনে না যাওয়া এবং আন্দোলনের পক্ষে ছিল, আরেকটা গ্রুপ হচ্ছে মির্জা ফখরুল ইসলামের নেতৃত্বাধীন – যারা নির্বাচনে গেছে।”
“এখন বিএনপির যে এমপিরা শপথ নিয়েছেন – এটা কিন্তু বিএনপির তৃণমূলের নেতাকর্মীরা খুব ভালো চোখে দেখবে না, তাদের সমর্থন এরা হারাবেন, কারণ এরা অনেক হামলা জুলুম সহ্য করেছেন।”
“বরং এখন যেটা হতে পারে যে যদি দল হিসেবে বিএনপি টিকে থাকতে পারে – তাহলে দ্বিতীয় তৃতীয় সারির নেতাদের ভেতর থেকেই দলটির একটা নতুন নেতৃত্ব বেরিয়ে আসতে পারে – বলেন দিলারা চৌধুরী।
কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, বিএনপির যে এমপিরা শপথ নিয়েছেন, স্থানীয়ভাবে দলের মধ্যে থেকে তার তো কোন প্রতিবাদ হয় নি।
এমনকি শপথ নেয়া নেতারাও বলেছেন, তাদের এলাকার জনগণের চাপ ছিল যেন তারা শপথ নেন এবং এমপি হিসেবে ভুমিকা রাখেন।
তবে দিলারা চৌধুরী বলছেন, “প্রতিবাদ এখন বাংলাদেশে একটা অসম্ভব ব্যাপার হয়ে গেছে। যারা শপথ নিয়েছেন তারা সরকারের গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়ে দিয়েছেন। তাই এর প্রতিবাদ কেউ করতে গেলে তারা তো সরকারের রোষানলে পড়বেন।”
সূত্র : বিবিসি