সিলেটের অন্যতম পর্যটন স্পট জাফলংয়ে বন্ধুদের সাথে বেড়াতে এসে গত ২৬ এপ্রিল শুক্রবার প্রাণ হারিয়েছেন সিলেট এমসি কলেজের অর্থনীতি বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র আকিকুর রহমান অনিক (২০)। ওইদিন দুপুর ২টার দিকে জাফলং জিরো পয়েন্ট এলাকায় পিয়াইন নদীর স্বচ্ছ পানিতে নামার পর সাঁতার না জানায় পানিতে তলিয়ে যান অনিক। পরদিন পিয়াইন নদী থেকে নিখোঁজ অনিকের লাশ উদ্ধার করা হয়। অনিক হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ এলাকার ধলা মিয়ার পুত্র।
একইভাবে গত বছরের ২৫ আগস্ট জাফলংয়ে বেড়াতে এসে পিয়াইন নদীতে গোসল করতে নেমে প্রাণ হারান রিফাত (১৯) নামের আরেক কলেজ ছাত্র। নিহত রিফাত ঢাকার উত্তর শাহজাহানপুর খিলগাঁওয়ের আবু সাইদের পুত্র ও ঢাকা সিটি কলেজের ছাত্র ছিলেন। এ সময় আহতাবস্থায় উদ্ধার করা হয় তার সহোদর শিফাত ও ঢাকার শাহজাহানপুরের আব্দুল বারেকের ছেলে সানিকে।
এমনভাবেই ২০০৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১৬ বছরে জাফলংয়ে বেড়াতে এসে পানিতে ডুবে প্রাণ হারিয়েছেন নানা বয়সের মোট ৫৪ জন পর্যটক। তাদের বেশির ভাগই কিশোর ও তরুণ। পাহাড়ী নদীর চোরাবালিতে আটকা পড়ে ও সাঁতার না জানা তাদের মৃত্যুর অন্যতম কারণ।
অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি সিলেটের জাফলং। পাহাড় টিলা আর চা বাগান সংলগ্ন সীমান্ত ঘেষা জাফলং প্রকৃতিকন্যা নামেও পরিচিত। সিলেট নগরী থেকে ৫৯ কিলোমিটার দূরে জাফলংয়ের অবস্থান। গোয়াইনঘাট উপজেলাধীন জাফলংয়ের সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে প্রতিদিনই সেখানে আসেন নানা বয়সের দেশি-বিদেশি পর্যটক।
পবিত্র ঈদ ও অন্যান্য ছুটির সময়ে জাফলংয়ে পর্যটকদের উপচেপড়া ভিড় পরিলক্ষিত হয়। এখানে পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ হচ্ছে স্বচ্ছ জলরাশির পিয়াইন নদী। কিন্তু অপরিকল্পিতভাবে এই নদী থেকে পাথর উত্তোলনের ফলে সৃষ্ট গর্তে বালু জমে চোরাবালির সৃষ্টি হওয়ায় এবং স্বচ্ছ জলধারায় গভীরতা কম দেখা যাওয়ায় কেউ কেউ পানিতে গোসল করতে নেমে তলিয়ে যান।
পরে তাদের লাশ পাওয়া যায়। ছোট নৌকায় ভ্রমণ করতে যেয়েও সাঁতার না জানার কারণে পিয়াইন নদীতে নৌকাডুবিতে প্রাণ হারিয়েছেন অনেকে।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭ সালের ৫ সেপ্টেম্বর জাফলংয়ের পিয়াইন নদীর জিরো পয়েন্ট এলাকায় গোসল করতে নেমে ৩ ঘণ্টার ব্যবধানে স্রোতের টানে পানিতে তলিয়ে প্রাণ হারান দুই শিক্ষার্থী। তারা হলেন- ময়মনসিংহ এ্যাপোলো ইনিস্টিটিউটের প্রথম বর্ষের ছাত্র কামাল শেখ ও চট্টগ্রাম সরকারি সিটি কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ফয়সল হোসেন সৌরভ।
২০১৬ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর মারা যান রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর সোহরাব (১৫) নামের এক কিশোর। ওইদিন সকাল ১১ টার দিকে সোহরাব পিয়াইন নদীতে সাঁতার কাটতে নামেন। এরপর তাকে আর পাওয়া যাচ্ছিল না। স্থানীয় লোকজন প্রায় এক ঘণ্টা অনুসন্ধান চালিয়ে তার লাশ উদ্ধার করেন। এর আগে নিখোঁজের এক দিন পর ২৪ আগস্ট পিয়াইন নদী থেকে ফরিদ আহমদ নামের এক শ্রমিকের লাশ উদ্ধার করা হয়। ফরিদ গোয়াইনঘাট উপজেলার উত্তর প্রতাপপুর (পান্তুমাই) গ্রামের মৃত রশিদ আলীর পুত্র।
এরও আগে ওই বছরের ১৯ আগস্ট জাফলংয়ের পিয়াইন নদীতে ডুবে মারা যান বেড়াতে আসা মোঃ আসিফ (১৭) নামের এক কিশোর। তার বাড়ি গাজীপুরের টঙ্গীর এরমাদপুর গ্রামে। স্কুলছাত্র আসিফ আত্মীয় স্বজনসহ ওইদিন জাফলংয়ে বেড়াতে আসেন। ওইদিন বিকেলে পিকনিক সেন্টারের গাড়ী পার্কিংয়ের স্থানের পাশে পিয়াইন নদীতে পা পিছলে পড়ে যান তিনি। দু’দিন পর পর তার লাশ নদীতে ভেসে উঠে।
ওই বছরের ৩ আগস্ট জাফলংয়ের জিরো পয়েন্টে পিয়াইন নদীতে সাঁতার কাটতে গিয়ে প্রাণ হারান সিলেট ব্লু-বার্ড স্কুল এন্ড কলেজের ছাত্র আশফাক সিদ্দিকী।
২০১৫ সালের ২২ জুলাই ঈদুল ফিতরের ছুটিতে পিয়াইন নদীতে গোসল করতে নেমে প্রাণ হারান ঢাকার দুই কলেজ ছাত্র। আব্দুল্লাহ অন্তর (১৮) ও সোহাগ ঘোষ (১৭) নামের এই দুই তরুণ ঢাকার কবি নজরুল কলেজের একাদশ শ্রেণীর ছাত্র ছিলেন। স্রোতের টানে তলিয়ে যাওয়ার দু’দিন পর একজন ও তিনদিন পর আরেক জনের লাশ পাওয়া যায়।
এর আগের বছরও পবিত্র ঈদুল ফিতরের ছুটিতে জাফলংয়ে পর্যটকদের ঢল নেমেছিলো। সে সময় তিন দিনের ব্যবধানে নদীতে গোসল করতে নেমে ও নৌকাডুবিতে প্রাণ হারান শিশুসহ ৬ জন। ওই বছরের ২ আগস্ট প্রাণ হারান নারায়ণগঞ্জের জসিম উদ্দিন।
এর আগে ৩১ জুলাই পিয়াইন নদীতে নৌকাডুবে মারা যান মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার সাকিল (১০), মামুন (২২) ও সাদেক হোসেন (২০)। একই দিনে চোরাবালিতে হারিয়ে যান সিলেটের শাহী ঈদগাহ হোসনাবাদ এলাকার কামরুল (২০) এবং সাঁতার কাটতে গিয়ে মারা যান অজ্ঞাত এক যুবক।
২০০৩ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত এক দশকে পিয়াইন নদীতে ডুবে মারা গেছেন আরো ৩৮ জন। এর মধ্যে ২০১৩ সালের ১৭ আগস্ট ঢাকার শনিরআখড়া এলাকার শুভ আহমদ, ২৫ অক্টোবর ঢাকার যাত্রবাড়ীর কলেজ ছাত্র ইমরান হোসেন এবং ৩০ মে মাদারীপুর সদর উপজেলার চলকিপুর গ্রামের মোঃ ইব্রাহীমসহ ৪জন মারা যান।
২০১২ সালের ২২ আগস্ট ঢাকা জেলার ফাহাদ উদ্দিন, ৩০ আগস্ট মৌলভীবাজারের কুলাউড়া এলাকার হিমেল রাজ সঞ্জয়সহ মোট দুইজন মারা যান। ২০১০ সালের ২৩ মার্চ ঢাকার খিলগাঁও এলাকার তারেক আহমেদ, ২০ মে রফিকুল ইসলাম ও গৌরাঙ্গ কর্মকার, ২২ মে ঢাকার শাহরিয়ার আহমেদ রাব্বি, ২ জুলাই ঢাকার তেজগাঁও এলাকার শাহরিয়ার শফিক, ৩০ জুলাই জামালপুর জেলার মাদারগঞ্জ এলাকার মুস্তাকিন তালুকদার, ১২ সেপ্টেম্বর ঝালকাঠি জেলার রুহুল আমিন খান রুমিসহ মোট সাতজন মারা যান।
২০০৯ সালের ২৬ জানুয়ারি হবিগঞ্জ বানিপুর এলাকার ইউনুছ মিয়া, ৮ মে ঢাকার মিরপুরের ফারুক আহমদ, ২১ জুন নরসিংদী সদর এলাকার সজিব মিয়াসহ মোট তিনজন মারা যান। ২০০৮ সালের ৯ নভেম্বর ঢাকার পল্লবী এলাকার দিলশাদ আহমেদ ও ২০০৬ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারী গোয়াইনঘাট উপজেলার মুসা মিয়া, ১৬ আগস্ট একই উপজেলার ফখরুল ইসলামসহ দুইজন মারা যান।
এছাড়া ২০০৪ সালে ২ জন, ২০০৫ সালে ১জন এবং ২০০৭ সালে ২ জন পর্যটকের মৃত্যু হয়। ২০০৩ সালের ১৫ আগস্ট জাফলংয়ের পিয়াইন নদীতে ডুবে প্রাণ হারান শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রেজাউর রহমান ফয়সাল ও রাজন আহমদ।