এখন পশ্চিমতীর ও গাজা ইসরাইলের অঙ্গ হয়ে ওঠার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। এ কথা জেনে, গাজায় খাঁচায় বন্দী ইসরাইলিরা এখন তৃণমূলে ইসরাইল থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরত্বে আন্দোলনে মেতে উঠেছে তাদের বাড়িঘর ও সম্পদে ফিরে যাওয়ার অধিকারের দাবিতে। ফিলিস্তিনিরা চায় জাতিসঙ্ঘের ১৯৪ নম্বর প্রস্তাব অনুযায়ী তাদের বাড়িঘর ও সম্পদ ফিরে পেতে। কিন্তু ইসরাইলিরা আন্দোলনরত গাজাবাসীদের নির্মমভাবে পুশব্যাক করছে। অপর দিকে ‘ডিল অব দ্য সেঞ্চুরি’ আবছা আবছা ভাসছে দিগন্তে। এমনি পরিস্থিতিতে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, ফিলস্তিনি জনগণের জন্য পরবর্তী কী করণীয় অপেক্ষা করছে?
জাতিসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদের ১৯৪ নম্বর প্রস্তাবটি গৃহীত হয় ১৯৪৮ সালের ১১ ডিসেম্বরে, ১৯৪৮ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধের প্রায় শেষ দিকে। এই প্রস্তাবে সংজ্ঞায়িত করা হয় চূড়ান্ত নিষ্পত্তিতে পৌঁছার ও ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের নিজেদের বাড়িঘরে ফিরে আসার নীতি। প্রস্তাবে বলা হয়, যেসব শরণার্থী দেশে ফিরে এসে শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবেশীদের সাথে বসবাস করতে চায়, তাদের যথাসম্ভব বাস্তবসম্মত সময়ে ফিরে আসতে দিতে হবে। আর যারা দেশে ফিরে আসতে চাইবে না, সরকার বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে তাদের সম্পদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে আন্তর্জাতিক আইন বা ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে (অনুচ্ছেদ ১১)। প্রস্তাবে আরো আহ্বান রাখা হয়, ইসরাইল ও আরব দেগুলোর মধ্যে শান্তি বজায় রাখার লক্ষ্যে ‘ইউনাইটেড ন্যাশনস কনসিলেশন কমিশন’ গঠনের। তখন জাতিসঙ্ঘের ৫৮টি সদস্য দেশের ভোটের মাধ্যমে এ প্রস্তাবটি গৃহীত হয়। ৩৫টি দেশ প্রস্তাবের পক্ষে ও ১৫টি দেশ বিপক্ষে ভোট দেয়। আটটি দেশ ভোটদানে বিরত থাকে।
উল্লেখ্য, ৬টি আরব লীগ দেশ- মিসর, ইরাক, লেবানন, সৌদি আরব, সিরিয়া ও ইয়েমেন তখন জতিসঙ্ঘে প্রতিনিধিত্ব করছিল। এসব দেশ এই দ্বন্দ্বে সংশ্লিষ্ট ছিল এবং এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছিল। অন্য যে গ্রুপটি এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছিল, সেগুলো কমিউনিস্ট ব্লকের দেশ- বাইলোরেশিয়ান এসএসআর, চেকোস্লেøাভাকিয়া, পোল্যান্ড, ইউক্রেনিয়ান এসএসআর, ইউএসএসআর ও যুগোস্লাভাকিয়া। এসব দেশের সবগুলোই এরই মধ্যে ইসরাইলকে ডি জুরি দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল। তখন ইসরাইল জাতিসঙ্ঘের সদস্য রাষ্ট্র ছিল না। ইসরাইল তখন এই প্রস্তাবের অনেক অনুচ্ছেদের বিরোধিতা করেছিল। তখন এসব বিষয় নিয়ে ফিলিস্তিনিদের সাথে সরাসরি কোনো আলোচনা করা হয়নি।
বিস্ময়করভাবে এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষিত না হলেও এটি স্ফটিকের মতো স্পষ্ট, এরই মধ্যে ট্রাম্প প্রশাসন মাঠে নেমে পড়েছে ‘ডিল অব দ্য সেঞ্চুরি’ নামের তথাকথিত শান্তি পরিকল্পনা নিয়ে। যদিও এই পরিকল্পনা এখনো সেভাবে প্রকাশ্যে গণমাধ্যমে আসেনি। শোনা যাচ্ছে, তা আগামী জুনে ট্রাম্প প্রশাসন এই পরিকল্পনা ঘোষণা করবেন। গত ১৫ এপ্রিল ওয়াশিংটন পোস্টে প্রকাশিত একটি খবর মতে, দীর্ঘ প্রতীক্ষিত এই ডিল অব দ্য সেঞ্চুরিতে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের কোনো উল্লেখ যে থাকছে না সেটি নিশ্চিত। যেমনটি শোনা যাচ্ছে, এই তথাকথিত শান্তি-পরিকল্পনা যদি সেভাবে ঘোষিত হয়, তবে মূলধারার ফিলিস্তিনি জনগণকে তা চরমভাবে ক্ষুব্ধ করবে এবং সেখানে আরেকটি ইন্তিফাদার জন্ম নেবে। আর এই ইন্তিফাদার কেন্দ্রে থাকবে ফিলিস্তিনি জনগণের সম্মিলিত সার্বিক অধিকার আদায়ের দাবি।
এটি স্পষ্ট হয়ে গেছে, ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতা অর্জন ও স্বাধীন-সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের অনিবার্য দায়িত্বটি অবধারিত হয়ে পড়ছে ফিলিস্তিনিদেরই ওপর। ফিলিস্তিনিদের আগ্রহের প্রশ্ন হচ্ছে- কারা ওসলো চুক্তির বিপর্যয়কর ধ্বংসাত্মক পরিণতি ঠেকাতে সক্ষম? কারা ইসরাইলকে নিয়ে আসতে পারবে দায়বদ্ধতা বা জবাবদিহির আওতায়? কারা শুধু রুলিংয়ের পর রুলিং জারি করার পরিবর্তে প্রণয়ন করতে পারবে তৃণমূলের আন্দোলনের সুদৃঢ় ও অপরিবর্তনীয় নীতি-কৌশল? কারা এই নীতিকৌশল বাস্তবায়নে থাকবে অবিচল? কারা ইসরাইলকে বাধ্য করতে সক্ষম হবে দুই-রাষ্ট্র পরিকল্পনা বাস্তবায়নে? কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, তা সম্ভব করে তুলতে চাইলে ফিলিস্তিনিদের অতীতের রাজনৈতিক কাঠামোর জটিলতাসংশ্লিষ্ট ব্যর্থতা কাটিয়ে উঠতে হবে। এ ক্ষেত্রে যদি সব কৌশলেরই পতন ঘটে, তখন কোনো রাজনৈতিক ব্লক অধিকতর শক্তিশালী হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে ? এ প্রসঙ্গে পরে আসছি। এর আগে মার্কিন প্রশাসনের ‘ডিল অব দ্য সেঞ্চুরি’ সম্পর্কে আজ পর্যন্ত যেটুকু জানা গেছে, সে সম্পর্কে দু-একটি কথা।
ডিল অব দ্য সেঞ্চুরি হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পিত তথাকথিত আরব-ইসরাইল আঞ্চলিক শান্তি পরিকল্পনা। ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য শান্তিদূত ও জামাতা কুশনার এরই মধ্যে এই ডিল অব দ্য সেঞ্চুরি প্রকাশের ক্ষেত্র তৈরি করার জন্য মধ্যপাচ্য সফর করেছেন। যুক্তরাষ্ট্র এর দূতাবাস তেলআবিব থেকে জেরুসালেম স্থানান্তরের পর মাহমুদ আব্বাস মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইল-আরব শান্তি প্রতিষ্ঠার সক্ষমতা হারিয়েছে। তখন থেকে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সাথে যোগাযোগ বন্ধ রেখেছেন। ফিলিস্তিনি পত্রিকার সাথে এক বিরল সাক্ষাৎসারে কুশনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, শিগগিরই এই পরিকল্পনা প্রণয়ন করবেন। তখন তিনি ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের ব্যাপক সমালোচনা করেন।
যুক্তরাষ্ট্র উপসাগরীয় দেশগুলোর ওপর চাপ সৃষ্টি করে চলেছে গাজার অর্থনৈতিক প্রকল্পে বিনিয়োগের ব্যাপারে। বলা হচ্ছে, সৌদি আরব মাহমুদ আব্বাসকে প্রস্তাব দিয়েছে ফিলিস্তিনে মানবিক সহায়তায়, অর্থ দেয়ার জন্য এবং এর বিনিময়ে ট্রাম্পের এই শান্তি পরিকল্পনার প্রতি সমর্থন জানাতে। এই পরিকল্পনার বিস্তারিত এখনো প্রকাশ করা হয়নি। তবে ফাঁস হয়ে যাওয়া তথ্য মতে, এই পরিকল্পনা অনুসারে ফিলিস্তিনকে এর ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রের রাজধানী হিসেবে পূর্ব জেরুসালেমের দাবি পরিত্যাগ করতে হবে। ইসরাইল জেরুসালেমের পূর্ব ও উত্তরের কয়েকটি গ্রাম থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেবে, কিন্তু পুরনো জেরুসালেম নগরীর ওপর পুরো নিয়ন্ত্রণ থাকবে ইসরাইলের হাতে। প্রস্তাবিত ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে বেসামরিকীকরণ করতে হবে।
কিন্তু ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে গড়ে তোলা অবৈধ ইহুদি ইসরাইলি বসতিগুলো যথাস্থানেই থেকে যাবে। জর্দান উপত্যকা থাকবে ইসরাইলের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। ফিলিস্তিনিরা আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে তাদের স্বদেশে ফিরে আসার দাবি পরিত্যাগ করতে হবে। তথাকথিত এই পরিকল্পনা যেকোনো ধরনের প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দেবে এবং অস্বীকার করবে ফিলিস্তিনিদের যাবতীয় অধিকার। মোট কথা, এই পরিকল্পনা ফিলিস্তিনি জাতিকে ধ্বংস করার নতুন এক মহাপরিকল্পনা, যা কোনো ফিলিস্তিনি মেনে নিতে পারে না। এই ডিল ফিলিস্তিনিদের নিশ্চিত সংক্ষুব্ধ করে তুলবে।
তথাকথিত ‘ডিল অব দ্য সেঞ্চুরির’ বেশ কিছু মৌলিক উপাদান সম্পর্কে সুপরিচিত কিছু ব্যক্তির সাথে কথা বলেছেন ওয়াশিংটন পোস্ট প্রতিনিধি। সেখানে এসব বিষয়ের প্রতিফলন মেলে। এরা জানিয়েছেন- বলা হচ্ছে, এই ‘ডিল অব দ্য সেঞ্চুরি’ নামের তথাকথিত শান্তি পরিকল্পনা হচ্ছে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের। কিন্তু এই পরিকল্পনার কুশীলব হচ্ছে তারই জামাতা জ্যারেড কুশনার ও যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক সমঝোতা সংক্রান্ত, বিশেষ প্রতিনিধি জ্যাসন গ্রিনব্ল্যাট। জানা গেছে, এ পরিকল্পনা পশ্চিমতীর ও গাজা উপত্যকায় একটি পরিপূর্ণ স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিষয়টি থামিয়ে দিতে যাচ্ছে পাকাপোক্তভাবে। ট্রাম্পের ‘ডিল অব দ্য সেঞ্চুরি বলছে : কোনো ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র নয়। সার্বভৌমত্ব নয়, স্বায়ত্তশাসন। ব্যাপক অর্থনৈতিক প্যাকেজ। এসব কথা নিয়েই জুনে আসছে এই তথাকথিত শান্তি পরিকল্পনা। আরব ও ইউরোপিয়ানেরা এর বিরুদ্ধে। ইসরাইল অবশ্যই এ পরিকল্পনা নিয়ে মহাখুশি।
এসব কথা জানিয়ে এ সম্পর্কিত ওয়াশিংটন পোস্টে প্রতিবেদন ছাপা হয়ছে গত ১৫ এপ্রিল। কুশনারের সাথে সুপরিচিত আরব কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, কুশনার তাদের সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব না দিলেও এই পরিকল্পনাকে অভিহিত করেছেন ‘ফিলিস্তিনিদের জন্য একটি অর্থনৈতিক সুযোগ’ হিসেবে। তবে তিনি জানিয়েছেন, একই সাথে বিতর্কিত ভূখণ্ডে ইসরাইলের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হতে হবে। প্রতিবেদনে আরো জানানো হয়, কুশনার ও মার্কিন কর্মকর্তারা শান্তি ও অর্থনৈতিক উন্নয়নকে সম্পর্কিত করেছেন আরবদের পক্ষ থেকে ইসরাইলকে স্বীকৃতি দানের বিষয়টিকে এবং ফিলিস্তিনিদের সার্বভৌমত্বের (সভরেন্টি) বিপরীতে স্বায়ত্তশাসনকেই (অটোনমি) মেনে নিতে হবে। ওয়াশিংটন পোস্ট বিশেষভাবে উল্লেখ করে ‘ডিল অব দ্য সেঞ্চুরি’ নামে অভিহিত যুক্তরাষ্ট্রের এই ইসারাইল-ফিলিস্তিন শান্তি চুক্তিতে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। অতএব ফিলিস্তিনিদের জন্য অবশেষ রয়েছে একটি মাত্রই পথ, জনগণের আন্দোলনের মধ্য দিয়েই অর্জন করত হবে তাদের স্বাধীনতা, স্বাধীন ফিলিস্তিন, নিজেদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার। এর কোনো বিকল্প আছে বলে মনে হয় না। এখন প্রশ্ন হচ্ছে এ জন্য ফিলিস্তিনি জনগণ কতটুকু প্রস্তুত?
পিএফএলপি প্রসঙ্গ
পুরো কথায় পিএফএলপি হচ্ছে ‘পপুলার ফ্রন্ট ফর দ্য লিবারেশন অব প্যালেস্টাইন’। আজকের দিনে ফাতাহ (‘ফাতেহ’ নামেও অভিহিত হয়) ও হামাস ছাড়াও এই শূন্যতা পূরণে রাজনৈতিক মঞ্চ থেকে মাহমুদ আব্বাসের (৮৩) বিদায়ের পর রাজনৈতিক শক্তিশালী দল হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি এই পিএফএলপির। এটি ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার বৈপ্লবিক কৌশল প্রকাশ করে ১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে। এই কৌশল ফাতাহর প্র্যাগমেটিক ও কনসেশন-বেইজড (কার্যসিদ্ধিমূলক ও ছাড়ভিত্তিক) উদ্যোগ থেকে আলাদা।
পিএফএলপির কৌশলে জোর দিয়ে বলা হয়, এরা দৌড়ের আরম্ভরেখা থেকে শুরু করে না। ভাবনা-চিন্তায়, ইতিহাসে ও লড়াই-সংগ্রামে এদের কাছে কোনো জিরো-পয়েন্ট নেই। আর এই ফ্রন্ট হচ্ছে একটি ডেমোক্র্যাটিক রেভ্যুলিউশনারি পার্টি (গণতান্ত্রিক বিপ্লবী দল), যার রয়েছে অর্ধ শতাব্দীর সমৃদ্ধ ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা। যুদ্ধ ও দ্বন্দ্বের মধ্যেও এটি বসবাস করেছে স্থায়ী ও অব্যাহত অভিজ্ঞতার মধ্যে। ভুল হোক, সঠিক হোক অর্ধ শতাব্দীর এগিয়ে চলায় অর্জন অথবা ব্যর্থতার মধ্যেও এটি চেষ্টা করেছে পরিস্থিতিকে এই বৈপ্লবিক দলটির সাধারণ লক্ষ্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ রাখতে। আর এটিই হচ্ছে একটি দলের প্রগতি ও প্রবৃদ্ধির জন্য অপরিহার্য।
পিএফএলপির জেনারেল সেক্রেটারি আহমেদ সা’দাত ১৩ বছর ছিলেন ইসরাইলের কারাগারে। এখন তার চারপাশে রয়েছে তাদের লড়াই চালিয়ে নেয়ার মতো সুদৃঢ়চিত্তের কমরেডরা। তাদের আরেক নেত্রী খালেদা জেরার। তিনি সম্প্রতি মুক্তি পেয়েছেন ইসরাইলের প্রশাসনিক আটকাবস্থা থেকে। তিনিও আন্দোলনের ব্যাপারে দৃঢ়চেতা। আজকের এই সময়ে ফিলিস্তিনে যা ঘটছে, তা ধ্বংসাত্মক। এর পরও আশা জাগার মতো অনেক কিছু আছে।
২০১২ সালে জাতিসঙ্ঘ স্বীকৃতি জানায় স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রে ফিলিস্তিনিদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের প্রতি এবং স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের প্রতিও। কিন্তু গোপন যেসব বিষয় রাজনৈতিকভাবে প্রকাশিত হয়ে পড়ছে, পশ্চিমতীর ও গাজা উপত্যকায় যা ঘটে চলেছে তাতে এটি নিশ্চিত- এই স্বীকৃতির কোনো বাস্তবায়ন ফিলিস্তিনে ঘটছে না।
এখন ফিলিস্তিনে এসেছেন নয়া প্রধানমন্ত্রী গড়যধসসধফ ঝযঃধুুবয, যার রাজনৈতিক অ্যাফিলিয়েশন বা সংযুক্তি রয়েছে ফাতাহর সাথে। আর এ পার্টি নিয়ন্ত্রণ করে ফিলিস্তিনি কর্র্তৃপক্ষকে। এই পার্টি মাহমুদ আব্বাসের অনুগত, যার জনসমর্থন ও প্রাসঙ্গিকতার মাত্রা তত বেশি নয়। ফাতাহ পরিচালিত হয় এমন শক্তিধরদের দিয়ে, যারা নিজেদের স্বার্থে দুর্নীতি ও দখলদারিত্ব অবলম্বনের জন্য খ্যাত। প্যালেস্টানিয়ান লিবারেশন অরগ্যানাইজেশনকে (পিএলও) ধরে নেয়া হতো প্রবাসী ফিলিস্তিনিসহ সব ফিলিস্তিনির প্রতিনিধিত্বকারী একটি সংগঠন হিসেবে। এটিতেও আছে ফাতাহর প্রাধান্য। এর ন্যাশনাল কাউন্সিল ২০১৮ সালের ৪ মার্চ পিএলও নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচিত করেছে মাহমুদ আব্বাসকে। মনে রাখতে হবে, হামাস কিংবা ফাতাহ (প্যালেস্টানিয়ান অথোরিটির আকারে) ধারণ করে পলিটিক্যাল অটোনমি, অর্থনৈতিকভাবেও। অন্য দিকে ইসরাইলের একক নিয়ন্ত্রণ রয়েছে বাহ্যিক সীমান্ত ও ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের জন্য আমদানি কর ও ভ্যাট আদায়ের ব্যাপারে। তা ভালোভাবেই চলে যেতে পারে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের ওপর।
ফিলিস্তিনি প্রতিনিধিত্বের প্রেক্ষাপট
এটি অনুধাবন খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে, দখল করা ভূখণ্ডে ফিলিস্তিনি সরকার এর বৈধতা লাভ করে পিএলওর কাছ থেকে। পিএলও গঠিত হয় ১৯৬৪ সালের ২ মে। লক্ষ্য ছিল জাতীয় সনদের আওতায় ফিলিস্তিনিদের রাজনৈতিক আন্দোলনকে একটি ইউনিটের আওতায় নিয়ে আসা। ফিলিস্তিনিদের জাতীয় সনদ বা ন্যাশনাল চার্টারের ২ নম্বর অনুচ্ছেদে ঘোষণা ছিল : ‘Palestine, with the boundaries it had during the British Mandate, is an indivisible territorial unit’। ফিলিস্তিনি ন্যাশনাল চার্টারে ইসরাইলিদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ কৌশল হিসেবে সশস্ত্র সংগ্রামকে বৈধতা দেয়া হয় এবং এর প্রতি নৈতিক সমর্থনও জ্ঞাপন করা হয়। পিএলওর সৃষ্টির ব্যাপারটি অংশত এগিয়ে আসে ফিলিস্তিনিদের ধ্বংসাত্মক প্রচলিত রাজনৈতিক ও সামরিক উদ্যোগ থেকে বের হয়ে আসার কৌশল হিসেবে ১৯৪৮ সালের একটি ‘অ্যারাব হাইয়ার কমিটির’ প্রত্যাশা থেকে। পিএলও দ্রুত এগিয়ে গেল তখন, যখন ১৯৭২ সালে ইসাম সাখনিনি এটি নিয়ে আসেন একটি ‘অটোনোমাস অ্যাকশন’ হিসেবে, যার মাধ্যমে ফিলিস্তিনি জনগণ সরাসরি নিজেরাই সমাধান করবে তাদের সমস্যা, প্রতিভূ কোনো শাসক দিয়ে নয়।
প্রথম দিকে ফিলিস্তিনি গ্রুপগুলো এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে পিএলওর নতুন নেতারা আসার পর গেরিলাযুদ্ধের প্রতি সমর্থন জানান। তখন ফাতাহ প্রধান ইয়াসির আরাফাত হন পিএলওর চেয়ারম্যান। তখন ফাতাহ ও জনপ্রিয় ফ্রন্ট পিএফএলপি রাজনৈতিকভাবে উল্লেখযোগ্য লাভবান হয়।
সব কিছু পাল্টে যায় যখন ওসলো চুক্তি প্রতিষ্ঠিত হয় ইসরাইল সরকার ও পিএলওর মধ্যে। তখন পিএলও ফিলিস্তিনি জনগণের একমাত্র বৈধ প্রতিনিধি হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার পর এই সমঝোতা চুক্তিতে প্রবেশের আগেই তেমন কিছু ক্ষেত্রে ছাড় দেয়, যেগুলো এমনকি জাতিসঙ্ঘেও স্বীকৃত অধিকার ছিল। ওসামাহ খলিল ‘Oslo’s Roots : Kissinger, the PLO, and the Peace Process – Al-Shabaka-এ দেখিয়েছেন- পিএলও নেতারা, বিশেষ করে ফাতাহর মুখ্য ব্যক্তিত্বরা চেয়েছেন ফিলিস্তিনি বিভিন্ন বিবদমান গোষ্ঠীর স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে হলেও ওয়াশিংটনের সাথে একটি সম্পর্ক গড়ে তুলতে।
২০১৭ সালে ফিলিস্তিনিদের পলিসি নেটওয়ার্ক ‘আল-শাবাকা’ ‘পিএলও অ্যান্ড প্যালেস্টিনিয়ান রিপ্রেজেন্টেশন’ বিষয়ে একটি গোলটেবিল আলোচনার আয়োজন করে। এতে তিনটি বিষয়ে আলোচনা হয় : রিফর্মিং পিএলও, রিপ্রেজেন্টেশন আন্ডার ওকুপেশন, লিডারশিপ টু হোয়াট অ্যান্ড। আল-শাবাকা একটি স্বাধীন, নির্দলীয়, অলাভজনক প্রতিষ্ঠান, যার মিশন হচ্ছে ফিলিস্তিনিদের অধিকার ও আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক আইন-কাঠামোর আওতায় জনবিতর্কের আয়োজন করা।
আজকের দিনে পিএলওতে রয়েছে ফাতাহর প্রাধান্য। কারণ, ফিলিস্তিনিদের মুক্তি আন্দোলনে এর রয়েছে প্রতিনিধিত্বশীল বৈপ্লবিক উদ্যোগ, সেই ওসলো চুক্তির পর থেকে। এখন ওসলো চুক্তি তাদের দুই দশক ধরে পেছনে ঠেলে দিয়েছে। এই চুক্তি এখন মৃত। সেজন্য বলার অপেক্ষা রাখে না, সব ফিলিস্তিনির প্রতিনিধিত্বের প্রয়োজনে পিএলওর সংস্কার অপরিহার্য।