বৈশাখের গরম হাওয়ায় উত্তপ্ত সারাদেশ। সে উত্তাপ ছড়িয়ে পড়েছে রাজধানীর কাঁচাবাজারেও। রোজাকে সামনে রেখে হু হু করে বাড়ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় অধিকাংশ পণ্যের দাম। পেঁয়াজ, রসুনের দাম বেড়েই চলেছে। দাম বেড়েছে মাছ-মুরগিরও। গরমের তীব্রতায় অসুখ-বিসুখ ছড়িয়ে পড়ায় নতুন করে দাম বেড়েছে ঠাণ্ডাজাতীয় সবজির। রোগীর সবজি হিসেবে পরিচিত কাঁচা পেঁপের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৪০ থেকে ৫০ টাকা দরে। গরমের রোগবালাই থেকে রক্ষায় ৮০ থেকে ১০০ টাকা কেজি দরে করল্লা কিনে খাচ্ছেন সাধারণ মানুষ। ১০০ থেকে ১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে উস্তে। সমপরিমাণ টাকা গুনতে হচ্ছে এক কেজি সজনে কেনার জন্য। বরবটি, পটোল, ঝিঙা, কচুর লতি প্রভৃতি ৬৫ থেকে ৭৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
দাম বেড়েছে সব ধরনের শাকেরও। ছোট আকারের প্রতি আঁটি লালশাক, পাটশাক, ডাঁটাশাক প্রভৃতি বিক্রি হচ্ছে ১০ টাকায়। লাউ শাক ও পুঁইশাক বিক্রি হচ্ছে ৩০ টাকা আঁটি দরে। লেবুর দাম আগে থেকে বাড়তি। এক হালি গোল লেবু ৩০ থেকে ৪০ এবং লম্বা লেবু ৪০ থেকে ৬০ টাকায় বিক্রি করতে দেখা যায়। ৬০ থেকে ৮০ টাকা বিক্রি হচ্ছে প্রতিটি লাউ। বিক্রেতারা জানান, ক্রেতাদের আগ্রহ এখন করল্লা, উস্তে, ঢেঁড়স, কচুর লতি প্রভৃতির দিকে। এগুলোর দাম ৮০ থেকে ১০০ টাকার মধ্যে। এক পোয়া কাঁচা মরিচ ও ধনিয়া পাতা বিক্রি হচ্ছে ২০ থেকে ২৫ টাকায়। প্রতি কেজি শসার দাম ১০ টাকা বেড়ে হয়েছে ৫০ থেকে ৬০ টাকা।
বিভিন্ন পর্যায়ের ক্রেতা-বিক্রেতার সাথে কথা বলে জানা যায়, দাম বৃদ্ধির তালিকায় রয়েছে পেঁয়াজ, রসুন, আদা, ভোজ্যতেল, বিভিন্ন প্রকারের ডাল, গরু, মুরগি, খাসির গোশত এবং বিভিন্ন প্রকারের মসলার নাম। নিত্যপণ্যের এই মূল্যবৃদ্ধির জন্য পাইকাররা খুচরা ব্যবসায়ীদের এবং খুচরা বিক্রেতারা পাইকারদের দায়ী করলেও মূলত বাজার ব্যবস্থাপনায় অনিয়ম এবং আসন্ন রমজান মাসকে সামনে রেখে ব্যবসায়ীদের মজুদদারি বৃদ্ধির কারণেই বেশির ভাগ পণ্যের দাম বাড়ছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। তবে তীব্র গরমের কারণে চাহিদা কমে যাওয়ায় চলতি সপ্তাহে ডিমের দাম কিছুটা কমেছে বলে জানান বিক্রেতারা।
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণ জানাতে গিয়ে পুরনো ঢাকার মৌলভীবাজারের পাইকারি দোকানদার হাবিবুর রহমান গতকাল বলেন, গত কয়েক দিনে পাইকারি বাজারে কিছু পণ্যের বিক্রি প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। মূলত খুচরা বিক্রিতারা রমজারের জন্য পণ্য মজুদ করতে গিয়েই এমন কেনাকাটা করছেন। তারা এখন ধারদেনা করে সাধ্যমতো পণ্য মজুদ করছেন রমজানে বাড়তি দামে বিক্রির আশায়। অনেকে আবার চড়া সুদে টাকা নিয়ে পণ্য মজুদ করছেন। রমজান উপলক্ষে কিছু মানুষের অতিরিক্ত ভোগ করার মানসিকতা তৈরি হয় জানিয়ে তিনি বলেন, তাদের কারণেই মজুদদাররা বাড়তি মুনাফা লোটার সুযোগ পায়।
আসন্ন রমজান মাসকে সামনে রেখে গত ২৭ মার্চ সচিবালয়ে শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ীদের নিয়ে বৈঠক করেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। বৈঠকে রমজানে পণ্যের দাম বাড়ানো হবে না বলে আশ্বাস দিয়েছিলেন ব্যবসায়ীরা। তখন ব্যবসায়ীরা জানিয়েছিলেন, দেশে সব পণ্যেরই পর্যাপ্ত মজুদ ও সরবরাহ স্বাভাবিক রয়েছে। ব্যবসায়ীদের প্রতি আস্থা রেখে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশিও সাংবাদিকদের বলেছিলেন, আসন্ন রমজানে নিত্যপণ্যের দাম বাড়বে না। তিনি আরো জানান, এবার সিন্ডিকেটের সুযোগ নেই। বাজারে সবার মধ্যে প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করে পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে হবে। পবিত্র রমজান মাসের আগে পণ্যের অবৈধ মজুদ ও দাম বৃদ্ধির সুযোগ দেয়া হবে না। কিন্তু বাজারের পরিস্থিতি ভিন্ন।
গত সপ্তাহে ৫০ থেকে ৫২ টাকায় বিক্রি হওয়া চিনি গতকাল বিক্রি হয় ৫৬ থেকে ৫৮ টাকা দরে। ২৫ টাকার পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৩০ থেকে ৩৫ টাকায়। ১৫ টাকার আলু বিক্রি হচ্ছে ২০ থেকে ২২ টাকা। কেজিতে ১০ টাকা বাড়িয়ে ৯০ টাকার রসুন বিক্রি করা হচ্ছে ১০০ টাকায়। একই হারে বেড়েছে মসুর ডালের দামও। ৯০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১০০ টাকায় বিক্রি করতে দেখা যায় খুচরা ব্যবসায়ীদের। গরুর গোশত ৫২০ থেকে বাড়িয়ে বিক্রিকরা হচ্ছে ৫৫০ টাকা কেজি দরে। বেড়েছে মুরগি ও খাসির দামও। চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় দাম বেড়েছে সব ধরণের মসলারও।
বাজার বিশ্লেষণে দেখা যায়, রসুনের দামও কেজিতে ১৫ টাকা বেড়ে আমদানি করা চীনা রসুন ১০০ টাকা ও দেশী রসুন ৭০ থেকে ৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। একই সাথে দেশী মসুর ডালের দামও কেজিতে ১০ টাকা বেড়ে ৯৫ থেকে ১০০ টাকায় পৌঁছেছে। সপ্তাহের ব্যবধানে বাজারে কিছু মসলার দামও বাড়তি রয়েছে। কেজিতে ১৫০ টাকা বেড়ে দুই হাজার ২০০ থেকে দুই হাজার ৬০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে এলাচ। জিরা, দারুচিনি, বাদামসহ অন্যান্য মসলা কেজিতে ২০ থেকে ৩০ টাকা বেড়েছে বলে জানান খুচরা বিক্রেতারা।
গতকাল ঢাকার কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা যায়, রমজানের অন্যতম জনপ্রিয় পণ্য ছোলার দাম এক মাসের ব্যবধানে কেজিতে ৫ থেকে ১০ টাকা বেড়ে গেছে। এক মাস আগে মান ভেদে প্রতি কেজি ছোলা ৭৫ থেকে ৮০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। গতকাল রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে ছোলা ৮০ থেকে ৯০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে। যদিও কোনো কোনো বাজারে ৭৫ টাকা কেজি দরেও বিক্রি হতে দেখা গেছে। বিক্রেতারা জানান, দেশে ছোলার পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে। আরো কয়েক দিন গেলে বাজার স্থিতিশীল হয়ে আসবে। রমজান উপলক্ষে সব ব্যবসায়ী উন্নতমানের পণ্য আমদানি করে। এ কারণে দাম একটু বেড়েছে বলেও জানান ব্যবসায়ীরা।
বাজার বিশ্লেষণে দেখা যায়, এতে সপ্তাহের ব্যবধানে পাইকারিতে বস্তাপ্রতি চিনির দাম প্রায় ১৫০ টাকা বেড়েছে। এখন প্রতি বস্তা বিক্রি হচ্ছে আড়াই হাজার টাকায়। পাইকারিতে তিন টাকা বেড়ে কেজিতে দাম পড়ছে ৫০ টাকা। খুচরায় তা গড়ে ছয় টাকা বেড়ে ৫৬ থেকে ৫৮ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। আগের সপ্তাহে খুচরায় প্রতি কেজি চিনি ৫০ থেকে ৫২ টাকা ছিল। বিক্রেতাদের দাবি, এক সপ্তাহ ধরে মিলগুলো থেকে যথাসময়ে চিনি সরবরাহ করা হচ্ছে না। চিনি আনার জন্য ট্রাক গেলে মিল গেটে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে ৫ থেকে ৭ দিন। তার পরও চিনি দিতে টালবাহানা করা হচ্ছে। এ কারণে চিনি সংগ্রহ করতে খরচ ও দাম বেড়ে গেছে। মিলমালিকদের দাবি, রোজার আগে এ সময়ে অতিরিক্ত চাহিদার কারণে মিলে একসাথে অনেক গাড়ি আসায় কিছুটা চাপ তৈরি হয়েছে। কোম্পানির পক্ষ থেকে দাম বাড়ানো হয়নি।
বিক্রেতারা জানান, রোজায় বেশি চাহিদা থাকায় খুচরা বাজারে পেঁয়াজের দাম কেজিতে ১০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। গতকাল প্রতি কেজি দেশী পেঁয়াজ ৩২ থেকে ৩৮ টাকায় বিক্রি হয়; যা আগের সপ্তাহে ছিল ২২ থেকে ৩০ টাকা। আর আমদানি করা ভারতীয় পেঁয়াজের দামও কেজিতে ৫ টাকা বেড়ে ২৫ টাকা হয়েছে। তারা জানান, এত দিন মুড়িকাটা পেঁয়াজের দর কিছুটা কম ছিল। এখন হালিকাটা (বীজ থেকে) পেঁয়াজ উঠেছে। এ পেঁয়াজ সংরক্ষণ করা হচ্ছে। এতে বাজারে দাম বেড়ে গেছে। তা ছাড়া রোজার আগে বাড়তি চাহিদায় বাজারে দাম কিছুটা বাড়তি রয়েছে। চাহিদা আরো বাড়লে পেঁয়াজের দাম আরো বাড়তে পারে বলে ধারণা করছেন তারা।