দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগ এনে জাহিদুর রহমান জাহিদকে বহিস্কার করেছে বিএনপি। শনিবার গুলশানে দলের চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত বিএনপির সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠক শেষে এই সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী ঠাকুরগাঁও-৩ আসন থেকে নির্বাচিত হয়ে দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে জাহিদুর শপথ নিয়েছে। এতে বিএনপির ভেতর তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়।
মির্জা ফখরুল বলেন, আজকের বৈঠকে বিশিষ্ট সাংবাদিক মাহফুজ উল্লাহর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করা হয়েছে। তার শোক সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানানো হয়েছে। তিনি বলেন, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে সেটি হলো, আমাদের দলের সিদ্ধান্ত ছিল যারা সংসদ নির্বাচনে নির্বাচিত ঘোষিত হয়েছেন তারা সংসদে শপথ নেবেন না। এই সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করে ঠাকুরগাঁও -৩ আসনের সদস্য জাহিদুর রহমান শপথ নেয়ার জন্য তাকে সর্বসম্মতভাবে আজকে প্রাথমিক সদস্য পদসহ দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।’
এর আগে রাত সাড়ে আটটা থেকে এক ঘণ্টারও বেশি সময় বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার, লে. জেনারেল অব. মাহবুবুর রহমান, মির্জা আব্বাস, ড. আবদুল মঈন খান, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, নজরুল ইসলাম খান, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী।
একাদশ সংসদ নির্বাচনে মাত্র ছয়টি আসন পেয়েও চাপের মধ্যে রয়েছে বিএনপি। ‘ভোট ডাকাতির’ ওই নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে দলটি সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, তাদের নির্বাচিতরা সংসদে যাবেন না। কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করেই সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নিয়েছেন ঠাকুরগাঁও-৩ আসন থেকে নির্বাচিত জাহিদুর রহমান।
বগুড়া-৬ আসন থেকে নির্বাচিত বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম বাদে অন্য চারজনও শপথ গ্রহণের পক্ষে রয়েছেন বলে শোনা যাচ্ছে। ‘জনগণের চাপ’ রয়েছে এমন কথা বলে এই চারজন শপথ গ্রহণের পক্ষে ‘ইনিয়ে-বিনিয়ে’ যেসব বক্তব্য দিচ্ছন, তার পেছনে সরকারি দলের হাত রয়েছে বলে মনে করছে বিএনপি।
পাশাপাশি এদের কারো কারোর মধ্যে প্রথমবারের মতো নির্বাচিত হয়ে এমপি হওয়ার স্বাদ গ্রহণের তীব্র ইচ্ছা ও লোভ কাজ করছে বলেও কেউ কেউ বলছেন। তবে কারণ যা-ই হোক দলীয় সিদ্ধান্ত না মেনে শপথ নেয়ার পক্ষে বিভিন্ন যুক্তি দাঁড় করানোয় বিব্রত অবস্থায় পড়েছে বিএনপির হাইকমান্ড।
এ অবস্থায় শনিবার সন্ধ্যায় দলের সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এ বৈঠক থেকে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
বিএনপির নির্বাচিতদের শপথ গ্রহণের ইস্যু নিয়ে বেশ কিছু দিন ধরেই রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা গুঞ্জন চলছিল। বলা হচ্ছিল, বেগম খালেদা জিয়া প্যারেলো মুক্তি পাবেন আর সংসদে যাবেন বিএনপির নির্বাচিতরা। ১৪ মাস ধরে কারাবন্দী বেগম জিয়ার মুক্তির এখনো পর্যন্ত কোনো কূল কিনারা হয়নি।
বিএনপির নেতারা বলেছেন, ‘খালেদা জিয়া প্যারোলে মুক্তি নেবেন না। সরকার বাধা না দিলে তিনি জামিনেই মুক্তি পাবেন।’ প্রক্রিয়া যা-ই হোক খালেদা জিয়ার মুক্তির পথে নানা অনিশ্চয়তা রয়েছে। কিন্তু আগামী ২৯ এপ্রিলের মধ্যে নির্বাচিতদের শপথ নেয়ার একটি বাধ্যবাধকতা থাকায় বিএনপির ইচ্ছুকদের মধ্যে এক ধরনের তাড়না কাজ করছিল। গণমাধ্যমে তারা কেন শপথ নিতে চান, সেটিও বারবার বলেছেন। এরই মধ্যে গত বৃহস্পতিবার শপথ নিয়েছেন জাহিদুর রহমান।
দলীয় সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে নির্বাচিত এক এমপির শপথ গ্রহণ এবং আরো চারজনের শপথের সম্ভবনা উঁকিঝুঁকি মারায় এক ধরনের চাপে পড়েছে বিএনপি। দলের সিনিয়র এক নেতা বলেন, দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে জাহিদের শপথ বাকিদের উৎসাহিত করতে পারে।
নির্বাচিত আরো দুইজন সংসদ ভবনে গিয়ে শপথের বিষয়ে কথা বলেছেন এমন তথ্যও তারা পেয়েছেন। দুই একজন আবার ২৯ এপ্রিল পর্যন্ত দলীয় সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করতে চান অথবা পরবর্তীতে শপথ নেয়ার কথা জানিয়ে সময় বাড়ানোর আবেদন করারও চিন্তা করছেন।
বগুড়া-৬ আসন থেকে নির্বাচিত মির্জা ফখরুল বাদে বিএনপি থেকে নির্বাচিত অন্যরা হলেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ আসনের আমিনুল ইসলাম, চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ আসনের হারুন উর রশিদ, বগুড়া-৪ আসনের মোশাররফ হোসেন এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনের উকিল আবদুস সাত্তার।
সংবিধানে বলা আছে, সংসদের প্রথম বৈঠকের পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচিতদের শপথ গ্রহণ করতে হবে। তা না হলে সদস্যপদ বাতিল করে আসন শূন্য ঘোষণা করা হবে। একাদশ সংসদের প্রথম বৈঠক বসে গত ৩০ জানুয়ারি। এই হিসাবে ২৯ এপ্রিলের মধ্যেই নির্বাচিত সদস্যদের শপথ নিতে হবে।
বিএনপির সিনিয়র এক নেতা বলেছেন, সরকারতো চাইবেই বিএনপির নির্বাচিতদের সংসদে নিতে। যাতে করে তাদের বৈধতা নিয়ে আর কোনো প্রশ্ন না থাকে। জাহিদুর রহমান সেই ফাঁদেই পা দিয়েছেন। তবে এটি বিএনপির জন্য বিব্রতকর।
বিএনপির সংসদ সদস্যের শপথের বিষয়ে সরকারের চাপ আছে সেটি জানিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গতকাল বলেছেন, বাংলাদেশের রাজনীতিতে এটি অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। বাংলাদেশে বরাবরই দল ভাঙার প্রচেষ্টা হয়েছে, ভেঙেছে। কিন্তু বিএনপির বিরুদ্ধে এই ধরনের প্রচেষ্টা করে কখনো কোনো লাভ হয়নি। বিএনপি সব সময়ই ফিরে এসে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে এবং স্বমহিমায় জনগণের কাছে ফিরে এসেছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক নেতা বলেছেন, আমাদের দলের সিদ্ধান্ত ছিল শপথ না নেয়ার। এখন দলের কেউ যদি সেই সিদ্ধান্ত অমান্য করে তবে অবশ্যই সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে।