শ্রীলঙ্কার ঘটনা থেকে বাংলাদেশকে শিক্ষা নেয়ার পরামর্শ

শ্রীলঙ্কায় বোমা হামলার ঘটনা ছাড়াও সাম্প্রতিক সময়ে আরেকটি বিষয় আলোচনায় উঠে আসছে। সেটি হচ্ছে, ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে দেশটির একটি বন্দরের নিয়ন্ত্রণ চীনের হাতে তুলে দেয়া।

শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটা বন্দর উন্নয়নে দেশটিকে কয়েকশ’ কোটি ডলার ঋণ দিয়েছিল চীন। কিন্তু একসময় শ্রীলঙ্কা সেই ঋণ পরিশোধে অক্ষম হয়ে ওঠায় ২০১৭ সালে বন্দরটি চীনের হাতে তুলে দেয়।

এই ঘটনাটি এখন আবার আলোচনায় আসার কারণ বৃহস্পতিবার থেকে চীনে শুরু হওয়া তিনদিনব্যাপী ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ সম্মেলন। এতে প্রায় শতাধিক দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার রাষ্ট্রপ্রধান, মন্ত্রী এবং উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিরা অংশ নিচ্ছেন। বাংলাদেশ থেকে সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন।

চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের ঋণচুক্তি
২০১৬ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের বাংলাদেশ সফরের সময় দুই দেশের মধ্যে ২৪ বিলিয়ন ডলারের ঋণচুক্তি সাক্ষরিত হয়। এই ঋণের টাকা জ্বালানি প্ল্যান্ট, সমুদ্রবন্দর এবং রেলওয়ে নির্মাণে ব্যয় হওয়ার কথা। এটা এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের পাওয়া সর্বোচ্চ বিদেশি ঋণ।

সম্প্রতি ভারতের সংবাদ সংস্থা এএনআই এক প্রতিবেদনে বলেছে, ‘‘বাংলাদেশের পায়রা বন্দরে চীনের যে ৬০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করার কথা, সেটা হলে পায়রা বন্দরের দখল নিতে পারে চীন। নিজের ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থে বাংলাদেশকে ঋণের ফাঁদে ফেলতে চাইছে চীন। পাকিস্তানের গোয়াদার, শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটা বন্দরের পর বাংলাদেশের পায়রা বন্দরের নিয়ন্ত্রণ নিতে চায় বেইজিং।”

এই অবস্থায় বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও যেন শ্রীলঙ্কার মতো পরিস্থিতি তৈরি না হয় সেজন্য সরকারকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা।

‘নিজ স্বার্থের কথা ভাবতে হবে’
হাম্বানটোটা বাংলাদেশের জন্য শিক্ষা হতে পারে কিনা, এই প্রশ্নের জবাবে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘‘এটা শুধু আমাদের জন্য নয়, সবার জন্যই শিক্ষা। মালয়েশিয়া যেটা করল, তারা ওই প্রজেক্ট ক্যানসেল করতে চাইল, কিন্তু করতে পারল না, তাদের ৩০ শতাংশ রিডাকশন দিতে হলো। অনেক ক্ষেত্রে আমাদেরও এমনটা হয়ে যাচ্ছে।”

তিনি বলেন, ‘‘আমরা যে কারোর কাছ থেকেই ঋণ নিতে পারি। সেটা আমাদের নিজেদের স্বার্থের কথা বিবেচনা করে নিতে হবে। এখন পর্যন্ত যা হচ্ছে, সেটা রাজনৈতিকভাবে। কিন্তু এটা আসলে অর্থনৈতিকভাবে হওয়া উচিত। অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ভায়াবিলিটি নিশ্চিত করেই এটা করা উচিত, কিন্তু এটা হচ্ছে না। রাজনৈতিকভাবে হলে যেটা হয় এর রিটার্নটা আসে না। অনেকগুলো প্রজেক্টই আমাদের হয়েছে, যার অর্থনৈতিক ভায়াবিলিটি নেই। এ ব্যাপারে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। আর চীনের ক্ষেত্রে যেটা হচ্ছে, অনেক কিছুই তাদের কাছ থেকে নিতে হয়। ফলে প্রজেক্টটা অনেক কস্টলি হয়ে যায়। এখানে আমাদের সতর্ক হওয়া উচিত। আর স্বচ্ছতার অভাব তো আছেই।”

‘নেগোসিয়েশনে অনেক চতুর হতে হবে’
এদিকে, বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘‘চীনের সঙ্গে কী ধরনের চুক্তি হয়েছে সে ব্যাপারে তথ্যের অভাব আছে। ২৪ বিলিয়ন ডলার- এটা তো প্রতিশ্রুতির মতো। শুধু কর্ণফুলী ছাড়া তো অন্যগুলোতে ঋণচুক্তি হয়েছে বলে আমার জানা নেই। এখানে তথ্যের অনেক ঘাটতি। কর্ণফুলী টানেলের বিষয়টা তো আমরা সবাই জানি। কিন্তু অন্য কিছু তো আমরা জানিই না। অন্যগুলো সব প্রতিশ্রুতির পর্যায়েই আছে।

দেখেন এসব ঋণের ক্ষেত্রে যেটা হয় যে, ক্রয়গুলো করা হয়, সেগুলো কীভাবে হবে, সে বিষয়ে যদি স্বচ্ছতা না থাকে তাহলে যে হাম্বানটোটার মতো ঘটনা ঘটবে না, সেটা তো আমরা বলতে পারব না। এসব ঋণে যেটা হয়, ঝুঁকি যেমন আছে, আবার লাভবান হওয়ারও সুযোগ আছে। এসব ঋণের ক্ষেত্রে নেগোসিয়েশনে আমাদের অনেক চতুর হতে হবে। আমরা কিন্তু এখনও এমন পর্যায়ে যাইনি, যে অনেক কমিটমেন্ট হয়ে গেছে, সেখান থেকে আর ফিরতে পারব না। এমনটা কিন্তু না। আমার মনে হয়, বাংলাদেশ একটা প্রাথমিক পর্যায়েই আছে।”

তিনি বলেন, ‘‘শুধু সুদের হার বা মেয়াদ না, কেনাকাটার ক্ষেত্রেও কী ধরনের শর্ত থাকে, সেটাও দেখতে হবে। সবকিছু বিবেচনা করে যদি আমরা কাজটা করতে পারি, তাহলে সুবিধাটা নিতে পারব। এগুলো তো উভয় দেশের স্বার্থেই হতে হবে। চীন যে সবকিছু আমাদের দয়া করে দিয়ে দেবে তা কিন্তু নয়। আবার আমরাও যে সবকিছু মেনে নেব তাও না। এখানে উইন-উইন সিচুয়েশন আইডেনটিফাই করাটাই চ্যালেঞ্জ। যাদের অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা আছে, তারা যদি প্রোপার ইনফরমেশন পান তাহলে তাদের উপদেশটাও আমাদের কাজে লাগে। কিন্তু স্বচ্ছতাই যদি না থাকে তাহলে আপনি উপদেশ পাবেন কীভাবে? সে কারণেই বলছি, স্বচ্ছতা এখানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।” ডয়েচে ভেলে।

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top