ব্যাঙের ডাক শোনেননি দেশে এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া কষ্টকর। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, শহর এলাকা বিশেষ করে রাজধানীতে আগামীতে হয়তোবা ব্যাঙের ডাক আর নগরবাসীর কানে পৌঁছাবে না। জলাশয় কমে যাওয়ার পাশাপাশি নানা ধরনের নগরদূষণের কারণে এমন পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার আশঙ্কা করছেন বন্যপ্রাণী ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান ড. নূরজাহান সরকার বলেন, পরিবেশে ব্যাঙের উপস্থিতি খুবই ইতিবাচক দিক। চাষাবাদের জমিতে ব্যাঙের উপস্থিতিতে দেশ আর্থিকভাবে লাভবান হয়। কেননা এরা ধানের জমিতে এত বিষাক্ত পোকামাকড় খায় যা চিন্তাও করা যায় না। তিনি বলেন, একটি ব্যাঙের পাকস্থলী পরীক্ষা করে দেখা গেছে এটি প্রতিদিন শুধু পোকামাকড় খেয়ে থাকে। এমনকি তার শরীরের ওজনের তিনগুণ বেশি পোকামাকড় খেয়ে ফেলে।
তিনি বলেন, বসতবাড়ির আশপাশেও ব্যাঙের উপস্থিতি খুবই ইতিবাচক। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ব্যাঙের আবাসস্থল রাখার ব্যাপারে সবাই এখন সোচ্চার। এটা বিলুপ্ত হয়ে গেলে বা কমে গেলে দেশের প্রাণিজগতের খাদ্যশৃঙ্খলাও ভেঙে যাবে। তিনি জানান, বর্ষার আগে ঢাকাবাসী ব্যাঙের ডাক শুনতে পেতেন। কিন্তু এখন তেমন কেউ এদের ডাক শুনতে পান না। ব্যাঙ এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ডাকে। এরা জলাশয় বা একটু নিচু জমি যেখানে পানি জমে থাকে সেখানে বাস করে।
বিশ্বব্যাপী এ পর্যন্ত ব্যাঙের ৭ হাজার ৮৫৭টি প্রজাতি পাওয়া গেছে। আর আমাদের দেশে এ পর্যন্ত নতুন সাত প্রজাতির ব্যাঙ আবিষ্কৃত হয়েছে এবং সব মিলিয়ে ব্যাঙের প্রজাতির সংখ্যা প্রায় ৪৯টি। তবে প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়ে বেশি বলে প্রাণিবিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
আইইউসিএন বাংলাদেশ ২০১৫ এর তথ্যানুযায়ী, আমাদের দেশে ১০ প্রজাতির ব্যাঙ বিপন্নতার তালিকায় আছে। এ তালিকার মধ্যে দুই প্রজাতির ব্যাঙ মহাবিপন্ন, ৩ প্রজাতির সঙ্কটাপন্ন এবং পাঁচ প্রজাতির সুরক্ষিত নয়। এ ছাড়াও ৬ প্রজাতির ব্যাঙ সম্পর্কে কোনো তথ্য-উপাত্ত নেই এবং আসন্ন বিপদগ্রস্তের মধ্যে রয়েছে আরো ৬ প্রজাতির ব্যাঙ।
অঞ্চলভেদে দেশে একেক প্রজাতির ব্যাঙ পাওয়া যায়। সিলেট এবং চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকাটি ইন্দোবার্মা হটস্পটের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় এ অঞ্চলে জীববৈচিত্র্যের আধিক্য এবং প্রজাতির আধিক্যও বেশি। সাধারণভাবে দেশব্যাপী যে ব্যাঙগুলো পাওয়া যায় সেগুলো ছাড়াও ছাগল ডাকা ব্যাঙ, কূপের ব্যাঙ, কালোফোটা ব্যাঙ, নিকোবরের ব্যাঙ, চামড়া ঝোলা ব্যাঙ, সরু মাথা ব্যাঙ, ঝর্ণা সুন্দরী ব্যাঙ, লালচোখা ব্যাঙ, মুকুট ব্যাঙ, লাল লাউবিচি ব্যাঙ, ভেঁপু ব্যাঙ, ডোরাকাটা আঠালো ব্যাঙ, লাল-পা গেছো ব্যাঙ, বড় গেছো ব্যাঙ, পাখির বিষ্ঠা ব্যাঙ, বহুদাগী খুদে গেছো ব্যাঙ প্রভৃতি বিরল প্রজাতির ব্যাঙ এ অঞ্চলেই বেশি পাওয়া যায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক এবং বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ড. মোহাম্মদ ফিরোজ জামান নিজেদের সাম্প্রতিক এক গবেষণায় এ তথ্য তুলে ধরে বলেন, দেশের উত্তরে রাজশাহী ও রংপুর অঞ্চলে কৃষিজভূমি এবং দক্ষিণের জলাভূমি বেষ্টিত জায়গাগুলোতে (কুমিল্লা, খুলনা ও বরিশাল) ব্যাঙের আধিক্য থাকলেও প্রজাতির বৈচিত্র্য কম। সাধারণভাবে এ জায়গাগুলোতে কুনো ব্যাঙ, কোলা ব্যাঙ, কটকটি ব্যাঙ, বিভিন্ন জাতের ঝিঁ ঝিঁ ব্যাঙ, ছোট লাউবিচি ব্যাঙ, পানা ব্যাঙ, ডোরাকাটা গেছো ব্যাঙ, চিত্রা গেছো ব্যাঙ প্রভৃতি প্রজাতি পাওয়া যায়। এ ছাড়াও সুন্দরবনসহ উপকূলীয় বিভিন্ন দ্বীপ যেমন- মহেশখালী, সোনাদিয়া, নিঝুম দ্বীপ, হাতিয়াসহ দেশের সর্বদক্ষিণে অবস্থিত সেন্টমার্টিন দ্বীপেও ব্যাঙ পাওয়া যায়।
তবে ড. মোহাম্মদ ফিরোজ জামান বলেন, বিশ^ব্যাপী ব্যাঙ অনেক কারণেই হুমকির সম্মুখীন। তার মধ্যে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনে ওজোনস্তর ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ভুপৃষ্ঠে অতিবেগুনি রশ্মির প্রকোপ বেড়ে যায়। এর প্রভাব পড়ে ব্যাঙের ডিম বা লার্ভার ওপরে। ফলে অনেক সময় ডিম নষ্ট হয় কিংবা লার্ভা অবস্থায় ব্যাঙের মৃত্যু ঘটে। প্রকৃতিতে ব্যাঙের সংখ্যা লোপ পায়। এভাবে উত্তর আমেরিকার রোরেইল টোড নামে একটি প্রজাতির সংখ্যা কমেছে। কৃষিকাজে কীটনাশক এবং রাসায়নিক স্যার ব্যবহারের ফলে তা জলজ পরিবেশকে দূষিত করে তোলে। এসবও ব্যাঙের ওপর প্রভাব সৃষ্টি করে। এ ছাড়াও মানুষ নিজেদের মতো করে জলজ-স্থলজ পরিবেশের পরিবর্তন ও পরিমার্জন করেই চলেছে। ফলে আমরা মনে করি এভাবে আবাসস্থল ধ্বংস হলে বিভিন্ন জায়গা থেকে ব্যাঙের সংখ্যা কমে যাবে। কেননা আবাসস্থল ধ্বংসের কারণে ব্রিটেনে বুফো ক্যালামিটা নামে একটি কুনো ব্যাঙের প্রজাতির সংখ্যা মারত্মকভাবে কমে গেছে। সম্প্রতি কাইট্্িরডিওমাইকোসিস নামক একটি ছত্রাকের আক্রমণে অনেক ব্যাঙ প্রকৃতি থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশে ব্যাঙের বর্তমান অবস্থার কথা বর্ণনা করে তিনি বলেন, গবেষণায় দেখা যাচ্ছে দেশে ব্যাঙের সবচেয়ে বড় হুমকি হচ্ছে ব্যাপক হারে আবাসস্থল ধ্বংস ও প্রাকৃতিক পরিবেশের রূপান্তর। মানুষ নিজেদের প্রয়োজনে যেমন কৃষিকাজ, রাস্তাঘাট, কলকারখানা, বসতির জন্য প্রাকৃতিক বিভিন্ন বন-জঙ্গল এবং জলাশয় ধ্বংস করছে। ফলে আবাসস্থল ধ্বংস কিংবা সঙ্কুচিত হওয়ায় ওই জায়গাগুলোতে ব্যাঙের সংখ্যা একবারে কমে যাচ্ছে কিংবা ব্যাঙগুলো অন্যত্র সরে যাচ্ছে। তিনি জানান, ঢাকা শহরে একসময় অনেক ব্যাঙ দেখা গেলেও বর্তমানে ব্যাপক নগরায়ণের কারণে অধিকাংশ জলাশয় বা ব্যাঙের প্রাকৃতিক পরিবেশ ধ্বংস করে ফেলেছি, ফলে এখন আগের মত ব্যাঙ দেখা যায় না। এ ছাড়া কলকারখানার বর্জ্য, বসতবাড়িতে ব্যবহার্য বর্জ্য পানিতে ফেলায় পানি দূষিত হচ্ছে। এর ফলে ব্যাঙের প্রজনন ব্যাহত হচ্ছে।
আর এমনই বাস্তবতায় আজ ২৭ এপ্রিল বিশ্বব্যাপী পালিত হতে যাচ্ছে ১১তম বিশ্ব ব্যাঙ সংরক্ষণ দিবস। দিবসটির এবারের প্রতিপ্রাদ্য হচ্ছে বিপন্ন অবস্থা থেকে ব্যাঙকে রক্ষা করা। দিবসটি উপলক্ষে সারা দেশের বিশেষ করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের পক্ষ থেকে বিভিন্ন কার্যক্রম নেয়া হয়েছে, যার লক্ষ্য হচ্ছে এ প্রাণীটির উপকারী দিক তুলে ধরা।