দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নিয়েছেন ঠাকুরগাঁও-৩ আসনে বিএনপি থেকে নির্বাচিত জাহিদুর রহমান। স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টায় জাতীয় সংসদ ভবনে তার দফতরে জাহিদুর রহমানকে শপথবাক্য পাঠ করান।
একাদশ জাতীয় সংসদে বিএনপি থেকে নির্বাচিত ছয়জনের মধ্যে জাহিদুর রহমানই প্রথম ব্যক্তি যিনি সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নিলেন। জাহিদুর রহমানের এই শপথ গ্রহণ নিয়ে বিএনপির মাঠপর্যায়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। অনেকেই তাকে ‘বেঈমান’ ও ‘দুশমন’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে কেউ শপথ নিলে তা সাংগঠনিক অপরাধ হিসেবে বিবেচনায় এনে দ্রুত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে।
বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, জাহিদুর রহমান শপথ নেয়ায় বিব্রত অবস্থায় পড়েছে বিএনপির হাইকমান্ড। দলটির নির্বাচিতরা শপথ নেবেন কি নেবেন না, রাজনৈতিক অঙ্গনে বেশ কিছু দিন ধরেই এ নিয়ে নানামুখী আলোচনা চলছিল। এ নিয়ে বিএনপির শীর্ষ নেতারা একাধিক ফোরামে দলের সিদ্ধান্ত তুলে ধরে বলেছেন, তারা সংসদে যাবেন না। মাত্র দিন তিনেক আগে দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকেও সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত হয় সংসদে না যাওয়ার। যদিও বিএনপির নির্বাচিতরা সংসদে যাওয়ার আগ্রহের কথা নানাভাবে প্রকাশ করে আসছিলেন। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সপ্তাহখানেক আগে নির্বাচিতদের নিয়ে বৈঠক করেছিলেন। ওই বৈঠকে সবাইকে সতর্ক করে বলে দেয়া হয়, দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে কেউ যাতে শপথ না নেন। বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ গত ১৯ এপ্রিল দলের একটি অনুষ্ঠানে সংসদে না যাওয়ার দলীয় সিদ্ধান্ত তুলে ধরে বলেন, ‘আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের (তারেক রহমান) সাথে বসে আমরা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আমাদের স্থায়ী কমিটি নিয়েছে। সুতরাং এখান থেকে ফিরে যাওয়ার বা সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের কোনো প্রশ্নই ওঠে না। গত ২১ এপ্রিল আরেক অনুষ্ঠানে বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেছিলেন, বিএনপি থেকে নির্বাচিত কেউ সংসদের আশপাশ দিয়ে হাঁটলেও জাতি তাদের ক্ষমা করবে না। দলীয় এমন অবস্থানের মধ্যেই জাহিদুর রহমান শপথ নিলেন।
শপথ গ্রহণ শেষে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় সাংবাদিকদের জাহিদুর রহমান বলেন, এই শপথ দলের সিদ্ধান্তের বাইরেই। আমি দীর্ঘ দিন তো অপেক্ষা করলাম। যেহেতু সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছি, এলাকার মানুষের প্রচণ্ড চাপ। গত ১৫ দিন ধরে ঢাকায় আছি। এলাকার মানুষের একটাই বক্তব্য, শপথ নিয়ে ফিরে আসেন। তিনি বলেন, আমার নেত্রী (খালেদা জিয়া) একজন বয়স্ক নারী, ৭৩ বছর বয়স। উনাকে যেন গণতন্ত্রের স্বার্থে মুক্ত করে দেয়া হয়, সংসদে এই আহ্বান জানাব। এটাই আমার সংসদ সদস্য হিসেবে প্রথম অঙ্গীকার। শপথ গ্রহণের আগে দলের কোনো পর্যায়ে কথা হয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, না, আগে বলেছি। দেখাও করেছি। কোনো প্রকারে সম্মতি দেয়নি। দলীয় সিদ্ধান্ত শপথ নেবে না।
দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে শপথ নেয়াতে বহিষ্কার হবেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার বিষয়ে দল যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতেই পারে। সেটি জেনে শুনেই শপথ গ্রহণ করেছি। দল যদি মনে করে বহিষ্কার করবে, করতেই পারে। বহিষ্কার করলেও কিন্তু আমি দলে আছি। জাহিদ আরো বলেন, দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে মাঠে লড়াই করেছি। আমি এবার নিয়ে চতুর্থবার নির্বাচন করলাম। এই আসনটি আমাদের বিএনপির ছিল না। স্বাধীনতার পর থেকে এ আসনটি আওয়ামী লীগের। এই প্রথম বিএনপি বিজয়ী হতে সক্ষম হয়েছে।
শপথ অনুষ্ঠানে জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরী এমপি, হুইপ ইকবালুর রহিম এমপি এবং হুইপ আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন এমপি উপস্থিত ছিলেন। জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের সিনিয়র সচিব ড. জাফর আহমেদ খান শপথ অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন। শপথ শেষে জাহিদুর রহমান রীতি অনুযায়ী শপথ বইয়ে স্বাক্ষর করেন। শপথ নিলেও প্রথম দিনে সংসদের অধিবেশনে যোগ দেবেন না জানিয়ে জাহিদুর বলেন, মহাসচিব ছাড়া দলের বাকি সদস্যরাও শপথ নিতে পারেন। তারা এলে একসাথে যোগ দেবেন।
জাহিদুর রহমান শপথ নেয়ার পর গতকাল বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এ নিয়ে যথেষ্ট শোরগোল লক্ষ করা গেছে। মাঠপর্যায়ের নেতারা তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। ঠাকুরগাঁও-৩ আসনের ভোটার ও ছাত্রদলের ঢাকা মহানগর উত্তরের সাবেক সভাপতি কামাল আনোয়ার আহাম্মদ বলেন, বেগম খালেদা জিয়াকে জেলে রেখে, দলীয় সিদ্ধান্ত ভঙ্গ করে জাহিদুর রহমান বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। এলাকার জনগণ এবং বিএনপির নেতাকর্মীরা তাকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করছেন।
বিএনপির কেন্দ্রীয় শ্রমবিষয়ক সহসম্পাদক মো: ফিরোজ-উজ-জামান মামুন মোল্লা বলেন, জাহিদুর রহমান মীরজাফরের উত্তরসূরি। তিনি দলের সাথে, জাতির সাথে বেঈমানি করেছেন। এ ধরনের প্রতারকদের জায়গা বিএনপিতে হতে পারে না।
বিএনপি একাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেনের সাথে জোট বেঁধে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গড়ে। গত ৩০ ডিসেম্বরের ওই নির্বাচনে মাত্র ছয়টি আসন পায় বিএনপি। গণফোরামের দু’টি মিলিয়ে ঐক্যফ্রন্ট পায় মোট আটটি আসন। নির্বাচনে ভোট ডাকাতির অভিযোগ তুলে পুনর্নির্বাচনের দাবি তোলেন তারা। নির্বাচিতরা সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নেবেন না বলেও ঘোষণা দেয়া হয় বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে; কিন্তু গণফোরামের সুলতান মনসুর ও মোকাব্বির খান দলের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে এমপি হিসেবে শপথ নেয়ায় বিএনপির নির্বাচিতরাও একই পথে হাঁটতে পারেন বলে গুঞ্জন শুরু হয়। যদিও বিএনপির নেতারা এ ব্যাপারে কঠোর হুঁশিয়ারি দেন। সেই হুঁশিয়ারিকে পাত্তা না দিয়ে সুলতান মনসুর ও মোকাব্বির খানের পথেই হাঁটলেন জাহিদুর রহমান।
শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে : মির্জা ফখরুল
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল গণমাধ্যমকে দেয়া এক প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, দলের সিদ্ধান্ত হচ্ছে, শপথ গ্রহণ না করা। এই সিদ্ধান্ত অমান্য করে যদি কেউ শপথ গ্রহণ করে থাকেন তা নিঃসন্দেহে সাংগঠনিক অপরাধ। অবশ্যই এ রকম ব্যক্তির বিরুদ্ধে দ্রুতই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। মির্জা ফখরুল বলেন, আমি স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই, বিএনপির সিদ্ধান্ত হচ্ছে শপথ গ্রহণ না করার। সুতরাং এখন প্রশ্নই উঠতে পারে না শপথ নেয়ার।
বিএনপির অন্য নির্বাচিতদের মধ্যে যারা শপথ নেননি তারা হলেন- বগুড়া-৬ মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ আমিনুল ইসলাম, চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ হারুনুর রশীদ, বগুড়া-৪ মোশাররফ হোসেন ও ব্রাহ্মহ্মণবাড়ীয়া-২ আসনে উকিল আবদুস সাত্তার।