শ্রীলংকায় ইস্টার সানডেতে গির্জা ও হোটেলে যেসব তরুণ-যুবক হামলা চালিয়েছে তাদের অধিকাংশই উচ্চ-শিক্ষিত এবং উচ্চ-মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান। তাদের একজন ব্রিটেন এবং অস্ট্রেলিয়ায় পড়াশোনা করেছেন।
যে আটজন আত্মঘাতী হামলাকারীকে এখন পর্যন্ত শনাক্ত করা হয়েছে, তাদের মধ্যে রয়েছেন দুই ভাই, যারা কলম্বোর ধনী এক মসলা ব্যবসায়ীর সন্তান। কলম্বো সরকার বলছে, এই প্রবণতা খুবই উদ্বেগের।
বাংলাদেশেও ২০১৬ সালে হোলি আর্টিজান বেকারিতে হামলাকারীদের অনেকেই ছিল শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান।
শিক্ষিত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের তরুণদের জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ার কারণ কী? আর এই চিত্রটি আসলে কতটা উদ্বেগের?
আন্তর্জাতিক উগ্রবাদ সহিংসতা নিয়ে গবেষণা করেন সুইডেনে বসবাসরত বাংলাদেশী সাংবাদিক তাসনিম খলিল। তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘এটি অবশ্যই উদ্বেগের কারণ যে, যারা আইএস বা আল-কায়েদার মতো জিহাদি সংগঠনগুলোর সাথে জড়িত হচ্ছে তাদের মধ্যে একটি বিশাল অংশ তারা উচ্চবিত্ত পরিবার থেকে আসছে।’
‘আবার শ্রীলংকার একটি পরিবার এই হামলার সাথে জড়িত ছিল যারা মিলিওনিয়ার বা কোটিপতি।’
তিনি এখানে উদ্বেগের কারণ হিসেবে অর্থায়নের বিষয়টিকে গুরুত্ব দেন। কারণ ‘উগ্রবাদী হামলার ঘটনার সাথে যে শুধু জড়িত থাকে তাই না এই ফান্ডিং বা টাকা পয়সার জোগান দেওয়া সেটাও তারা অনেকসময় করে থাকে।’
তিনি বলছেন, ‘এটা একটা বৈশ্বিক প্রবণতাই বলতে হবে আমরা যে কোনোদিকেই দেখি না কেন। বিশেষ করে পশ্চিমা দেশগুলোতে এটা নিয়ে অনেক গবেষণাও হয়েছে। শুধুমাত্র যে উচ্চবিত্ত তাই না, উচ্চ শিক্ষিতরাও উগ্রবাদ বা সন্ত্রাসবাদের সাথে জড়িত হয়ে পড়ছে।’
তিনি বাংলাদেশের ঢাকার গুলশানে হোলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার ঘটনার উদাহরণ টেনে বলেন, ‘বাংলাদেশেও হোলি আর্টিজানের যে ঘটনাটি ছিল সেখানেও আমরা দেখেছি উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানরা আইসিস (আইএস)-এর সাথে মিলে হামলা করেছিল।’
‘ব্রিটেনে অনেকগুলো ঘটনা দেখেছি, অস্ট্রেলিয়াতেও অনেকগুলো ঘটনা দেখেছি যেখানে উচ্চ শিক্ষিত এবং বেশ অর্থবান পরিবারের সন্তানরা বা নিজেও অর্থবান ব্যবসা-বাণিজ্যতে জড়িত ছিল এরকম লোকজনও কিন্তু এরকম উগ্রবাদী গ্রুপগুলোর সাথে জড়িত হয়েছে এবং অনেকে মারাও গেছে।’
শিক্ষিত এবং সচ্ছল পরিবারের সন্তান হওয়ার পরেও কেন তারা ধর্মীয় উগ্রপন্থায় জড়িয়ে পড়ছে?
এই প্রশ্নে তাসনিম খলিল বলেন, ‘বেশ অনেক বছর ধরে আমাদের স্কলারদের মধ্যে একটা ধারণা ছিল সন্ত্রাসবাদের মূল কারণ সম্ভবত হচ্ছে দারিদ্র্য। কিন্তু ইদানীং উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানরা যখন ধর্মের দিকে ঝুঁকে পড়ছে তাদের ধর্মপরায়ণতা বাড়ছে।’
‘সম্পদের পরিমাণ বাড়ার সাথে সাথে, সমাজে সম্পদশালী মানুষের সংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে এই সম্পদশালী মানুষ ধর্মপরায়ণও হয়ে পড়ছে যে বিষয়টি সম্প্রতি ভারতের এক গবেষণায় উঠে এসেছে’, বলেন তাসনিম খলিল।
‘তো সেখানে দেখা যাচ্ছে ধর্মপরায়ণতা যখন তাদের (তরুণ এবং বয়স্ক উভয়ের মধ্যেই) মধ্যে বেড়ে যায়, এর একটা কারণ হল এই যে সন্ত্রাসবাদী দলগুলো আছে তাদের আইডিওলজি অনেক বেশি সহজে বিভিন্ন জায়গায় পাওয়া যায়। এবং এটা মানুষকে আকৃষ্ট করে বিশেষ করে যারা উচ্চবিত্ত এবং উচ্চশিক্ষিত একধরনের তাদের প্রাথমিক ধর্মীয় শিক্ষা আসলে থাকে না।’
অনেক সময় তারা অন্যের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকে বা মগজ ধোলাইয়ের শিকার হয়ে উগ্র ধর্মীয় কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে বলে বিভিন্ন সময় উঠে এসেছে। এই ‘মগজ ধোলাই’য়ের কবল থেকে তরুণদেরকে কিভাবে রক্ষা করা যায়?
তাসনিম খলিলের ভাষ্য, এটা একদিনে হয় না। এটা শুরু হতে পারে দীর্ঘদিন আগে থেকে এবং বিভিন্নভাবে।
‘এটা শুরু হতে পারে নারীদের প্রতি একধরনের ঘৃণা থেকে, বা সমকামীদের প্রতি এক ধরনের ঘৃণা থেকে, বা অন্যান্য ধর্মাবলম্বনকারী যারা আছেন তাদের প্রতি ঘৃণা থেকে এবং আমার ধর্ম সবচেয়ে ভালো এই ধরনের একটা শ্রেষ্ঠত্ববাদী চিন্তা-ভাবনা থেকে।’
তাসনিম খলিলের মতে, একটা বহুত্ববাদী সমাজ বা মাল্টি কালচারাল সমাজ যদি প্রতিষ্ঠা করা না যায় তাহলে সামনে এই সমস্যা আরো বেড়ে যাবে।