এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন থেকে ১০ শতাংশ চাঁদা কর্তনের আদেশ দিয়ে শিক্ষামন্ত্রণালয় থেকে সম্প্রতি যে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে, তার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে দেশের সব কয়টি শিক্ষক সংগঠন। সব মতের শিক্ষক সংগঠনগুলোসহ সারা দেশের পাঁচ লক্ষাধিক শিক্ষক-কর্মচারী প্রজ্ঞাপনের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছেন। শিক্ষক সংগঠনগুলো অচিরেই প্রজ্ঞাপন বাতিল বা স্থগিত করা না হলে আন্দোলনে নামার ঘোষণা ও হুঁশিয়ারি দিয়েছে। দুই-একটি শিক্ষক সংগঠন গত দুদিনে সংবাদ সম্মেলন করে অবসর-কল্যাণ ট্রাস্ট্রের জন্য ১০ শতাংশ কর্তনের আদেশ বাতিলের দাবিতে কর্মসূচিও ঘোষণা করেছে। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে- মানববন্ধন, প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি পেশ এবং অবসর-কল্যাণ ট্রাস্টের অফিস ঘেরাও। সব মত-পথের শিক্ষক সংগঠন, অবসর ভাতা এবং কল্যাণ ট্রাস্টের পরিবর্তে অবিলম্বে বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের পেনশন চালুর দাবি তুলেছে। বেশির ভাগ শিক্ষক নেতা এ ব্যাপারে বলেন, আর কত দিন অবসরভাতা ও কল্যাণভাতা চালু থাকবে? সরকার শিক্ষকদের বেতন দিচ্ছে, পেনশন কেন দেবে না? আমরা সরকারের কাছে পূর্ণাঙ্গ পেনশন চাই।
গত ১৫ এপ্রিল‘১৯ শিক্ষামন্ত্রণালয় এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের সরকারি বেতন থেকে ১০ শতাংশ কর্তনের আদেশ জারি করে। এর ফলে চলতি এপ্রিল থেকে বেতনের ১০ শতাংশ অর্থ কেটে রাখা হবে। এই অর্থ বেসরকারি শিক্ষক ও কর্মচারী অবসর সুবিধা বোর্ড এবং কল্যাণ ট্রাস্টের তহবিলে জমা হবে। এত দিন শিক্ষক প্রতি অবসর বোর্ডের জন্য ৪ শতাংশ এবং কল্যাণ ট্রাস্টের জন্য ২ শতাংশ হারে চাঁদা কর্তন করা হচ্ছিল। প্রজ্ঞাপনের নির্দেশনা অনুসারে অবসরের জন্য ৬ শতাংশ এবং কল্যাণ ট্রাস্টের জন্য ৪ শতাংশ হারে কাটা হবে। অবসর গ্রহণের পর আবেদন করে সে অর্থ তোলা যাবে। প্রসঙ্গত, গত দু’বছর আগেও একইভাবে এ প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছিল। পরে শিক্ষক সংগঠনগুলোর আপত্তি ও আন্দোলনের হুমকির মুখে এবং জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে প্রজ্ঞাপনটি স্থগিত করা হয়। প্রায় দু’বছর পর আবারো সেটি জারি করা হলো।
অবসর সুবিধা বোর্ড এবং কল্যাণ ট্রাস্ট সূত্রে জানা গেছে, এই দু’টি প্রতিষ্ঠানে হাজার হাজার অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক তাদের পাওনা দাবিতে আবেদন জমা দিয়ে বছরের পর বছর অপেক্ষার প্রহর গুণছেন। অনেকে ন্যায্য পাওনা বুঝে পাওয়ার আগেই মারা যান। নতুন কোনো আবেদন না নেয়া হলে বর্তমানে যে আবেদন জমা রয়েছে, আগামী দুই বছর লেগে যাবে এগুলোর নিষ্পত্তিতে।
বেসরকারি শিক্ষক ও কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্টে পুনঃনিয়োগপ্রাপ্ত (টানা চতুর্থবার) সদস্য সচিব অধ্যক্ষ শাহজাহান আলম গতকাল নয়া দিগন্তের সাথে আলাপকালে এ ব্যাপারে সরাসরি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে তিনি জানান, গত ১৫ এপ্রিল এ প্রজ্ঞাপন জারি হলেও গতকাল পর্যন্ত কোনো চিঠি আমাদের দফতরে পৌঁছেনি। তিনি বলেন, বোর্ড ও ট্রাস্টে টাকা কম বা বেশি জমা হলে শিক্ষকরাই সুবিধা ভোগ করবেন। আমি সরকারের নির্দেশমতোই কাজ করব। তবে, সাম্প্রতিক দিনগুলোতে শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন ও ভাতা দু’টোই বেড়েছে। শিক্ষকদের পাঁচ শতাংশ হারে বেতন বাড়বে। এ ছাড়া চলতি বছর বৈশাখী ভাতাও পাচ্ছেন শিক্ষকরা। বিষয়টি আমাদের (শিক্ষকদের) বিবেচনায় নেয়া উচিত।
অপর দিকে, সব শিক্ষক সংগঠন অবিলম্বে প্রজ্ঞাপন বাতিলের দাবি করেছেন। বিভিন্ন শিক্ষক সংগঠনের নেতার সাথে আলাপকালে তারা বলেন, সরকার শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন দিচ্ছে। নৈতিকভাবেই সরকারের উচিত বা দায়িত্ব হচ্ছে, তাদের অবসরে যাওয়ার পর পেনশন দেয়া। এ সক্ষমতা সরকারের এখন হয়েছে। আর কতদিন শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন থেকে টাকা কর্তন করে, অবসরে যাওয়া শিক্ষকদের ভাতা দেবে। এটা অনৈতিকও বটে। শিক্ষক নেতারা বলেন, সরকার বা শিক্ষামন্ত্রণালয়ের শুভ বুদ্ধির উদয় না হলে, আগামীতে ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জনসহ নানা কর্মসূচি বিবেচনায় নেয়া হতে পারে।
শিক্ষকদের পুরনো সংগঠন বাংলাদেশ কলেজ শিক্ষক সমিতি (বাকশিস) ও বাংলাদেশ অধ্যক্ষ পরিষদের (বিপিসি) মুখ্য সমন্বয়কারী প্রবীণ শিক্ষক নেতা অধ্যক্ষ মোহাম্মদ মাজহারুল হান্নান বলেন, সরকার যে প্রজ্ঞাপন জারি করেছেন তা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক ও অন্যায় এবং অবিলম্বে তা প্রত্যাহার করা উচিত। এ ধরনের প্রজ্ঞাপনে দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় সরকারি-বেসরকারি বৈষম্য বাড়বে। বেসরকারি শিক্ষকরা অবসর জীবনে পূর্ণাঙ্গ পেনশন পাওয়ার অধিকার রাখেন উল্লেখ করে বলেন, তারা নিষ্ঠার সাথে সেবা প্রদান করে অবসর জীবনে আর্থিক নিরাপত্তা ও মর্যাদার সাথে জীবনযাপনের নিশ্চয়তা অর্জন করেছেন।
বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের একক বৃহৎ সংগঠন শিক্ষক-কর্মচারী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ মো: সেলিম ভূঁইয়া বলেন, এখন শিক্ষকদের জন্য পেনশন চালু করার সময় এসেছে। সরকার দেশের যে উন্নয়নের বন্যার কথা বলছে, তাতে সরকারের সক্ষমতা হয়েছে পাঁচ লক্ষাধিক শিক্ষক-কর্মচারীর অবিলম্বে পেনশন চালু করার। তিনি প্রজ্ঞাপনটি বাতিল বা প্রত্যাহার দাবি করে বলেন, অন্যথায় অতীতের মতো আন্দোলনের মাধ্যমেই সেটি প্রত্যাহার করতে বাধ্য করা হবে। তিনি জানান, আগামী কয়েকদিনের মধ্যে জাতীয় নির্বাহী কমিটির সভা করে কর্মসূচি চূড়ান্ত করা হবে।
সরকার সমর্থক ১০টি শিক্ষক সংগঠনের জোট শিক্ষক-কর্মচারী সমিতি ফেডারেশনের সমন্বয়কারী অধ্যক্ষ আসাদুল হক বলেন, শিক্ষামন্ত্রণালয়ের আর কোনো কাজ নেই বলেই মনে হয়। এর উদ্দেশ্যেই বা কী? কারণ, ইতঃপূর্বে প্রত্যাহার করা প্রজ্ঞাপনটি কার পরামর্শে জারি করা হলো? অবিলম্বে এটি প্রত্যাহার করে সরকারের সহায়ক শক্তি হিসেবে প্রতিনিধিত্বশীল শিক্ষক সংগঠনের সাথে এ ব্যাপারে মন্ত্রীর কথা বলা উচিত ছিল। বিগত মন্ত্রী এটি প্রত্যাহার করলেন, নতুন মন্ত্রী আসার পর কোনো কথা নেই, আবারো সেই প্রজ্ঞাপন কেন? তিনি অবিলম্বে প্রজ্ঞাপনটি প্রত্যাহার করার দাবি জানিয়ে বলেন, প্রতি মাসে বেতন দেবেন, আর পেনশন দেবেন না এটা হয় না। পৃথিবীর কোনো দেশে এরূপ নজির নেই।
সরকার সমর্থক আরেক শিক্ষক সংগঠন বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি (বিটিএ) গতকাল জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে আগামী ২৫ এপ্রিল বেলা ১১টায় সব উপজেলা সদরে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ এবং ইউএনওর মাধ্যমে ৩০ এপ্রিল জেলা সদরে এবং কেন্দ্রীয়ভাবে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ এবং জেলা প্রশাসক ও বিভাগীয় কমিশনারের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি প্রদানের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। এর পর প্রজ্ঞাপন বাতিল করা না হলে, শিক্ষক-কর্মচারীরা অবিরাম ধর্মঘট ও আমরণ অনশনসহ বোর্ড ও ট্রাস্ট অফিস ঘেরাও করা হবে। সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক অধ্যক্ষ মো: কাওছার আলী শেখ এই কর্মসূচি ঘোষণা করেন।
বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ লিয়াজোঁ ফোরামের মুখপাত্র মো: নজরুল রনি বলেন, কোনো আলোচনা ছাড়াই শিক্ষকদের অতিরিক্ত চার শতাংশ কর্তনের প্রজ্ঞাপনে আমরা ক্ষুব্ধ ও অসন্তুষ্ট। অতিরিক্ত কর্তনে শিক্ষকদের কোনো মত ছিল না, নেইও। কল্যাণ ট্রাস্ট ও অবসর সুবিধা বোর্ডের কয়েকজন পুরো পাঁচ লাখ শিক্ষকের অভিভাবক নয়। শিক্ষকদের বেতনের অতিরিক্ত চার শতাংশ কর্তন হলে ভবিষ্যতে শিক্ষক-কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্ট ও অবসর সুবিধা বোর্ড ঘেরাও কর্মসূচি দেয়া হবে বলে জানান এ শিক্ষক নেতা।