‘হাইব্রিড’ ও ‘কাউয়া’দের নিয়ে বিপাকে আওয়ামী লীগ : তালিকা হচ্ছে

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগে যোগদানের হিড়িক পড়েছিল। সেই যোগদান এখনো চলছে। কিন্তু এসব ‘নব্য আওয়ামী লীগারদের’ নিয়ে এখন বিপাকে আছে দলটি। তাই তাদের তালিকা করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

আওয়ামী লীগে ‘হাইব্রিড’ ও ‘কাউয়া’ শব্দ দু’টি বহুল পরিচিত। এই দু’টি শব্দ কয়েক বছর আগে সামনে নিয়ে আসেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। মূলত যারা সুযোগ- সুবিধার জন্য বিভিন্ন সময়ে আওয়ামী লীগে যোগদান করেছেন তাদেরই তিনি ওই দুই নামে অভিহিত করেন থাকেন। এই নব্য আওয়ামী লীগের কারণে কোথাও কোথাও আওয়ামী লীগই কোণঠাসা হয়ে পড়েছে এখন।

জানা গেছে, নির্বাচনের আগে যেমন ‘পরিস্থিতি’ আঁচ করতে পেরে বিএনপি ও জামায়াত থেকে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন অনেকে, তেমনি দল ভারী করার জন্যও আওয়ামী লীগের অনেক সংসদ সদস্য প্রার্থী ও নেতা তাদের আওয়ামী লীগে যোগদানে বাধ্য করেছেন৷ ফলে দেশের তৃণমূল পর্যায়ে এখন পরিচয় দেয়ার মতো বিএনপি জামায়াত কর্মী খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে গেছে। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার এবার টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর স্থানীয় পর্যায়ে যেন সবাই আওয়ামী লীগ হয়ে গেছে। পরিস্থিতি এমন যে কোথাও কোথাও নব্য আওয়ামী লীগারদের হাতে আওয়ামী লীগ বা তার অঙ্গ সংগঠনের নেতা-কর্মীরা মার খাচ্ছেন বলে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে।

আওয়ামী লীগ সূত্র জানায়, এরকম আরো অনেক ঘটনার খবর পাওয়া যাচ্ছে। বিশেষ করে যেসব এলাকায় আওয়ামী লীগের মূল গ্রোতের বাইরে থেকে মনোনয়ন নিয়ে যারা সংসদ সদস্য হয়েছেন তারা বিভিন্ন দল থেকে লোক ভিড়িয়ে আওয়ামী লীগ বিরোধী আরেকটি আওয়ামী লীগ তৈরি করেছেন স্থানীয় পর্যায়ে। আর তাদের মধ্যে টেন্ডার, ব্যবসা বণিজ্যসহ নানা বিষয় নিয়ে দ্বন্দ্ব তৈরি হচ্ছে।

এমনকি বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন সংঘর্ষে এ বিষয়টি প্রধান হয়ে উঠে আসছে, কার হাতে কারা মার খাচ্ছে। মূলত সবাই আওয়ামী লীগ। কিন্তু কে পুরাতন আওয়ামী লীগার আর কে নব্য আওয়ামী লীগার। বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় পর্যায় থেকে শুরু করে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত দলের নেতা-কর্মীরা বিব্রতকর অবস্থায় আছেন। আসলে তারা কেবল দল ভারী করার বিষয়টিই ভেবেছিলেন। এর যে উল্টো প্রভাব পড়তে পারে বিষয়টি তারা সেভাবে খেয়াল করেননি।

নব্যদের মাধ্যমে যেভাবে সমস্যা তৈরি হয়
ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ও কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সহসম্পাদক মনিরুজ্জামান মনির বলেন, আমার নির্বাচনি এলাকা রাজাপুর-কাঠালিয়া। এখানে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে যিনি এমপি হয়েছেন তিনি মূলধারার আওয়ামী লীগ নন। ফলে তিনি আওয়ামী লীগের বাইরের লোকজনকে দলে ভিড়িয়েছেন। জামায়াত শিবিরের লোকজনকেও সাথে নিয়েছেন। ফলে আমার এলাকার এখন বিভিন্ন পর্যায়ে আওয়ামী লীগ বিরোধীদের দাপট৷ আমরা কোণঠাসা হয়ে পড়েছি।

লালমনিরহাটের একজন স্থানীয় ব্যক্তি জানান, পাটগ্রাম ও হাতিবান্ধা এলাকায় বিএনপি ও জামায়াত এখন আওয়ামী লীগ নেতাদের নিয়ন্ত্রক। নেতাদের ডানে বায়ে সব সময় তাদেরই দেখা যায়। আর এখানে আছে ভোটের হিসেব। ফলে যারা মূল আওয়ামী লীগ কর্মী তারা গুরুত্বহীন হয়ে পড়ছে।

পরিস্থিতি যে ভালো নয় তা বোঝা যায় আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ও কেন্দ্রীয় ১৪ দলের মুখপাত্র মোহাম্মদ নাসিমের কথায়। গত ১৯ মার্চ তিনি ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে এক অনুষ্ঠানে বলেন, নব্য আওয়ামী লীগাররা বিএনপি জামায়াতের চেয়েও ভয়ঙ্কর। এরা সুযোগসন্ধানী। এদের চিনে রাখতে হবে। এখন দেশের সবাই আওয়ামী লীগ হয়ে গেছে। যাদের কখনো আওয়ামী লীগের সভা-সমাবেশ দেখিনি তারাও এখন আওয়ামী লীগ করে। এদের থেকে সাবধান ও সর্তক থাকতে হবে।

যে সব কারণে নব্য আওয়ামী লীগার
দলে দলে আওয়ামী লীগে যোগদানের যে কারণ জানা গেছে তা হলঃ
১. নির্বাচনের আগে পরিস্থিতি বুঝে অনেকেই নিজেদের বাঁচাতে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন।

২. একটি অংশকে যোগদানে বাধ্য করা হয়েছে হামলা মামলার ভয় দেখিয়ে।

৩. ভোটের হিসেবের কারণে জামায়াতকেও সাথে নেয়া হয়েছে।

৪. নির্বাচনের পরে সুযোগ সন্ধানীরা নানা পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতার সূত্রে আওয়ামী লীগে ভিড়েছেন।

৫. স্থানীয় আওয়ামী লীগের দ্বন্দ্বের কারণে দল ভারী করতে গ্রুপগুলো বিএনপি জামায়াতকে দলে জায়গা দিয়েছে।

৬. কেউ কেউ ব্যবসা বাণিজ্য বা অবস্থান টিকিয়ে রাখতে আওয়ামী লীগের আশ্রয়ে চলে গেছেন।

রংপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. রেজাউল করিম রাজু বলেন, কিছু লোক আছেন যারা সবসময় সরকারি দল করেন। আবার কিছু লোক আছেন যারা তাদের ব্যবসা বাণিজ্য ও নানা সুবিধা টিকিয়ে রাখতে চান। তাদের কোনো আদর্শ নেই৷ এরা বঙ্গবন্ধু বা আওয়ামী লীগের আদর্শে বিশ্বাসী নন। তারা সুবিধা নেয়ার জন্যই আওয়ামী লীগে যোগ দিচ্ছেন। তারা আওয়ামী লীগের দুর্নামেরও কারণ হচ্ছেন। বিভিন্নজন তাদের ব্যক্তিগত স্বার্থে তাদের দলে ঢোকার সুযোগ করে দিচ্ছেন। ফলে ত্যাগী নেতা-কর্মীরা কোণঠাসা হয়ে পড়ছেন।

তালিকা হচ্ছে নব্যদের
গত ৫ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দলের কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠকে ‘নব্য আওয়ামী লীগার’ নিয়ে আলোচনা হয়। বৈঠকে আগামী সেপ্টেম্বরে দলের কাউন্সিলের আগেই তাদের তালিকা প্রস্তুত করা এবং তাদের তৎপরতার ব্যাপারে প্রতিবেদন চূড়ান্ত করতে বলা হয়েছে।

আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন এমপি বলেন, আমাদের নেতাদের সরলতার সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে কিছু সুযোগ সন্ধানী ঢুকে পড়েছে। তাদের আমরা চিহ্নিত করছি। আওয়ামী লীগ একটি বড় দল। আমরাতো দরজা বন্ধ করে রাখতে পারি না। যারা দলের নাম ভাঙ্গিয়ে অনৈতিক ও অবৈধ সুযোগ সুবিধা নেয়ার চেষ্টা করছেন তাদের কোনোভাবেই ছাড় দেয়া হবে না। আর সামনের কাউন্সিলে তারা দলের কোনো পর্যায়ের কমিটিতে যাতে ঢুকতে না পারে সেজন্য সতর্ক করে দেয়া হয়েছে।

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top