চন্দ্র বছরের অষ্টম মাসের নাম শাবান মাস। এই মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতকে লাইলাতুল বরাত বা শবেবরাত বলা হয়। ‘শবেবরাত’ দু’টি শব্দে গঠিত একটি ব্যাপক পরিচিত ধর্মীয় অনুষ্ঠানের নাম। ‘শব’ শব্দটি ফারসি। যার অর্থ হচ্ছে রাত্রি। আর বরাত শব্দের অর্থ অদৃষ্ট ভাগ্য, খঁপশ ইত্যাদি। সুতরাং শবেবরাত মানে হচ্ছে ভাগ্যরজনী। আমাদের দেশের সাধারণ মুসলমানদের ধারণা বদ্ধমূল যে, এ রাতটি হলো এমন একটি রাত; যে রাতে আল্লাহ মানুষের এক বছরের বাজেট নির্ধারণ করেন। এক বছরের জন্য কে কী খাবে, কী করবে তা লিপিবদ্ধ করেন।
অনেকে মনে করেন, যদি এ রাতে ভালো খাবার খাওয়া যায়, ভালো কাপড় পরা যায়, তা হলে সারা বছরই ভালো অবস্থায় দিন যাবে। আবার অনেকে মনে করেন, এ রাতে সন্ধ্যায় ইবাদতের নিয়তে গোসল করলে প্রত্যেকটি ফোঁটায় ৭০ জন করে ফেরেশতা তৈরি হয় এবং তারা সারা রাত ওই ব্যক্তির জন্য দোয়া করে, মাগফিরাত কামনা করেন।
গ্রামে-গঞ্জে এখনো দেখা যায়, এই রাত আসার আগ থেকেই প্রত্যেক মসজিদে বিশেষ দোয়া-মুনাজাত ও বিশেষ খাবারের ব্যবস্থা করা হয়। বাসাবাড়িতে রুটি-হালুয়া, পোলাও, কোরমা, ফিরনি ইত্যাদি তৈরি করে ধুমধাম করে আনন্দের সাথে খেতে দেখা যায়। এই দিনে দেরিতে বাজারে গেলে গোশত পাওয়া মুসকিল। এভাবে সব আয়োজন সম্পন্ন হয়ে থাকে শবেবরাত উদযাপন করার জন্য। অনেকে এমন আছেন যে, নতুন জামা নতুন টুপি পরে আতর-গোলাপ মেখে রাতভর নফল নামাজ, জিকিরে কাটিয়ে দেন। সকালে ফজরের নামাজ আদায় না করেই ঘুমিয়ে যান, পরদিন ১০টায় জাগেন।
একটি কথা সবারই জানা থাকা জরুরি, ১০০ কোটি রাকাত নফল নামাজ এক রাকাত ফরজ নামাজের সমান নয়। তবে হ্যাঁ, নফল নামাজে অনেক সওয়াব রয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু তা কখনো ফরজ নামাজের সমান নয়। অনেকে এভাবে সারারাত ইবাদতের শেষে পরদিন যখন আবার ভালো কিছু পায় না, অথবা ভাগ্যে জুটে না, তখন বলে থাকেনÑ শবেবরাতে আল্লাহ প্রথম দিকে এমপি, মন্ত্রী, শিল্পপতি ও সমাজের বড় লোকদের ভাগ্য লিখতে লিখতে আল্লাহর কলমের কালি শেষ হয়ে গেছে, পরে আমাদের ভাগ্যে ‘সাবেক হুকুম’ বহাল (নাউজুবিল্লাহ) ফলে আমাদের ভাগ্য বদলায় না।
এ সব ধারণার জন্ম কোত্থেকে? এ সব ধারণার পেছনে মূলত কিছু দুর্বল, বানোয়াট ও মনগড়া কথা যা হাদিস বলে চালিয়ে দেয়া হয়েছে, আর কিছু সংখ্যক অদূরদর্শী অল্পশিক্ষিত আলেম এ জাতীয় হাদিসকে পুঁজি করে রঙ ঢঙ লাগিয়ে আলোচনা করার ফলে সমাজে এর প্রচলন হয়ে গেছে। সর্ব সাধারণের কাছে তা নেক আমল ও সওয়াবের বিষয় এবং ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলোর মতো এটি পালন, এ রাতে মসজিদে খিচুড়ি অথবা বিরিয়ানি খাওয়ার আয়োজন আবশ্যিক মনে করা হয়। এলাকার সব মুসল্লিকে দলে দলে মসজিদে গিয়ে বরাতের আলোচনা নফল ইবাদতে সারারাত কাটিয়ে দেয়াকে আবশ্যক বিষয় হিসেবে নেয়া হয়েছে এবং ইসলামের মৌলিক বিষয়াবলির উপর এর অবস্থান দেখা যাচ্ছে। আর যুবক ছেলেরা দলবেঁধে এ মসজিদ থেকে ওই মসজিদে দৌড়াদৌড়ি করবে, মাঝে মধ্যে দুই-চার রাকাত নামাজ আদায় করবে এবং বলাবলি করবে কে কত রাকাত নামাজ আদায় করল? কে কতবার দরুদ পড়ল? আবার বেশির ভাগ সময় পটকা ও আতশবাজি করবে, মোটরসাইকেলের বহর নিয়ে খুব জোরে এদিক ওদিক ছোটাছুটি করবে আর বাসাবাড়িতে কোরমা-পোলাও-পায়েস ও নানা রঙের খাবার তৈরিতে মা-বোনেরা এতই ব্যস্ত হয়ে পড়বে যে, ফরজ নামাজের কথাও ভুলে যাবে অথবা নামাজ আদায় করার সময় পাবে না! বেশির ভাগ এলাকায় এমনটিই দেখা যায়, তা হলে বিষয়টি কেমন হলো? শবেবরাতের অর্থ কি দাঁড়াল?
প্রকৃত বিষয় হচ্ছেÑ ইসলামে যে বিষয়টি যে ভাবে আছে, তার চেয়ে কিছু বাড়িয়ে অথবা কাটছাট করে কমবেশি করার কোনো সুযোগ নেই। যেমন মাগরিবের ফরজ নামাজ তিন রাকাত, কেউ ইচ্ছা করে এটাকে চার রাকাত অথবা দুই রাকাত আদায় করলে যেমন সওয়াবের পরিবর্তে গুনাহ হবে, তদ্রুপ ইসলামের অপরাপর বিষয়গুলোর ক্ষেত্রেও তাই। অর্থাৎ শরিয়তের কোনো বিধানে বাড়ানো বা কমানোর কোনো ক্ষমতা কারো নেই।
শবেবরাতের অস্তিত্ব : (ক) আসলে আমাদের দেশে সাধারণ মানুষ শবেবরাতকে যে অর্থে যেভাবে পালন করছে, ইসলামী শরিয়তে এ অর্থে মূলত কোনো রাত আছে বলে কোনো মুহাক্কিক আলেম বলেন না। ইসলামী জীবন বিধানের মূলনীতি বর্ণিত হয়েছে মহাগ্রন্থ আল কুরআন ও হাদিসে রাসূল সা: থেকে। এ দুটোই আরবি ভাষায়Ñ ফলে শরিয়তের যে সব বিষয় ইসলাম স্বীকৃত তার আরবি পরিভাষা গোটা পৃথিবীতে ব্যাপৃত। পরবর্তীতে সেগুলো অনুবাদ হলেও আরবি পরিভাষা বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। যেমন সালাত, সাওম, হজ ইত্যাদি। তাই বুঝা গেল, শবেবরাত যেমন আরবি পরিভাষা নয়, তেমনি এটা ইসলামী পরিভাষাও নয়।
(খ) ইসলামী শরিয়তে কতগুলো ইবাদত অনুষ্ঠান বা মর্যাদাসম্পন্ন দিন রয়েছে, তার একটিও বছরে একই নামে দুইবার উদযাপিত হয় না। অনেকে লাইলাতুল কদর অর্থে শবেবরাত করে থাকেন। তাদের মনে রাখা দরকার, লাইলাতুল কদর রমজান মাসে শাবান মাসে নয়। সুতরাং শবেবরাত আর লাইলাতুল কদর এক অর্থে নয়।
(গ) কোন সময়ের মর্যাদা কতটুকু তা বর্ণনা করার অধিকার একমাত্র আল্লাহ তায়ালা এবং মুহাম্মদ সা: ছাড়া অন্য কেউ নয় এমন একটি সহিহ হাদিস বা কুরআনের উদ্ধৃতি পাওয়া যাবে না, যেখানে শবেবরাতকে আমরা যেভাবে উদযাপন করছি, তেমনটি করার কথা বর্ণিত হয়েছে।
শাবানের মধ্যবর্তী রাত বা ‘নিসফুস’ শাবানের মর্যাদা ও আমাদের করণীয়-বর্জনীয় : ০১. হজরত আলী রা: রাসূল সা: থেকে যে দীর্ঘ হাদিস বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেছেনÑ যখন শাবান মাসের মধ্যরাত্রি আসবে তখন সে রাত ইবাদতের মাধ্যমে কাটাবে আর দিন কাটাবে রোজা রাখার মাধ্যমে। কেননা, আল্লাহ ওই দিন সূর্যাস্তের সাথে সাথে প্রথম আকাশে অবতরণ করে বলেনÑ ‘কোনো ক্ষমা প্রার্থনাকারী আছে কি? যাকে আমি ক্ষমা করব, কোনো রিজিক অন্বেষণকারী আছে কি? যাকে আমি রিজিক দেবো? কোনো বিপদগ্রস্ত আছে কি? যাকে আমি বিপদ হতে উদ্ধার করব? ইত্যাদি।
০২. হজরত আয়শা রা: থেকে এক দীর্ঘ হাদিস বর্ণিত আছে। তিনি বলেনÑ আমি একদা রাসূলুল্লাহ সা:কে রাতে খুঁজে পাচ্ছিলাম না তখন। আমি তাকে খুঁজতে বেরিয়ে দেখি তিনি জান্নাতুল বাকিতে আকাশের দিকে হাত উত্তোলন করে দোয়া করছেন। হজরত আয়শা রা: বলেন, আমি বললাম হে আল্লাহর রাসূল আমি ধারণা করেছিলাম আপনি অন্য কোনো স্ত্রীর কাছে চলে গেছেন। তখন রাসূল সা: বললেন, ‘শাবান মাসের মধ্যরাতে আল্লাহ প্রথম আকাশে অবতীর্ণ হন। অতঃপর বিশাল সংখ্যক মানুষকে ক্ষমা করে দেন।
০৩. হজরত আবু মুসা রা: নবী করিম সা: থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আল্লাহ শাবান মাসের মধ্যবর্তী রাতের এক বিশেষ ভূমিকায় অবতীর্ণ হন এবং মুশরিক ও হিংসুক ছাড়া সবাইকে ক্ষমা করে দেন।’ উল্লিখিত হাদিস ছাড়া আরো অনেক হাদিস রয়েছে, যে সব হাদিসে শবেবরাতের মর্যাদার কথা পাওয়া যায়। উল্লিখিত হাদিসগুলো সনদের দিক থেকে দুর্বল।
০৪. কিন্তু একটি হাদিসও এরূপ নেই, যে হাদিসে বলা হয়েছেÑ এই রাতে পুরুষ লোক দলে দলে মসজিদে বা কোনো বিশেষ স্থানে একত্রিত হয়ে মিষ্টি, কোরমা, পোলাও, বিরিয়ানি খাবে বা একত্রে দোয়া-মুনাজাত করবে, একত্রে নফল নামাজ আদায় করবে এবং মহিলারা সারাদিন পিঠা-পায়েস তৈরিতে ব্যস্ত থাকবে। ফরজ নামাজ আদায় করারও সময় পাবে না, যেমনটা অনেক বিয়ে বাড়িতে ঘটে। তবুও আমাদের দেশে শবেবরাতকে কেন্দ্র করে যা ঘটে, যেমনÑ যুবক ছেলেরা নামকাওয়াস্তে দুই-চার রাকাত নামাজ আদায় করেই রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়, হুন্ডার বহর নিয়ে এদিক-ওদিক ছুটে বেড়ায়, আতশবাজি, পটকা ফুটানো, খেলনা বোমা ফুটানো ইত্যাদি অপকর্ম করে রাতভর জেগে থাকে, সকালে অনেকেই ফজর নামাজ আদায় না করে ঘুমিয়ে থাকে যা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ও কুসংস্কার।
০৫. ইসলামী সংস্কৃতির নামে পরোক্ষভাবে ইসলামকে হেয় ও ইসলামের অবমাননার শামিল। যা হতে পারে না, হতে দেয়া উচিত নয়। আলেম-ওলামা ও সরকারের উচিত এ বিষয়ে জনসাধারণকে আগেই সতর্ক করা, যেন কোনো দিবসকে কেন্দ্র করে বিশেষ কোনো মহল ফায়দা হাসিল করার সুযোগ না পায়।
আমাদের করণীয় : এ রাতে ইবাদত করতে চাইলে ফরজ নামাজ জামাতে আদায় করে একাকী কিংবা পরিবারকে সাথে নিয়ে নিরিবিলি ইবাদত করার পদ্ধতিই অপেক্ষাকৃত উত্তম। শুধু শবেবরাতের রাতেই আল্লাহ তায়ালা শেষ রাতে বান্দাকে মাগফিরাতের জন্য আহ্বান করেননি, বরং সারা বছরের প্রতি রাত্রেই রাতের শেষভাগে আল্লাহ বান্দাকে বিশেষভাবে ক্ষমা করার জন্য আহ্বান করে থাকেন। তাই আল্লাহর প্রিয় বান্দারা তাহাজ্জুত নামাজ আদায়ের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করে থাকেন। তাহাজ্জুত নামাজ মনিবের কাছে গোলামের চাওয়া-পাওয়ার সর্বোত্তম মাধ্যম এবং শরীরের মেদ ভুঁড়ি ও বাত কমানোর জন্য এক অনন্য উপাদান, এ উপাদানটি যে দেশে যত বেশি কাজে লাগাবে, সে দেশের জনগণ তত বেশি শান্তি, সমৃদ্ধি লাভ করবে, পরনির্ভরশীলতা দূর হবে, আদর্শ জাতি হিসেবে পরিগণিত হবে। আমাদের উচিত এ উপাদানটিকে শক্ত করে ধারণ করা।
রাতের বেলা সুরমা সুগন্ধি ও ভালো পোশাক পরে ভালো খাবার খেয়ে নিজস্ব পরিবেশে থেকে নফল নামাজ, জিকির, দোয়া দরুদ পড়ে রাত্রি জাগা অন্যের ইবাদতে বিঘœ না ঘটানো অসীম সওয়াবের কাজ (আর এটা শুধু শবেবরাতেই নির্দিষ্ট নয়) তাতে কোনো সন্দেহ নেই, দিনের বেলা রোজা রাখার জন্যও হাদিসে উৎসাহ দেয়া হয়েছে। আর প্রতি মাসেই কমপক্ষে তিনটি নফল রোজ রাখার কথা হাদিসে পাওয়া যায়। আর রাসূল সা: শাবান মাসেই সবচেয়ে বেশি নফল রোজা রেখেছেন এই দৃষ্টিকোণ থেকে শাবান মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ এই তিনটি রোজা রাখাই উত্তম।
তবে সাথে সাথে এ কথা অবশ্যই মনে রাখতে হবে, এই দিনে গোশত-পোলাও, রুটি-হালুয়া ইত্যাদি খেতেই হবে যেকোনো মূল্যে এসবের ব্যবস্থা করতেই হবে, এ রাতে এসব খাবার না খেলেই নয়! হালুয়া-রুটি বিতরণ না করলেই নয়! ইত্যাদি ধারণা পোষণ করা মোটেই ঠিক নয়। এ সব ধারণা পোষণ করা ঈমান-আকিদার পরিপন্থী। কিন্তু এই ধারণা পোষণ করা যাবে না যে, শবেবরাত মানেই মসজিদে জড়ো হওয়া আবশ্যক, শবেবরাত মানেই গোটা বছরের ভাগ্য নির্ধারণ করা, শবেবরাত মানেই হালুয়া-রুটি খাওয়া বা বিতরণ করা। আল্লাহ আমাদের সবাইকে সঠিক বুঝ দান করেন।
লেখক : প্রবন্ধকার