প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে শিক্ষক ও অভিভাবকদের উদ্দেশে বলেছেন পড়াশোনা নিয়ে শিশুদের যেন কোনো অবস্থাতেই অতিরিক্ত চাপ না দেয়া হয়। শিক্ষারপ্রতি শিশুর মনে যেন ভীতির সৃষ্টি না হয়। শিশুরা যাতে আনন্দময় পরিবেশে হাসতে খেলতে মজা করে পড়ালেখা করতে পারে। সে জন্য শিক্ষাকে শিশুদের জন্য আকর্ষণীয় করার ওপর জোর দেন তিনি।
কিন্তু অভিভাবকদের অভিযোগ প্রধানমন্ত্রী শিশুদের লেখাপড়া নিয়ে যে নির্দেশনা দিয়েছেন বর্তমানে চলছে তার ঠিক উল্টো। বর্তমানে শিশুরা পড়ার চাপে পিষ্ট। পড়ালেখা নিয়ে তারা তীব্রভাবে ভীত, আতঙ্কিত। তারা শিকার হচ্ছে তীব্র মানসিক চাপ আর শারীরিক নির্যাতনের। প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখার প্রতি তাদের আগ্রহ কমে গেছে। অতিরিক্ত পড়ার চাপে শিশুদের মেধা ও মননের বিকাশ বর্তমানে রুদ্ধ। তাদের নিজস্বতা বলতে আর কিছু নেই।
লেখাপড়া নিয়ে শিশুদের বর্তমান এই দুর্দশার কারণ হিসেবে কয়েকজন অভিভাবক জানালেন এর একমাত্র কারণ অতিরিক্ত পরীক্ষা। বিশেষ করে সমাপনী এবং জেএসসি পরীক্ষার মাধ্যমে শিশু ও কিশোরদের প্রচণ্ড মানসিক চাপের মধ্যে ফেলা হয়েছে। চলছে তাদের ওপর শারীরিক নির্যাতন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বেত ও লাঠি উঠিয়ে দেয়া হলেও ঘরে ঘরে চলছে শিশু নির্যাতন। পরীক্ষার কারণে প্রায় প্রতিদিন এসব শিশু শারীরিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।
অভিভাবকরা জানান, পড়া যে কঠিন করা হয়েছে এবং পড়ার পরিমাণ যেভাবে বাড়ানো হয়েছে শিশু ও কিশোরদের জন্য তাকে না মেরে তাদের কাছ থেকে পড়া আদায় করা সম্ভব নয়। ভালো ফলও করা সম্ভব নয়।
রাজধানীর অনেক অভিভাবক জানিয়ছেন সম্প্রতি প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত শিশুদের পরীক্ষা তুলে দেয়ার ঘোষণা দেয়া হলেও বেসরকারি স্কুলে অব্যাহত রয়েছে নিয়মিত ক্লাস টেস্ট। আর এ পরীক্ষা ঘিরে ছোট্ট শিশুদের প্রায় প্রতিদিনই মা-বাবার হাতে মার খেতে হচ্ছে অনেকে।
তবে শিশু ও কিশোররা সবচেয়ে বেশি শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে সমাপনী ও জেএসসি পরীক্ষা ঘিরে। পড়ার চাপে জিপিএ ৫ এর প্রতিযোগিতার কারণে শিশু-কিশোররা শুধু যে তাদের শৈশব-কৈশোর হারিয়ে ফেলছে তা নয় বরং অনেকে যেন মানসিক প্রতিবন্ধী হিসেবে বেড়ে উঠছে।
এক দিকে একের পর এক পাবলিক পরীক্ষা তার ওপর বেড়েছে বইয়ের পরিমাণ। বেড়েছে পড়ার পরিমাণ।
এ ছাড়া রয়েছে সৃজনশীলের জটিলতা ও দুশ্চিন্তা। বিশেষ করে গ্রামের শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের কাছে এখনো সৃজনশীল একটি বড় ধরনের আতঙ্ক আর হয়রানি। শহরের শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরাও সৃজনশীলের কারণে বিরক্ত অতিষ্ঠ। অনেকেরই অভিযোগ পড়ার আগা মাথা কোনো কিছু ঠিক নেই। সব কিছু এলোমেলো করে ফেলা হয়েছে।
পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণী শেষে পাবলিক পরীক্ষার কারণে প্রায় সব মা বাবা তাদের সন্তানদের নিয়ে লিপ্ত রয়েছেন জিপিএ ৫ এর তীব্র প্রতিযোগিতায়। স্কুলের পাশাপাশি প্রাইভেট শিক্ষক আর কোচিংয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে জীবন পানি হয়ে যাচ্ছে শিক্ষার্থীদের। শুধু শিক্ষার্থী নয় অভিভাবকদেরও অনেকের স্বাভাবিক জীবন বলতে যেন আর কিছু অবশিষ্ট নেই। বিশেষ করে শহরের অনেক মায়েদের ঘর-সংসারের দিকে মনোযোগ দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। শিশুদের সারা দিন শুধু ‘পড়’, ‘পড়’, ‘পড়’ এর মধ্যেই রাখতে হচ্ছে সমাপনী পরীক্ষার কারণে।
রাজধানীর অনেক অভিভাবক স্বীকার করে বলেছেন, তারা তাদের সন্তানদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করতে বাধ্য হচ্ছেন। তাদের স্বাভাবিক জীবন নষ্ট করছেন। শিশুরা নিষ্ঠুরতার শিকার হচ্ছে। তাদের অতিরিক্ত চাপ দেয়া হচ্ছে পড়ার জন্য। আর এর একমাত্র কারণ ঘন ঘন পাবলিক পরীক্ষা। এসব পরীক্ষা না থাকলে তাদের শিশুরা এভাবে নির্যাতনের শিকার হতো না। অতিরিক্ত পরীক্ষা, অতিরিক্ত পড়া আর সৃজনশীলসহ নানা কারণে শিশুদের পড়ার প্রতি আগ্রহ কমে গেছে। তাদের নিজস্ব মেধা ও মননের বিকাশ নস্যাৎ করা হয়েছে। এটা ভবিষ্যতের জন্য কোনো অবস্থাতেই ভালো হতে পারে না। পরীক্ষা আর পড়ার চাপ নিয়ে শিশুদের দুর্দশার কারণে মর্মাহত অনেক মা-বাবা।
অভিভাবকরা জানান, শিশুদের লেখাপড়া নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যা বলেছেন তা বাস্তবে পরিণত করতে হলে শিশুদের পরীক্ষা থেকে মুক্ত করতে হবে। বিশেষ করে সমাপনী ও জেএসসি পরীক্ষা বাতিল করতে হবে। প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পরীক্ষা তুলে দেয়ায় অনেকে আনন্দ প্রকাশ করে বলেছেন, সমাপনী ও জেএসসি পরীক্ষা দু’টিও তুলে দিলে আমরা একটু শান্তি পেতাম।
ফজিলা নামে রাজধানীর রামপুরার একজন অভিভাবক জানান, শিশুরা সারা দিন বাসায় বন্দী। বাইরে খেলাধুলার কোনো সুযোগ নেই। তাই সুযোগ পেলেই ঘরে বসে টিভি, মোবাইলে কার্টুন দেখার চেষ্টা করে। কিন্তু এখন তাও বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছি। কারণ অতিরিক্ত পড়ার চাপ। ফজিলা জানান, তার মেয়ে সর্বশেষ সমাপনী পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে। সে ভীষণ রকমের টিভি আসক্ত ছিল। কিন্তু তাকে টিভি দেখতে দেয়া হয়নি গত বছর। এবার ষষ্ঠ শ্রেণীতে উঠেছে সে।
কিন্তু এখনো সে আর আগের মতো টিভি দেখার সুযোগ পাচ্ছে না। কারণ প্রতিদিন স্কুলে পড়ার যে চাপ তাতে সারা দিন পড়ার টেবিলে বসে থাকলেও কুলানো যাচ্ছে না। ষষ্ঠ শ্রেণীর একজন শিক্ষার্থীর জন্য এত পড়ার চাপ এটা আমাদের কাছে ভয়াবহ। আমাদের সময় এত পড়া ছিল না। এখন ১৪টি সরকারি পাঠ্যবই। অনেক বিষয়ে পরীক্ষার ব্যবস্থা নেই। কিন্তু স্কুল থেকে নিয়মিত ক্লাস টেষ্ট নেয়া হয়।
এক গাদা করে হোমওয়ার্ক আর অ্যাসাইনমেন্ট দেয়া হয়। পরীক্ষা নেই তার মানে এসব বিষয় শিশুরা আনন্দের সাথে পড়বে। কিন্তু তার সুযোগ নেই। নিয়মিত ক্লাস নেয়া হচ্ছে এবং পুরো বই পড়তে হচ্ছে সব বিষয়ের মতো করে। এটা মেনে নেয়া যায় না। সরকারের উচিত পাঠ্যবই কমানো। যেসব বিষয়ে সরকারিভাবে পরীক্ষা নেই সেসব বিষয়ে স্কুল থেকেও পরীক্ষা নেয়া নিষিদ্ধ করা উচিত।