স্বপ্নের বিশ্বকাপ ও টাইগারদের প্রস্তুতি

গুনতে গুনতে শেষ হয়ে গেলো চারটি বছর। সময়ের চলমান স্রোতধারায় নির্দিষ্ট নিয়মেই, আবারো বসতে যাচ্ছে- বিশ্বকাপ ক্রিকেটের আসর। গালে প্রিয় দলের ট্যাটু, হাতে ছক্কা-চারের প্ল্যাকার্ড নিয়ে গ্যালারি আর টিভির পর্দার সমানে উন্মাদনায় ও ক্রিকেটবোদ্ধাদের তর্ক-বিতর্কে শুরু হতে হচ্ছে বিশ্বকাপ ক্রিকেটের ১২তম আসর। আগামী ৩০ মে ইংল্যান্ড ও ওয়েলসের যৌথ আয়োজনে পর্দা উঠবে স্বপ্নের বিশ্বকাপের। প্রত্যেক দলেরই স্বপ্ন থাকে, ক্রিকেটের সর্বোচ্চ শিরোপাটি ছোঁয়ার; কিন্তু সবার ভাগ্যে কি আর তা জোটে? তবুও সবাই চায়, সেই কাঙ্খিত স্বপ্ন পূরণ করতে।

১০ দেশকে নিয়ে বসবে বিশ্বকাপ ক্রিকেটের এই আসর। ৩০ মে ওভালে স্বাগতিক ইংল্যান্ড ও দক্ষিণ আফ্রিকা উদ্বোধনী ম্যাচ খেলবে। ১৪ জুলাই লর্ডসে ফাইনাল ম্যাচের মধ্য দিয়ে আসরের সমাপ্তি ঘটবে।

এমন স্বপ্নের বিশ্বকাপ নিয়ে ইতোমধ্যেই মাতামাতির শেষ নেই। খেলোয়াড়রা নিজেদের শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতিতে ঘাম ঝড়াচ্ছেন। তবে ক্রীড়াবিদরা মনে করেন, পূর্বের আসরগুলোর চেয়ে এবারের আসরটি একটু ভিন্ন মাত্রার হবে। কারণ অন্য আসরগুলোতে নির্দিষ্ট কয়েকটি শিরোপাধারী দল থাকত এবং তারাই বিশ্বকাপ উঁচিয়ে ধরতো; কিন্তু এবারের বিশ্বকাপে হট ফেবারিট কিংবা ‘কুল ফেবারিট’ কোন দলকেই বলা যাচ্ছে না। কারণ, সবগুলো দলই অনেক শক্তিশালী।

এমন মহারণে নামার আগে সব দলই প্রস্তুতি সারতে ব্যস্ত। পিছিয়ে নেই বাংলাদেশও। এশিয়ার বাইরের পিচ মানেই পেস বোলারদের দাপট। আর ক্রিকেটের বধ্যভূমিখ্যাত ইংল্যান্ডের পিচ এর অন্যতম। বাউন্স, গতি ও সুইংয়ের সমন্বয়ে ইংল্যান্ডের পিচ গড়া। কিন্তু এমন পিচে ব্যাটে বলের লড়াইয়ের জন্য কতটা প্রস্তুত বাংলাদেশ দল।

বিশ্বকাপের বিমানে ওঠার আগে আগে টাইগারদের সর্বশেষ দ্বিপক্ষীয় সিরিজ ছিলো নিউজিল্যান্ড সফরে। এই সিরিজটিকেই টাইগারদের বিশ্বকাপ প্রস্তুতি হিসেবে ধরা হয়েছিলো। এমন গুরুত্বপূর্ণ সিরিজ কতটুকু কাজে লাগিয়েছে মাশরাফি বাহিনী?

নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে পুরো সিরিজ জুড়ে চোখ বুলিয়ে যা দেখা যায়, তা শুধু হাতাশায় ভরা। কারণ, বাংলাদেশ দল ৩-০ তে হোয়াইটওয়াশ হয়ে কিউইদের বিপক্ষে ওডিআই সিরিজ শেষ করে। এই সফরে যাওয়ার আগে থেকেই বড় সমস্যা আকার ধারণ করে ইনজুরি। ভয়াল ইঞ্জুরি হানা দেয় টাইগার দলে। তবলা ছাড়া গান যেমন, সাকিব ছাড়া বংলাদেশের দলের অবস্থাও তেমন। দলের অন্যতম খেলোয়াড় সাকিব আল হাসান ছিলেন না সিরিজ জুড়ে। দলের অন্যতম বোলার তাসকিন আহমেদ ও প্রথম দুই ম্যাচে অর্ধশতক হাঁকানো মোহাম্মদ মিথুনকেও শেষ ম্যাচে হারায় বাংলাদেশ। বলা যায়, ইনজুরিও দলকে অনেক পিছিয়ে দিয়েছে। তবে এতকিছুর পরও যে দল গড়া হয়েছিল তারা নিজেদের সামর্থ্যের সবটুকু দিয়ে লড়তে পারেনি সেকথা নিশ্চিত।

এই সিরিজের কোনো ম্যাচেই বাংলাদেশ দল ব্যাটিং করতে পরেনি পুরো ৫০ ওভার। পাড়ি দিতে পারেনি আড়াইশ রান। বিপক্ষ দলের বোলারদের কাছে নতজানু হয়ে উইকেট বিলিয়ে দিয়েছে ব্যাটসম্যানরা। প্রথম দুই ম্যাচ ৮ উইকেটে এবং শেষ ম্যাচে ৮৮ রানের বড় ব্যবধানে স্বাগতিকদের কাছে হারে বাংলাদেশ। সিরিজে টপ অর্ডারের অবস্থা ছিল একদমই নাজুক। সিরিজ জুড়ে তিন টপ অর্ডার মিলে সংগ্রহ করেন মাত্র ৬৫ রান। এর মধ্যে দলের অন্যতম ব্যাটসম্যান তামিম ইকবাল তিন ম্যাচ মিলিয়ে সংগ্রহ করেন (১০) রান। হার্ড হিটার লিটন দাস গড়ে ১ রান করে তিন ম্যাচে সংগ্রহ করেন (৩) রান।

আরেক টপ অর্ডার সৌম্য সরকারের ব্যাট থেকে আসে ৫২ রান। টপ অর্ডারের সঙ্গে সমান তালে ছিলো মিডল অর্ডারদের ব্যাটিংও। ব্যাটসম্যানদের এমন দৈন্যদশা সিরিজে বোলাররাও ছিলেন না ছন্দে। তিন ম্যাচ মিলিয়ে কিউইদের মাত্র ১০ উইকেট শিকার করতে পেরেছে টাইগার বোলাররা। এমন হতাশার সিরিজের মধ্য দিয়েই টাইগারদের বিশ্বকাপ প্রস্তুতি সেরেছে বলা যায়।

ব্যর্থ সফরের পর নির্বাচকমণ্ডলির হাতে ছিলো ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ (ডিপিএল)। খেলোয়াড়রা হয়তো এখানে নিজেদের মেলে ধরতে পারবে; কিন্তু নিউজিল্যান্ড সফরে যারা অধারাবাহিক ছিলেন, ডিপিএলেও তারা ব্যর্থ। সৌম্য, সাব্বির ও মিথুন সবাই এখানে ফ্লপ। ডিপিএলে ২৭.১০ গড়ের ওপরে নেই কারো রান। নিউজিল্যান্ড সফরের বোলিংয়ের চিত্রও পরিবর্তন হয়নি বোলারদের ক্ষেত্রে। যে কারণে খেলোয়াড়দের ফর্মহীনতায় নির্বাচকমণ্ডলি ইতোমধ্যে তাদের দুশ্চিন্তার কথা জানিয়েছেন।

তবুও এই দলটাই বাংলাদেশের বর্তমান ওডিআই ফরম্যাটের সেরা দল। এর বাইরে হয়তো অন্যদের নিয়ে চিন্তা নেই নির্বাচকদের মাঝে। তাই অধিনায়ক মাশরাফি এই দল নিয়েই সন্তুষ্টির কথা জানিয়েছেন।

মাশরাফি, তামিম, সাকিব, মাহমুদুল্লাহ ও মুশফিক, এই পঞ্চস্তম্ভ দলের সবচেয়ে বড় ভরসা। বাংলাদেশকে অনেক আনন্দের উপলক্ষ্য এনে দেয়া এই পাঁচ তারকার একসাথে বিশ্বকাপই হয়তো শেষ সিরিজ বা টুর্নামেন্ট। তাই নিজেদের অভিজ্ঞতার প্রমাণ করার সুবর্ণ সময়, আর তরুণদেরও প্রমাণ করার উপযুক্ত সময় এটি।

সিনিয়রদের সঙ্গে যদি টপ অর্ডারে লিটন-সৌম্য জ্বলে ওঠেন, আর লেয়ার অর্ডারে কিউই সিরিজে প্রমাণিত ব্যাটসম্যান মিথুন, সাব্বির, সাইফুদ্দিন ও মিরাজের ব্যাটও যদি হাসে, তবে বিশ্বকাপে বাংলাদেশ আন্ডারডগ নয়; বরং চ্যালেঞ্জিং দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারে।

বোলিং অ্যাটাকে অগ্রজ মাশরাফি বিন মর্তুজার নেতৃত্বে থাকবেন দলের অন্যতম বোলার মোস্তাফিজুর রহমান। তবে ইংল্যান্ড ও ওয়েলসে সবচেয়ে কার্যকরী বোলার হতে পারেন তাসকিন আহমেদ। তার বলের গতি ও সুইং দুটোই কাজে লাগতে পারে। ২০১৫ বিশ্বকাপে তিনি অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডে সেটা দেখিয়েছেন। সম্প্রতি এই বোলারের ফর্মও অনেক তুঙ্গে। তাই বলা যায়, বিশ্বকাপে দলের অন্যতম বোলার হতে পারেন তাসকিন। এছাড়াও রয়েছেন রুবেল হোসেন ও অলরাউন্ডার সাইফুদ্দিন।

স্পিন বিভাগে ব্যাটিং-বোলিংয়ের ট্রাম্পকার্ড সাকিব আল হাসানের সঙ্গে মেহেদি হাসান মিরাজ ও নাঈম হাসানরা রয়েছেন। ব্রেক থ্রু এনে দিতে আছেন, সাইলেন্ট কিলার মাহমুদুল্লাহ ও সৌম্য।

বলা যায়, ব্যাটিং-বোলিং ও আলরাউন্ডার তিন ফরম্যাটে পরিপূর্ণ এক টাইগার দল। তাই তাদের কাছে প্রত্যাশাও এবার বড় কিছুরই থাকবে টাইগার সমর্থকদের।

মুল পর্বে নামার আগে কার্ডিফে ২৬ মে পাকিস্তানের বিপক্ষে ও ২৮ মে ভারতের বিপক্ষে আইসিসি ঘোষিত প্রস্ততি ম্যাচ খেলবে বাংলাদেশ। এই কার্ডিফই ২০০৫ সালে অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়েছিলো বাংলাদেশ ও ২০১৭ সালে নিউজিল্যান্ডকে পরাজিত করে আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে সেমিফাইনালের পথে এগিয়ে যায় বাংলাদেশ।

প্রথম ম্যাচে ২ জুন ওভালে দক্ষিণ আফ্রিকা বিপক্ষের ম্যাচ দিয়ে বিশ্বকাপ শুরু করবে বাংলাদেশ দল, ৫ জুন একই মাঠে নিউজিল্যান্ডর মুখোমুখি হবে, ৮ জুন কার্ডিফে ইংল্যান্ড, ১১ জুন ব্রিস্টলে শ্রীলঙ্কা, ১৭ জুন টন্টনে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ২০ জুন নটিংহ্যামে অস্ট্রেলিয়া, ২৪ জুন সাউদাম্পটনে অফগানিস্তান, ২ জুলাই বার্মিংহ্যামে ভারত ও ৫ জুলাই লর্ডসে পাকিস্তানের বিপক্ষে মাঠে নামবে বাংলাদেশ।

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top