যার সাথে খুনসুঁটি চলতো প্রতিদিন। আজকে চার দিন হলো সেই খুনসুঁটি করা মানুষের মুখটা আর দেখা যায় না। বোন নুসরাত জাহান রাফিকে হারিয়ে ছোট ভাই রাশেদুল হাসান রায়হান যেন হয়ে গেছে জীবন্ত লাশ। বোনকে হারিয়ে অসুস্থ হয়ে শুক্রবার থেকে ফেনীর একটি হাসপাতালে ভর্তি রায়হান।
পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, নুসরাত থেকে দুই বছরের ছোট রায়হান। বোনের সাথে ছোট থেকে বেড়ে ওঠে খেলাধুলা, গল্প, আড্ডা আর চলার পথের সঙ্গী হিসেবে। সেই প্রিয় বোনের অসহ্য মৃত্যুযন্ত্রণা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছে না রায়হান। বোনের সাথে কাটানো অতীতের স্মৃতি ভুলতে পারছে না কোনোভাবেই। চোখের পানি শুকিয়ে, নেই অনেক দিন কোনো খাওয়া-দাওয়া। রাফির মৃত্যুর সময় থেকেই বার বার জ্ঞান হারাচ্ছে, জ্ঞান ফিরলে আবার রাফিকেই খুঁজছে রায়হান।
বাবা কে. এম. মূসা বলেন, নুসরাতের মৃত্যুতে সবচেয়ে বড় শোকাহত ছোট ভাই রায়হান। সে নুসরাত থেকে মাত্র দুই বছরের ছোট। দুই ভাই-বোন একসঙ্গে মাদরাসায় আসা-যাওয়া করত। নুসরাত ছিল আলিম পরীক্ষার্থী আর রায়হান দশম শ্রেণীর ছাত্র।
৬ এপ্রিল সকাল ৯টার দিকে এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষায় (আলিম পরীক্ষা) আরবি প্রথম পত্র পরীক্ষা দিতে সোনাগাজী ফাযিল সিনিয়র মাদরাসা কেন্দ্রে যান ওই নুসরাত। এরপর তাকে কৌশলে পাশের ভবনের ছাদে ডেকে নিয়ে বোরকা পরিহিত ৪-৫ জন ব্যক্তি মিলে তার গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেয়।
পরিবারের দাবি, মাদরাসা অধ্যক্ষ সিরাজদ্দৌলার বিরুদ্ধে অশ্লীলতাহানির মামলা তুলে না নেয়ায় এই ঘটনা ঘটেছে। এই তথ্য নুসরাত হাসাপতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় প্রশাসনের কর্মকর্তাদেরও বলেছিল।
অবস্থা সংকটাপন্ন হওয়াতে ৬ এপ্রিল বিকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের ১০২ নম্বর কক্ষে তাকে ভর্তি করা হয়। পরে তাকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে (আইসিইউ) ভর্তি করা হয়। লাইফ সাপোর্ট দেয়া হয়। ১০ এপ্রিল রাত সাড়ে নয়টার দিকে নসরাত না ফেরার দেশে চলে যায়।
অধ্যক্ষের নির্দেশেই নুসরাতকে হত্যার পরিকল্পনা
নুসরাত জাহান রাফিকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলা। সব মিলিয়ে নুসরাত হত্যাকা-ের সঙ্গে ১৩ জনের সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পেয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। তবে নুসরাতের গায়ে সরাসরি আগুন দেয় চারজন।
আজ শনিবার রাজধানীর ধানমন্ডিতে পিবিআইয়ের হেড কোয়ার্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান পিবিআইয়ের ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার।
তিনি বলেন, যারা আগুন দিয়েছিল তাদের মধ্যে একজন ছিল শাহাদাত হোসেন শামীম। শম্পা নুসরাতকে ওপরে যেতে বলেছিল। আরেকটি মেয়ে ছিল (যার পরিচয় গোপন রাখা হয়েছে)। আগুন দিয়ে পরে মাদরাসার মূল গেট দিয়েই সরে যায় দুর্বৃত্তরা।
পিআইবি জানায়, নুসরাত জাহান রাফির গায়ে অগ্নিসংযোগ করে হত্যার ঘটনার সাথে এ পর্যন্ত মোট ১৩ জনের সংশ্লিষ্টতা পেয়েছেন তারা। এর মধ্যে মামলার এজাহারভুক্ত সাতজন এবং সন্দেহভাজন হিসেবে ছয়জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। নুসরাতের গায়ে সরাসরি আগুন দেয় যে চারজন তার মধ্যে এক নারীসহ দুইজনকে এরই মধ্যে চিহ্নিত করা গেছে। এই দুইজনের একজন শাহাদাত হোসেন শামীমকে নিয়ে সংশ্লিষ্ট আরো কয়েকজনের গ্রেফতারের অভিযান চলছে। তবে শাহাদাতকে এখনো আনুষ্ঠানিক গ্রেফতার দেখানো হয়নি।
পিবিআই জানিয়েছে, ৮ এপ্রিল নুর উদ্দীনসহ আরো কয়েকজন অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলার সাথে কারাগারে দেখা করতে গিয়েছিলেন। তখন অধ্যক্ষ তাদের বলেছিলেন, তোমরা আমার জন্য কী করতে পেরেছো? তার মুখ বন্ধ করে দাও তোমরা। তা না হলে পরে সমস্যা হবে।
তখন বাসায় ফিরে নুররা সিদ্ধান্ত নেন নুসরাতকে যে করেই হোক মাইনাস করতে হবে। তারা পরিকল্পনা নেয় নুসরাতকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করার। অভিযুক্ত নুর উদ্দীন জিজ্ঞাসাবাদে এসব বিষয় স্বীকার করেছেন বলে জানিয়েছেন পিবিআই।
এর আগেও নুসরাতের উপর হামলা হয়েছিল। তখন চুন মারা হয়েছিল তার চোখে। সে সময় ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়েছিল নুসরাত।