সবাইকে কাঁদিয়ে গত বুধবার রাত সাড়ে নয়টায় এ জগতের মায়া কাটিয়ে চলে যান মাদরাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি। এরপর আরো দুইদিন পার হলেও এখনো জানা যায়নি ওই কিলিং স্কোয়াডে ঠিক কারা ছিল। তবে এ ব্যাপারে পিবিআই জানিয়েছে, বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অচিরেই হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িতদের ব্যাপারে জানা যাবে।
গত ঘটনার দিন ৬ এপ্রিল আরবি প্রথম পত্রের পরীক্ষা দিতে ভাই মাহমুদুল হাসান নোমানকে নিয়ে পরীক্ষা কেন্দ্রে গিয়েছিলেন নুসরাত জাহান রাফি। এ সময় শুধু প্রবেশপত্র ও কলমসহ একটি ফাইল নিয়ে সোনাগাজী সিনিয়র ফাজিল ডিগ্রি মাদরাসা কেন্দ্রে প্রবেশ করতে দেয়া হয় তাকে। তার ভাইকে আটকে দেয়া হয় কেন্দ্রের গেটেই। এরপর কাগজপত্র নিয়ে নিজের নির্ধারিত আট নম্বর কক্ষে চলে যান নুসরাত।
এ সময় একজন এসে তাকে জানায়, মাদরাসার অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগে দায়ের করা মামলায় সাক্ষী ও নুসরাতের বান্ধবী নিশাতকে ছাদে মারধর করা হচ্ছে। এ কথা শুনে নিজের কাগজপত্র রেখে বান্ধবীকে বাঁচাতে তিনতলার ছাদে চলে যান নুসরাত। সেখানে গিয়ে বোরকা পরা চারজনকে দেখতে পান। এদের মধ্যে দুইজন নুসরাতকে মামলা তুলে নিতে চাপ দেন। কিন্তু নুসরাত তাতে রাজি না হওয়ায় এক পর্যায়ে নুসরাতের দুই হাত দড়ি দিয়ে পেছনে বেঁধে ফেলে তারা। পরে কেরোসিন দিয়ে তার শরীরে আগুন লাগিয়ে দেয় তারা। আগুন লাগানোর পর সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসে অপরাধীরা।
জানা গেছে, পরীক্ষা শুরুর আগে সকাল সাতটা থেকে সাড়ে নয়টা পর্যন্ত ওই মাদরাসায় দাখিল বিভাগের ক্লাস চলে। সাড়ে নয়টার দিকে একদিকে আলীম পরীক্ষার্থীরা পরীক্ষায় অংশ নিতে কেন্দ্রে প্রবেশ করেন। সে সময় দাখিলের শিক্ষার্থীরা মাদরাসা থেকে বের হয়ে যান। ধারণা করা হচ্ছে, এ সুযোগটিকে কাজে লাগিয়েই অপরাধীরা ওই সময়ে কেন্দ্রে প্রবেশ করে এবং আগুন লাগিয়ে পালিয়েও যায়। বিশেষ করে বোরকা ও হাতমোজা থাকায় তাদেরকে আর আলাদা করে চিহ্নিত করা যায়নি।
ওই কিলিং মিশনে অংশ নেয়া বোরকা, হাতমোজা ও চশমা পরা চারজনের কথা উল্লেখ করা আছে মামলার এজাহারে। এদের মধ্যে দুইজনকে নারী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে আর বাকি দুইজন নারীর ছদ্মবেশে পুরুষ বলে ধারণা করা হচ্ছে।
কিন্তু তিনদিন পার হয়ে গেলেও নুসরাতকে হত্যার সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত ব্যক্তিদের এখনো শনাক্ত করা যায়নি। তবে এক্ষেত্রে কাজ চলছে বলে জানিয়েছেন পুলিশ ও গোয়েন্দা কর্মকর্তারা।
এদিকে নুসরাতের আত্মীয়-স্বজন ও এলাকাবাসীর ধারণা ওই কিলিং স্কোয়াডে দুইজন নারী থাকলেও বাকি দুইজন পুরুষ হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। বিশেষ করে গতকাল গ্রেফতার হওয়া নুরউদ্দিনের শারীরিক গঠন ছোটখাটো হওয়ায় অনেকেই মনে করছেন সে ওই কিলিং স্কোয়াডে ছিল। কারণ ঘটনার পরপরই তাকে মাদরাসা থেকে বের হতে দেখা যায়। এমনকি সে ছাঁদে ম্যাচ ও কেরোসিন দেখার কথাও জানায়। তবে তাকে দাঁড়াতে বললে, সে জানিয়েছিল, এখন দাঁড়ানোর সময় নেই। এরপর থেকেই সে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। পরে গতকাল শুক্রবার ময়মনসিংহ থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়।
মাদরাসার শিক্ষক ও স্থানীয়রা ধারণা করছেন অধ্যক্ষ এসএম সিরাজ উদ দোলাহর ঘনিষ্ঠ ও আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিত নুর উদ্দিন আগুনের ঘটনায় নেতৃত্ব দিতে পারেন। যৌন হয়রানির মামলায় সিরাজ উদ দৌলাকে গ্রেপ্তারের পর তার মুক্তির দাবিতে সংগ্রাম পরিষদও গড়ে তুলেছিলো নুর উদ্দিন। ২০১৭ সালে প্রেমের প্রস্তাবে সাড়া না দেয়ায় নুসরাতকে চুনের পানি দিয়ে ঝলসে দিয়েছিলেন শ্রমিক থেকে অধ্যক্ষের কাছের বনে যাওয়া নুর উদ্দিন।
এছাড়া, মামলার আরেক আসামি শাহাদাত হোসেনও এই ঘটনায় জড়িত থাকতে পারে দাবি করেছেন নুসরাতের পরিবার। সোনাগাজী সিনিয়র ফাজিল ডিগ্রি মাদরাসায় কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ অনুমোদিত কোন কমিটি না থাকলেও শাহাদাত ছিলেন অধ্যক্ষ সিরাজ ঘোষিত ছাত্রলীগ সভাপতি। শুক্রবার এ দুজনকেই ময়মনসিংহ থেকে গ্রেফতার করা হয়।
স্থানীয়রা আরো বলছেন, সম্পূর্ণ পরিকল্পিতভাবেই এ হত্যাকা- ঘটানো হয়েছে। নইলে পরীক্ষাকেন্দ্রের মতো একটি স্পর্শকাতর স্থানে এ রকম অপরাধ করে পার পেয়ে যাওয়ার কথা ছিল না। একই সাথে সে সময় কর্তব্যরত পুলিশের গাফলতির কথাও তারা তুলে ধরছেন। পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন পিবিআই ও জেলা পুলিশও বিষয়গুলো মাথায় রেখে ঘটনার মূল হোতাদের ধরতে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।
উল্লেখ্য, নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় দায়ের করা মামলায় আসামি করা হয়েছে অধ্যক্ষ এস এম সিরাজ উদ দোলাহসহ আটজন ও আরো অজ্ঞাতনামা চারজনকে। এদের মধ্যে একজনকে শম্পা নামে ডাকা হয়েছিল বলে জানিয়ে গিয়েছিল নুসরাত। কিন্তু সেটি তার মূল নাম না কি ছদ্মনাম সে রহস্যের এখনো সমাধান করতে পারেনি পুলিশ।
এদিকে, নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যার মামলার তদন্তের দায়িত্বে থাকা পিবিআই জানিয়েছে, মামলার তদন্তে যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে। এ পর্যন্ত মোট এগারোজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।এদের জিজ্ঞাসাবাদ থেকে মূল কিলিংয়ে অংশ নেয়াদের বিষয়েও নিশ্চিত হওয়া যাবে।