‘ওয়াবদাআলারা মোর বাপ, দাদী, স্ত্রী আর পোলার কবরের মাডিও লইয়া গ্যাছে’

‘বলেশ্বর সব ভাঙছে, বাপ-দাদার কবর ভাঙতে পারে নায়। কিন্তু ওয়াবদাআলারা মোর বাপ, দাদী, স্ত্রী আর পোলার কবরের মাডিও লইয়া গ্যাছে। যারা মোর বাপের কবরের মাডি লইয়া ব্যবসা হরছে, মুই হেগো বিচার চাই।’

বিশ্ব ব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় শরণখোলা উপজেলার নির্মাণাধীন ৩৫/১ পোল্ডারের বেড়ি বাঁধ সংলগ্ন রাজেশ্বর গ্রামের হোসেন পহলানের পুত্র জেলে আতাহার পহলান (৮৫) ক্ষোভ নিয়ে ওপরের কথাগুলো বলছিলেন।

ওই গ্রামেই তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা। বলেশ্বর নদীর অব্যাহত ভাঙ্গনে তাদের সে বাড়ী ঘর চলে যায় বেড়ি বাঁধের বাইরে। বলেশ্বরের ঢেউয়ের আঘাতে গ্রামের পর গ্রাম ও ঘর-বসতি বিলীন হলেও তাদের কবরস্থানটি ভাঙেনি। যেখানে সমাহিত হয়েছেন তার বাবা হোসেন পহলান, দাদী মেহেরজান, স্ত্রী বেগম ও পুত্র মজিবুল। বলেশ্বর নদী সব কেড়ে নিলেও এ কবরগুলো কেড়ে নেয়নি।

প্রতিদিন সকালে ঘুম ভাঙার নদীর পাড়ে ছুটে এসে বেড়ি বাঁধে দাঁড়িয়ে কবরের দিকে তাকিয়ে দেখতেন আর মনে মনে ভাবতেন, বলেশ্বর ভালোবেসেই ভাঙেনি এ কবরগুলো। এমনটাই বিশ্বাস ছিল তার। এ বিশ্বাস নিয়েই কেটেছে আতাহার পহলানের জীবনের ৫০ বছর।

কিন্তু তার এ বিশ্বাস যে ঠিক ছিল না টের পেলেন এ বৃদ্ধ বয়সে এসে। দু‘সপ্তাহ আগে প্রতিবেশী শাহাদৎ মিয়ার ট্রলারে সুন্দরবনে মাছ ধরতে যান তিনি। বাড়িতে ফিরে এসে দেখেন, কবরগুলোর কোনো চিহ্ন নেই। বেড়ি বাঁধ নির্মাণের জন্য ওই কবরস্থান ও সংলগ্ন চরের মাটি কেটে নেয়া হয়েছে। লোকমুখে শুনেছেন, তার বাড়ি না থাকার সুযোগে কে যেন ওই মাটি বিক্রি করে দিয়েছে চায়না কোম্পানির কাছে।

ক্ষোভ আর কান্নায় ভেঙে পড়ে আতাহার পহলান বলেন, মোর বাপের, দাদীর, স্ত্রী, পোলার কবরের মাডি দেবে ওয়াবদার রাস্তায়! সব মানষে হেইর উপর পারাইয়া আডবে। এই কষ্ট মুই কেমনে সই!

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ৩৫/১ পোল্ডারের বিশ্ব ব্যাংকের সহায়তায় বেঁড়ি বাঁধ নির্মাণের কাজ শুরু হলে এক শ্রেনির দালাল সরকারি খাস জমি ও নদী সংলগ্ন চরের মাটি বিক্রি করে লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এ চক্রটি আতাহার পহলান বাড়ি না থাকার সুযোগ নিয়ে কবরস্থানসহ ওই মাটি চায়না কোম্পানির কাছে বিক্রি করে দেয়।

এ ব্যাপারে মাটি কেনাবেচার সাথে জড়িত চায়না কোম্পানির এক প্রতিনিধি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ৬৭ কিলোমিটার বেড়ি বাঁধের বলেশ্বর অংশে পর্যাপ্ত মাটি পাওয়া যাচ্ছে না। মাটির অভাবে বাঁধ নির্মাণ কাজ ব্যাহত হচ্ছে। তাই যেখানে যখন যতটুকু মাটি পাওয়া যাচ্ছে তাই সংগ্রহ করা হচ্ছে।

আতাহার পহলানের কবরস্থান সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি জানান, কেউ হয়তো কাগজপত্র দেখিয়ে মাটি বিক্রি করেছে। এছাড়া যেহেতু কেউ বাঁধা দেয়নি ও কবর ছিল কি না তা আমরা জানি না। তাই সেভাবেই হয়তো মাটি সংগ্রহ করা হয়েছে।

এ ব্যাপারে প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্বে নিয়োজিত বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিনিধি শ্যামল কুমার দত্ত বলেন, বৈধ মালিকের অনুমতি ছাড়া মাটি সংগ্রহের কোনো নিয়ম নেই। এ ব্যাপারে অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top