ভারতীয় সেনাবাহিনীকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করা হচ্ছে : রাষ্ট্রপতিকে চিঠি লেখা নিয়ে তোলপাড়

ভারতের রাষ্ট্রপতিকে লেখা অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্তাদের লেখা চিঠি ঘিরে বিতর্ক তুঙ্গে। দেড় শতাধিক সাবেক সেনা কর্তা রামনাথ কোবিন্দকে আর্জি জানিয়েছেন, সেনাকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করতে দেবেন না। কিন্তু এই চিঠি নিয়ে হইচই শুরু হতেই সাবেক সেনা প্রধান এসএফ রডরিগেজ এবং সাবেক বিমানবাহিনী প্রধান এন সি সুরি দাবি করেছেন, তারা ওই চিঠির বিষয়ে তারা কিছুই জানেন না। আবার রাষ্ট্রপতি ভবন এরকম কোনো চিঠি পায়নি, জানিয়েছেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী নির্মলা সীতারামন। অন্য দিকে অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল হর্ষ কক্কর জানিয়েছেন, তিনি ওই চিঠিতে তার নাম ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছেন। সব মিলিয়ে এই চিঠির সত্যতা এবং উদ্দেশ্য নিয়ে যেমন প্রশ্ন উঠেছ, তেমনই বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে নানা মহলে।

দেড় শতাধিক অবসরপ্রাপ্ত সেনা অফিসার রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দকে বৃহস্পতিবা র চিঠি লিখে আর্জি জানিয়েছিলেন, নিজেদের স্বার্থে যাতে সেনাকে ব্যবহার না করে, তার জন্য রাজনৈতিক দলগুলিকে নির্দেশ দিন রাষ্ট্রপতি। চিঠির বক্তব্য, এই প্রবণতা ‘উদ্বেগজনক ও অস্বস্তিকর’। তাই সেনাবাহিনীর ‘নিরপেক্ষ ও অরাজনৈতিক ভাবমূর্তি’ বজায় রাখার স্বার্থেই রাষ্ট্রপতির দ্বারস্থ সাবেক সেনা কর্তা-অফিসাররা।

নির্বাচনী আচরণ বিধি কার্যকর থাকার পরও ভারতীয় সেনাবাহিনীকে রাজনৈতিক দলগুলো নিজের স্বার্থ চরিতার্থ করতে ব্যবহার করছে— এই অভিযোগ তুলেছেন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্তারা। চিঠিতে তাদের বক্তব্য, ‘‘সুপ্রিম কমান্ডার হিসেবে আপনাকে আমরা এই চিঠি লিখছি কারণ, কিছু বিষয়ে তিন বাহিনীর কর্তব্যরত এবং অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্তা থেকে জওয়ান সবারই উদ্বেগ বাড়ছে এবং অস্বস্তির সৃষ্টি করছে।’’ এমনকি উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ যে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে ‘মোদীজি কি সেনা’ বলেছিলেন, সেই প্রসঙ্গও উল্লেখ করেছেন সাবেক সেনা কর্তারা। এ ছাড়াও সেনার পোশাক বা লোগো ব্যবহার করে প্রচার, অভিনন্দন বর্তমানের ছবি ব্যবহারেরও আপত্তি জানানো হয়েছে ওই চিঠিতে।

সংবিধান অনুযায়ী ভারতীয় সেনাবাহিনীর তিন বাহিনীর ‘সুপ্রিম কমান্ডার’ অর্থাৎ সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক দেশের রাষ্ট্রপতি। সেই কারণেই রাষ্ট্রপতির কাছে বর্ষীয়ান অবসরপ্রাপ্ত সেনাকর্তারা উদ্বেগ প্রকাশ করে লিখেছেন, ‘‘এই প্রবণতা দেশের সংবিধানের পরিপন্থী। এতে কর্তব্যরত সেনাকর্মী-অফিসারদের যেমন মনোবল নষ্ট হবে, তেমনই অবসরপ্রাপ্তদের কাছেও বিড়ম্বনার।’’ তাই সুপ্রিম কমান্ডারের কাছে তারা আর্জি জানিয়েছেন, রাজনৈতিক দলগুলোকে রাষ্ট্রপতি নির্দেশ দিন, যাতে রাজনৈতিক দলগুলো সেনাকে তাদের স্বার্থে ব্যবহার না করে। এতে সেনাবাহিনীর ‘নিরপেক্ষ ও অরাজনৈতিক ভাবমূর্তি’ ক্ষুণ্ণ হবে বলেই মত এই অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্তাদের। নির্বাচন কমিশনের বিজ্ঞপ্তির পরও এই প্রবণতায় ‘খুব একটা পরিবর্তন হয়নি’— উল্লেখ করা হয়েছে চিঠিতে।

গণ মাধ্যম এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় সেই চিঠি নিয়ে নানা প্রতিবেদন ও মতামত প্রকাশের পরই এ নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। কেন? ছাপানো ওই চিঠিতে ছাপার অক্ষরেই নাম রয়েছে সেনার তিন বাহিনীর অন্তত আটজন সাবেক সেনাপ্রধানের। সব মিলিয়ে চিঠিতে ১৫৬ জনের নাম, যাদের মধ্যে ওই সেনা প্রধানরা ছাড়াও সেনাবাহিনীর উচ্চ পদস্থ সাবেক কর্তা অফিসারের। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য অবসরপ্রাপ্ত সেনা প্রধান এসএফ রডরিগেজ, অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল শঙ্কর রায়চৌধুরি, অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল দীপক কাপুর, চার সাবেক নৌবাহিনীর প্রধান এবং সাবেক বিমানবাহিনীর প্রধান এন সি সুরি।

পত্র-বিতর্ক শুরু হতেই হইচই পড়ে যায়। অস্বস্তি বাড়ে কেন্দ্রের। তার পরই সাবেক সেনা প্রধান রডরিগেজ সংবাদ সংস্থা এএনআই-কে জানিয়েছেন, এই চিঠির বিষয়ে তিনি সম্পূর্ণ অন্ধকারে। তিনি বলেছেন, ‘‘আমরা সেনাবাহিনীতে থাকার সময় সরকার যে নির্দেশ দিয়েছে, সেভাবেই কাজ করেছি। আমরা অরাজনৈতিক। যে কেউ যা খুশি বলতে পারে, ফেক নিউজ হিসেবে চালাতে পারে। কিন্তু আমি জানি না, এই চিঠি কে লিখেছেন।’’ তার আরো বক্তব্য, ‘‘ওই চিঠির বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। ৪২ বছর সেনা অফিসার হিসেবে কাজ করার পর এখন কোনো কিছু পরিবর্তন করার পক্ষে দেরি হয়ে গেছে। তবে সব কিছুর আগে দেশকেই প্রাধান্য দিয়েছি। জানি এই লোকগুলো কারা (যারা বা যিনি চিঠি লিখেছেন)। এই চিঠিতে তিনি ফেক নিউজ বলেও উল্লেখ করেছেন।

সাবেক বিমানবাহিনীর প্রধান এন সি সুরির বক্তব্যও প্রায় একই রকম। তিনিও সংবাদ সংস্থাকে বলেছেন, ‘‘আমি লিখেছিলাম, সেনাবাহিনী অরাজনৈতিক এবং নির্বাচিত সরকারকে সমর্থন করে। কিন্তু এই ধরনের কোনো চিঠির জন্য আমার অনুমতি নেয়া হয়নি। চিঠির সব বক্তব্যের সঙ্গেও আমি একমত নই। আমাকে ভুলভাবে উদ্ধৃত করা হয়েছে।’’

এতেই প্রশ্ন ওঠে, তবে কি এন সি সুরির মতোই আরো অনেকে রয়েছেন। সেই সম্ভাবনা উড়িয়ে দিচ্ছে না সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ওয়াকিবহাল শিবিরের একাংশ। আবার রাষ্ট্রপতি ভবন সূত্রেও জানানো হয়েছে, এই ধরনের কোনো চিঠি তারা পায়নি। ফলে বিতর্ক আরো জোরালো হয়েছে।

অন্য দিকে চিঠিতে নামের তালিকায় ৩১ নম্বরে থাকা হর্ষ কক্কর বলেছেন, ‘‘ওই চিঠির বিষয়বস্তু জানার পর আমি আমার নাম ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছি।’’ এতে আবার ছড়িয়েছে চূড়ান্ত বিভ্রান্তি।

২০১৯ লোকসভা ভোটের হাওয়া গরম হওয়ার মুখেই গত ১৪ ফেব্রুয়ারি পুলওয়ামায় আত্মঘাতী আত্মঘাতী হামলা হয়। তার জবাব হিসেবে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের বালাকোটে ভারতীয় বিমান বাহিনীর অভিযান এবং বিমানবাহিনীর উইং কমান্ডার অভিনন্দন বর্তমান পর্ব। অভিনন্দনের ঘটনা এবং বালাকোটের অভিযানকে ঢাক ঢোল পিটিয়ে সরকারের সাফল্য হিসেবে প্রচার করে আসছে বিজেপি। সেই কারণেই গত ১০ মার্চ ভোটের দিনক্ষণ ঘোষণার দু’দিন আগেই নির্বাচন কমিশন এ নিয়ে সতর্কতা জারি করে। এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, সেনাবাহিনীকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করা যাবে না। কিন্তু তার পরও থামেনি। এমনকি, এখনও বিভিন্ন নির্বাচনী জনসভায় খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি পর্যন্ত সেনাবাহিনীর এই কৃতিত্বকে প্রচার করে চলেছেন।

কিন্তু দিল্লির বিজেপি সভাপতি মনোজ তিওয়ারি তো আবার আরো এক কদম এগিয়ে সেনাবাহিনীরর পোশাকে হাজির হয়েছিলেন রাজনৈতিক কর্মসূচিতে। আবার কয়েক দিন আগেই যোগী আদিত্যনাথ একটি নির্বাচনী সভায় ভারতীয় সেনাবাহিনীকে ‘মোদিজি কি সেনা’ বলেছিলেন। আবার কংগ্রেসে যোগ দেয়ার পর বলিউড অভিনেত্রী উর্মলিা মার্তণ্ডকরের মুম্বইয়ের একটি প্রচার কর্মসূচিতে অভিনন্দন বর্তমানের পোস্টার দেখা গেছে।

এই সব বিষয়েই চিঠিতে উল্লেখ করে রাষ্ট্রপতিকে উদ্যোগী হতে আর্জি জানানো হয়েছে ওই চিঠিতে। কিন্তু তা নিয়ে যে বিতর্ক তৈরি হয়েছে, এবং যে ভাবে দুই সাবেক সেনাবাহিনী কর্মকর্তা প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন, তাতে তার ভিত্তি নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে। পাশাপাশি এই বিতর্ক তৈরি হওয়ায় চিঠির আসল উদ্দেশ্যের অভিমুখই ঘুরে গেল বলে মত রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের।
সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top