বাংলাদেশ জুড়ে কালের সাক্ষী হয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে হাজারো ঐতিহাসিক স্থাপনা। এসকল স্থাপনার মধ্যে বিবিচিনি শাহী মসজিদ দেশের অন্যতম পুরাতন স্থাপনা। প্রায় সাড়ে তিনশ বছরের পুরাতন এই স্থাপনাটি উপমহাদেশের প্রাচীন ঐতিহ্যের জানান দিচ্ছে আজও। সাক্ষী বহন করছে আমাদের পূর্ব পুরুষদের হারানো গৌরব, মর্যাদা ও ঐতিহ্যের। তবে উপমহাদেশের সিংহভাগ মানুষেরই এই পুরাকৃর্তী সম্পর্কে অজানা। এমনকি স্থানীয় তরুণ প্রজন্মের কাছেও এর সঠিক ইতিহাস জানা নেই।
বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে মোঘল স্থাপত্যের নিদর্শন হিসেবে যে কয়টি মসজিদ রয়েছে তারই মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি হলো বিবিচিনি শাহী মসজিদ। এই ঐতিহাসিক স্থাপনাটি স্থাপিত হয়েছিল ১৬৫৯ খ্রিস্টাব্দে দক্ষিণাঞ্চলের বর্তমান বরগুনা জেলার বেতাগী উপজেলার বিবিচিনি ইউনিয়নে।
মসজিদ এলাকায় পা রাখতেই দূর থেকে ছোট্ট টিলার উপরে দাঁড়িয়ে থাকা মসজিদটির একমাত্র গম্বুজটিতে চোখে পড়ে। শেষ বিকেলের সোনালী আভায় গম্বুজটির সৌন্দর্য যেন হাজার গুণ বৃদ্ধি পায়। চারপাশে সবুজে ঘেরা নানা ধরনের গাছ। সবুজের হাতছানিকে পাশ কাটিয়ে কংক্রিটের সিঁড়ি বেয়ে ৩০ ফুট উঁচু টিলায় অবস্থিত মসজিদটিতে দ্রুত উঠতেই যেন শরীরে কিছুটা ক্লান্তি অনুভব হয়। তবে কৌতুহলী মনে প্রবল আগ্রহ বাসা বাধে চারদিকটা ভাল করে দেখার জন্য। তাই মসজিদের সামনে পাকা মেঝেতে বসেই মুহূর্তের মধ্যে চোখ দু’টো ঘুরতে শুরু করল মসজিদের চারদিকে।
দিগন্ত জোড়া সবুজের মাঝখানে ৩০ ফুট উঁচু টিলার উপর দাঁড়িয়ে থাকা বিবিচিন শাহী মসজিদের ভবনটি প্রায় ২৫ ফুট উঁচু। মসজিদটির দৈর্ঘ্য ৩৩ ফুট, প্রস্থ ৩৩ ফুট, দেয়ালগুলো ৬ ফুট চওড়া। দক্ষিণ ও উত্তরে তিনটি দরজা রয়েছে। মসজিদের ইটগুলো মোঘল আমলের ইটের মাপের সমান। সরাসরি না দেখলে এই পুরাকৃর্তীর সৌন্দর্য কোনভাবেই উপলব্ধি করা সম্ভব নয়।
জানা যায়, সম্রাট শাহজাহানের শাসন আমলে ১৬৫৯ খ্রিস্টাব্দে শাহ নেয়ামতুল্লাহ পারস্য থেকে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশে দিল্লীতে আসেন। ওই সময় সম্রাট শাহজাহানের দ্বিতীয় পুত্র ও বাংলার সুবাদার শাহ সুজা তার শীষ্যত্ব গ্রহণ করেন। ১৬৫৯ খ্রিস্টাব্দের শেষের দিকে ইসলাম প্রচারের জন্য শাহ নেয়ামতুল্লাহ শীষ্যসহ বজরায় চড়ে গঙ্গা নদী অতিক্রম করে বিষখালী নদীতে (তৎকালীন চন্দ্রদ্বীপে) নোঙ্গর করেন।
তখন শাহ সুজার অনুরোধে ওই গ্রামে এক গম্বুজ বিশিষ্ট শাহী মসজিদটি প্রতিষ্ঠা করেন। পরে সাধক নেয়ামতুল্লাহ শাহের কন্যা চিনিবিবি ও ইছাবিবির নামের সঙ্গে মিলিয়ে ওই গ্রামের নামকরণ বিবিচিনি করা হয়। শাহ নেয়ামতুল্লাহর নামের সঙ্গে মিল রেখেই বিবিচিনি গ্রামের পার্শ্ববর্তী গ্রামের নামকরণ করা হয় নেয়ামতি। এক সময় অঞ্চলটি ছিল মগ-ফিরিঙ্গিদের আবাস্থল। তাদের হামলার প্রতিরোধে মসজিদটি অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।
মোঘল স্থাপত্যের গৌরব, মর্যাদা ও ইতিহাসের সাক্ষী হিসেবে শুধু উপমহাদেশেই নয় গ্রেট ব্রিটেনের যাদুঘরেও এই স্থাপত্যটি সম্পর্কে তথ্য পাওয়া গেছে। সেই তথ্য অনুযায়ী স্থাপনাটি ৫শ’ বছর আগের নিদর্শন বলে উল্লেখিত।
বিবিচিনি শাহী মসজিদটিকে দক্ষিণ বাংলার ইসলাম প্রচারের কেন্দবিন্দু হিসেবে অভিহিত করা হয়। তবে কালের বিবর্তনে এর ঐতিহ্য অনেকটা বিলুপ্তির পথে। তবুও টিকে থাকা ধ্বংসাবশেষ পুরনো ঐতিহ্য ও গৌরবের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
স্থানীয়ভাবে মসজিদটি নিয়ে কিছু কাহিনী প্রচলিত আছে। বলা হয়ে থাকে, শাহ নেয়ামতুল্লাহের দ্বীনি প্রচারে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হন বহু হিন্দু ও বৌদ্ধ। স্থানীয় লোকমুখে প্রচলিত ওই সময় বিষখালী নদীর পানি ছিল লবণাক্ত। সুপেয় পানির অভাবে মানুষের কষ্ট দেখে শাহ নেয়ামতুল্লাহ নিজের তসবিহ বিষখালী নদীতে ভিজিয়ে দেন, এরপর থেকেই নদীর পানির লবনাক্ততা দূর হয়। তাছাড়া সে যুগে সুন্দরবন সংলগ্ন এই অঞ্চলের নদীগুলোতে অসংখ্য কুমির ছিল। কিন্তু একই কারণে বিষখালী নদীতে কুমির আসত না বলে প্রচলিত আছে।
মসজিদের পাশেই রয়েছে ৩টি কবর, কবরগুলো সাধারণ কবরের মতো হলেও লম্বায় ১৪-১৫ হাত। মসজিদের পশ্চিম ও উত্তর পাশে অবস্থিত কবরে শায়িত আছেন সাধক নেয়ামতুল্লাহ এবং তার দুই মেয়ে চিনিবিবি ও ইছাবিবি। ১৭০০ সালে সম্রাট আওরঙ্গজেবের রাজত্বকালে নেয়ামত শাহ মারা যান বলে জানা যায়। উল্লেখ্য, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর কর্তৃক মসজিদটি তালিকাভুক্ত করে এর সংস্কার করা হয়েছে।