যুদ্ধকে এবার মহাকাশেও নিয়ে যাচ্ছে ভারত

উত্তেজনা ছিল মূলত কাশ্মির সীমান্তে পাকিস্তান আর ভারতের মধ্যে আর দোকালামে ভারত ও চীনের মধ্যে। তারপর ভারত মহাসাগর, আন্দামান সাগর আর আরব সাগরে ছিল তার ধারাবাহিকতা। স্থল সীমান্তে উত্তেজনা দেখা দিলে তার রেশ পড়ত সাগর-মহাসাগরে। আকাশযুদ্ধও হতো। অন্তত সাম্প্রতিক আকাশযুদ্ধ এবং ভারতের মিগ হারানো ও তার জের ধরে এক পাইলটকে আটক করেছিল পাকিস্তান।
কিন্তু এবার ভারত ওই যুদ্ধকে নিয়ে গেল মহাকাশে। আর তাদের প্রতিপক্ষ কিন্তু কেবল পাকিস্তান বা চীনই নয়। এমনকি ওই অস্ত্রের আঘাতে মিত্র দেশগুলোও ক্ষতবিক্ষত হতে পারে।

ভারতের স্যাটেলাইট বিধ্বংসী পরীক্ষা কি মহাকাশে অস্ত্র প্রতিযোগিতা উসকে দেবে? এই প্রশ্নের জবাব ‘না’ হওয়ার সম্ভাবনা বলতে গেলে নেই। স্যাটেলাইটবিধ্বংসী অস্ত্রের সফল পরীক্ষা চালানোর ঘোষণা দেয়ার মাধ্যমে ভারত এর সূচনা করে দিলো। ভারত তার শক্তির পরীক্ষা দিতে ‘মিশন শক্তি’তে এএসএটিবাহী মিসাইল দিয়ে ৭৪০ কেজি ওজনের একটি মাইক্রোস্যাটেলাইট ধ্বংস করেছে। মিশন পরিচালনা করেছে ভারতের মহাকাশ সক্ষমতা নিয়ে কাজ করে যে প্রতিষ্ঠান- সেই ইন্ডিয়ান ডিফেন্স রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন। যে স্যাটেলাইটটিকে ধ্বংস করা হয়েছে, তা ‘মাইক্রোস্যাট আর’ নামে পরিচিত একটি ‘লাইভ’ স্যাটেলাইট।

নিম্ন কক্ষপথ বা ৩০০ কিলোমিটার উচ্চতার অর্থ হলো মাইক্রোস্যাট আর ধ্বংসের বেশির ভাগ ধ্বংসাবশেষ বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করে দ্রুত পুড়ে নিঃশেষ হয়ে যাবে। এই বিবেচনায় ভারতের পরীক্ষাটা বেইজিং ২০০৭ সালে যে পরীক্ষা করেছিল তার থেকে অনেকটাই আলাদা। বেইজিং ওই পরীক্ষাটা চালিয়েছিল ৮০০ কিলোমিটার উচ্চতায়, যেটার ধ্বংসাবশেষ এখনো কক্ষপথে রয়ে গেছে।

ভারতের পরীক্ষাটা ২০০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের পরিচালিত বার্ন্ট ফ্রস্ট পরীক্ষার কাছাকাছি। ওই সময় মার্কিন নৌবাহিনীর একটি জাহাজ থেকে এসএম-৩ মিসাইল ছুড়ে ২৮০ কিলোমিটার উচ্চতায় থাকা একটি অকার্যকর স্যাটালাইটকে ধ্বংস করা হয়েছিল। নি¤œ কক্ষপথে পরীক্ষার উদ্দেশ্য ছিল যাতে বিস্ফোরণের ধ্বংসাবশেষ ছড়িয়ে না পড়ে।

ভারতের এএসএটি পরীক্ষার উদ্দেশ্য হলো মহাকাশ সক্ষমতায় চীনের বিরুদ্ধে নয়াদিল্লির সক্ষমতা প্রদর্শন- অন্তত নিম্ন কক্ষপথে হলেও এই সক্ষমতা দেখানো। ব্রায়ান উইডেন ও ভিক্টোরিয়া স্যাম্পসন তাদের ২০১৮ সালের বৈশ্বিক মহাকাশ পর্যালোচনায় বলেছেন যে চীন নিশ্চিতভাবে মার্কিন স্যাটেলাইট ধ্বংসের জন্য এএসএটি শ্রেণীর মিসাইল মোতায়েন করেছিল।

আশঙ্কার ব্যাপার হলো, এই অস্ত্র সহজেই ভারতের বিরুদ্ধেও ব্যবহার হতে পারে। যেকোনো সঙ্কটের সময় সেটা ব্যবহার করে ভারতের সামরিক বাহিনীর মহাকাশ সক্ষমতা কমিয়ে দিতে পারবে চীন। এটা কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোলের কার্যকারিতা নষ্ট করে দেবে, মহাকাশ-ভিত্তিক গোয়েন্দা নজরদারি ব্যবস্থাকে নষ্ট করে দেবে, ফলে ভারতীয় বাহিনী কার্যত বোবা, কালা ও অন্ধ হয়ে যাবে। ভারতের এএসএটি সক্ষমতা না থাকলে চীনের আসলে ভারতকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই।

এ কারণে ধরে নেয়া যায় যে চীনের বিরুদ্ধে মহাকাশ প্রতিরোধ গড়ে তুলতেই এই পরীক্ষা চালিয়েছে ভারত। হয়তো পাকিস্তানের বিষয়টিও মাথায় রয়েছে তাদের (যদিও পাকিস্তান মহাকাশ গবেষণায় ভারতের থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছে)। এই পরীক্ষা ব্যালিস্টিক মিসাইল গড়ার ক্ষেত্রেও ভারতকে সহায়তা করবে। স্যাটেলাইট বিধ্বংসী এএসএটি পরীক্ষার মাধ্যমে যে সক্ষমতা প্রদর্শিত হলো, সেটা দিয়ে দূরপাল্লার মিসাইলকেও ঠেকানো সম্ভব। এটা পাকিস্তানের জন্য একটা বার্তা হতে পারে কারণ পাকিস্তানের শাহিন-টু এবং শাহিন-থ্রি মাঝারি পাল্লার ব্যালিস্টিক মিসাইল রয়েছে। আর চীন তো রয়েছেই, যাদের কাছে ভারতের যেকোনো জায়গায় আঘাত হানার মতো মিসাইল রয়েছে।

ভারত মনে করছে, এএসএটি পরীক্ষা একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্জন যেটা জাতীয় সম্মান বাড়াবে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যেভাবে পরীক্ষাটির বিষয়টি প্রকাশ করেছেন, তাতে ভারতের গর্বের বিষয়টি প্রকাশ পেয়েছে: ‘মিশন শক্তির অধীনে পরীক্ষা চালানোর মাধ্যমে আমরা স্পেস সুপার লিগে প্রবেশ করেছি’।

কিন্তু পরীক্ষাটির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে চীন ও পাকিস্তানসহ অনেকেই। এমনকি ভারতের মিত্র যুক্তরাষ্ট্র পর্যন্ত উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তাদের মতে, মহাকাশে যে জঞ্জাল সৃষ্টি হয়েছে, তা অন্যান্য স্যাটলাইটকেও ধ্বংস করে দিতে পারে। ফলে বড় ধরনের ক্ষতির কারণ হতে পারে ভারতের এই পরীক্ষা।

কিন্তু এর মাধ্যমে নতুন একটি বিধ্বংসী যুগের সূচনা যে হলো, তার মাসুল কিন্তু সবাইকে দিতে হবে।

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top