লিবিয়ায় আরেক গাদ্দাফি!

এক সময়ে লিবিয়া আর গাদ্দাফির মধ্যে কোনো পার্থক্য ধরা হতো না। লিবিয়া মানেই গাদ্দাফি, আর গাদ্দাফি মানেই লিবিয়া। ১৯৬৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর তিনি দেশটির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। আরব বসন্তের জেরে সে দায়িত্ব শেষ হয় ২০ অক্টোবর ২০১১ সালে। আট বছর পর সেই লিবিয়ায় শোনা যাচ্ছে তেমনই আরেকজনের নামডাক।

লিবিয়ার পূর্বাঞ্চলের বেশির ভাগ নিয়ন্ত্রণকারী, নিজস্ব লিবিয়ান ন্যাশনাল আর্মির (এলএনএ) কমান্ডার ও শক্তিশালী সামরিক ব্যক্তি খলিফা হাফতার দেশটিতে সর্বাত্মক সামরিক সঙ্ঘাত উসকে দিয়েছেন। তিনি যা চেয়েছেন তা অর্জন করতে না পারলে সেনাবাহিনী ব্যবহার করে ত্রিপোলির আন্তর্জাতিক স্বীকৃত সরকারকে ভয় দেখিয়েছেন।

তাকে দেশটির সামগ্রিক সামরিক কমান্ডার হিসেবে স্বীকৃতি না দিলে তিনি ত্রিপোলিতে সেনা অভিযানের হুমকি দেন। এর ফলে দেশটির পরিস্থিতি খুব শিগগিরই মারাত্মক গৃহযুদ্ধে রূপ নিতে পারে। মিসর, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ফ্রান্স, রাশিয়া ও অন্যদের কাছ থেকে রাজনৈতিক ও উপকরণগত সহায়তা পাচ্ছেন হাফতার। এটা বিশ্বাস করা হয় যে এই ধরনের সমর্থন তেলসমৃদ্ধ লিবিয়ার সম্পদের সাথে সরাসরি সংযুক্ত। এই আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে হাফতার দেশটির পূর্ব অংশে আধিপত্য বিস্তার করেছেন এবং সম্প্রতি সেভা অঞ্চলে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছেন। এদিকে হাফতার ধারাবাহিকভাবে গভর্নমেন্ট অব ন্যাশনাল অ্যাকর্ডের (জিএনএ) বৈধতা দিতে অস্বীকার করেছেন এবং সময়ক্ষেপণের জন্য আলোচনাকে ব্যবহার করছেন।

লিবিয়ার তেলসম্পদ নিয়ন্ত্রণের সংগ্রাম চলমান দ্বন্দ্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ চালিকাশক্তি। ধারণা করা হয় যে এখন দিনে এক লাখেরও বেশি ব্যারেল তেল উৎপাদনের নিয়ন্ত্রণে রয়েছেন হাফতার। তেল উৎপাদন নিয়ন্ত্রণের এ ক্ষমতা হাফতারের আয়ের উল্লেখযোগ্য উৎস যা তাকে মিলিশিয়া দলগুলো পরিচালনায় সক্ষমতা দিয়েছে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে হাফতার বাহিনী লিবিয়ায় বৃহত্তর অংশে তাদের অবস্থান বাড়িয়েছে এবং তিনি বারবার লিবিয়ার দিকে যাত্রার ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। বর্তমানে হাফতার বাহিনী দেশের পশ্চিমাঞ্চলের দিকে অগ্রসর হচ্ছে যা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ত্রিপোলি ভিত্তিক সরকারকে সামরিক সতর্কতা জারিতে বাধ্য করেছে।

জাতিসঙ্ঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস রাজধানী ত্রিপোলির দক্ষিণে বিরোধী শক্তিদের সাথে সম্ভাব্য সশস্ত্র সংঘর্ষের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। বিরোধী দল ও বাহিনীর মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান পৌঁছাতে জাতিসঙ্ঘের প্রচেষ্টা সত্ত্বেও লিবিয়া বিভক্ত হয়ে রয়েছে।

যদিও জাতিসঙ্ঘ অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছে তবে হাফতারকে কোনো ধরনের আপসের বিষয়ে অনাগ্রহী দেখা যাচ্ছে। তিনি গাদ্দাফির মতো স্বৈরশাসক হতে চান এবং এ মাসে জাতিসঙ্ঘের পৃষ্ঠপোষকতায় জাতীয় পুনর্মিলন সম্মেলনের আগে ত্রিপোলির ওপর তার আক্রমণটিকে বাস্তব পরিস্থিতিতে তার ব্যাপকভাবে পরিবর্তনের চেষ্টা হিসেবে দেখা হচ্ছে।

ব্রিটেনসহ বেশ কয়েকটি দেশ হাফতারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের দাবি জানিয়েছে। ধারণা করা হয় যে, ব্রিটিশ ও জার্মান সরকার কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে এবং নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারে যা হাফতারের আক্রমণের নিন্দা জানাতে ও বিরোধিতা করতে ফ্রান্সকে চাপ সৃষ্টি করতে পারে।

অভিবাসী ও উদ্বাস্তু প্রবেশের নতুন গতি সম্পর্কে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন ইউরোপ। এর ফলে ইইউ পররাষ্ট্র মন্ত্রীরা ত্রিপোলিতে হাফতারের হামলার নিন্দা এবং দেশের স্থিতিশীলতার জন্য একসাথে কাজ করার জন্য সব পক্ষকে আহ্বান জানাবেন বলে আশা করা যাচ্ছে।

হাফতার জিএনএকে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করেছে এই দাবিতে যে তারা মিলিশিয়া বেষ্টিত। এ জন্য মিলিশিয়াদের কাছ থেকে ত্রিপোলিকে ‘মুক্ত’ করার অঙ্গীকার করেছেন তিনি। ফলে দেশটিতে ঐক্যের সরকার গঠনের লক্ষ্যে জাতিসঙ্ঘের মধ্যস্থতায় ২০১৫ সালে করা লিবিয়া পলিটিক্যাল এগ্রিমেন্ট (এলপিএ) বাস্তবায়নে প্রাথমিক বাধা হিসেবে রয়েছেন তিনি।

এলপিএ চুক্তি অনুমোদনে বা কোন সংশোধন মানতে আগ্রহী নন হাফতার। তার কর্মকাণ্ড শেষ পর্যন্ত চলমান গৃহযুদ্ধের দীর্ঘমেয়াদি সমাধান খোঁজার আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। তাকে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে একজন শক্ত মানুষ বিবেচনা করা হলেও বাস্তবে রাজনৈতিক সমাধানের পথে এক প্রতিবন্ধক হিসেবে প্রমাণিত হয়েছেন হাফতার। তার সিদ্ধান্ত শান্তি চুক্তির সম্ভাবনা কমিয়ে দিয়েছে এবং নিরাপত্তা পরিস্থিতির অবনতিতে অবদান রেখেছে। এর ফলে গেরিলা যুদ্ধ ও সন্ত্রাসবাদ বৃদ্ধি পেতে পারে। অতএব চলমান অস্থিতিশীলতা কমিয়ে আনার লক্ষ্যে এলপিএ মেনে নিতে হাফতারকে চাপ দেয়া আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক শক্তিগুলোর দায়িত্ব।

অতএব আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের কোনো বিকল্প নেই। লিবিয়া পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি ঠেকাতে প্রয়োজন আইনের শাসন দ্বারা পরিচালিত দৃঢ়প্রতিজ্ঞ নেতৃত্বের এবং সমন্বিত নীতি অনুসরণ করা গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহ। লিবিয়ার এমন একটি সরকার, প্রতিষ্ঠানসমূহ এবং একটি সংবিধান প্রয়োজন যা সঙ্ঘাতের পরিবেশের পর স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে পারে। এর ফলে মিলিশিয়াদের নিরস্ত্রীকরণ ও পুনর্গঠন এবং প্রতিদ্বন্দ্বী স্বার্থ ও ক্ষমতার কেন্দ্রগুলোর মধ্যে মধ্যস্থতা করা যাবে।

একটি টেকসই রাজনৈতিক পরিবর্তন নিশ্চিত করা আবশ্যক, পাশাপাশি সন্ত্রাসবাদ, চোরাচালান ও অস্ত্র বিস্তারের বিরুদ্ধে লড়াই চালানো। এটা স্পষ্ট যে লিবিয়ার দ্বন্দ্ব সামরিকভাবে সমাধান করা যাবে না এবং কোনো দল তাদের সুবিধানুযায়ী সামরিকভাবে সমাধান করতে সক্ষমও নয়। তাই আন্তর্জাতিক শক্তির অবশ্য কর্তব্য একটি রাজনৈতিক মীমাংসাকে উৎসাহিত করা, যা সব রাজনৈতিক দলকে রাজনৈতিক সমাধান গ্রহণে এবং দেশের স্থিতিশীলতার জন্য একত্রে কাজ করতে সব লিবিয়ান পক্ষকে উৎসাহিত করতে পারে।

বিশ্বব্যাপী ২০১৮ সালের বিপি স্ট্যাটিস্টিকাল রিভিউ অব ওয়ার্ল্ড এনার্জি অনুসারে লিবিয়ায় ৪৮.৪ বিলিয়ন ব্যারেলের অপরিশোধিত তেলের মজুদ আফ্রিকায় বৃহত্তম। লিবিয়ার জনগণ তাদের নিজস্ব সমৃদ্ধ সম্পদ ব্যবহার করার সুযোগ পেলে একটি বিচ্ছিন্ন রাষ্ট্র পুনর্নির্মাণের প্রক্রিয়া শুরু করতে পারে। এ ক্ষেত্রে ব্যর্থ হলে আরো দ্বন্দ্ব বেড়ে যেতে পারে।

অতএব প্রথম ধাপ হওয়া উচিত জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান যা লিবিয়াকে স্থিতিশীল করতে প্রয়োজন। অন্যথায় রাজনৈতিক সমাধানের অভাব সহিংসতার নানা পথ তৈরি করবে। লিবিয়ায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যত দেরি হবে দেশটির রাজনৈতিক শূন্যতা আরো বিপজ্জনক হয়ে উঠবে। এটি দীর্ঘস্থায়ী অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার পরিস্থিতি তৈরি করবে এবং সম্ভবত কেন্দ্রীয় শাসনের স্থায়ী পতন ঘটাবে।

আরো গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে হাফতারের ভূমিকা, যেটিকে দেশকে ঐক্যবদ্ধ করার ক্ষেত্রে প্রধান বাধা মনে করা হয়। সুতরাং দেশটিতে শান্তি ও স্থিতিশীলতা আনতে সম্মত হতে হাফতারকে চাপ দেয়া আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক শক্তিগুলোর দায়িত্ব। লিবিয়ার সঙ্কট কেবল লিবিয়াকেই নয় বরং পুরো অঞ্চলটিকেই প্রভাবিত করছে। তাই স্থিতিশীলতার জন্য একটি বাস্তব কৌশল নেয়া এই পর্যায়ে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top