‘গা ঘেঁষে দাঁড়াবেন না’ টি-শার্টের নেপথ্য ও ভাইরাল হওয়ার গল্প
কয়েকদিন ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তুমুল সমালোচনার জন্ম দিয়েছে টি-শার্টে লেখা একটি বার্তা- গা ঘেঁষে দাঁড়াবেন না। বাসে একজন নারী দাঁড়িয়ে আছেন, যার গায়ে পরিহিত টি-শার্টে লেখা ‘গা ঘেঁষে দাঁড়াবেন না’ – এরকম কয়েকটি ছবি বাংলাদেশে গত কয়েকদিন যাবৎ ফেসবুক ব্যবহারকারীদের মাঝে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
ঢাকার একটি ইন্টারনেটভিত্তিক নারীদের পোশাক ও অলঙ্কার তৈরির প্রতিষ্ঠান এ ডিজাইনের টি-শার্টটি তৈরি এবং বাজারজাত করেছে।
প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারীদের একজন এবং টি-শার্টের ডিজাইনার জিনাত জাহান নিশা বিবিসিকে জানান, গণপরিবহনে নিজের সাথে হওয়া হয়রানিমূলক ঘটনার প্রতিবাদ হিসেবেই এ ধরণের পণ্য তৈরি করার চিন্তা আসে তার মাথায়।
তিনি বলেন, কয়েক বছর আগে পাবলিক বাসে একবার যৌন হয়রানির শিকার হওয়ার পর প্রতিবাদ করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছিলেন তিনি। একজন বয়সী ব্যক্তির দ্বারা যৌন হয়রানির শিকার হওয়ার পর বাসেই প্রতিবাদ করেন তিনি। কিন্তু সেসময় সেখানে উপস্থিত মানুষজন তাকে সহায়তা না করে উল্টো তাকে থামার জন্য চাপ দেন।
তিনি বলেন, নিজে হয়রানির শিকার হওয়ার পরও প্রতিবাদ করতে না পারা এবং উপস্থিত মানুষজনকে অন্যায়কারীর পক্ষ নিতে দেখে সেদিন খুবই অপমানিত হয়েছিলাম। ঐ ঘটনার আগেও যৌন হয়রানির শিকার হলেও সেবারের ঘটনা তার ওপর অন্যরকম প্রভাব ফেলেছিল বলে জানান নিশা।
এর পরপরই প্রতিবাদ হিসেবে ‘গা ঘেঁষে দাঁড়াবেন না’ লেখা একটি খোঁপার কাঁটা তৈরি করেন এবং তার প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বাজারে ছাড়েন তিনি। এ ব্যাপারে তিনি বলেন, ছবি আঁকা, ডিজাইন করার মত কাজগুলোর মাধ্যমেই আমি আমার অনুভূতি শেয়ার করি এবং হালকা বোধ করি।
এ প্রচারণার প্রতিক্রিয়ায় অধিকাংশ মানুষ নেতিবাচক মন্তব্য করলেও আবার কিছু মানুষ এ উদ্যোগকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন।
নিশা জানান, খোঁপার কাঁটাটি তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ব্যানারে বাজারে ছাড়া হলেও এই পণ্যের মাধ্যমে বাণিজ্যিকভাবে লাভবান হওয়ার উদ্দেশ্য ছিল না বলে জানান।
তিনি মনে করেন, বাংলাদেশে গণপরিবহনে যৌন হয়রানির শিকার অধিকাংশ নারীই তাদের সাথে ঘটে যাওয়া অন্যায়ের প্রতিবাদ করেন না। ঐ নারীদের জন্য প্রতিবাদের একটি মাধ্যম হিসেবে গত নববর্ষের আগে খোঁপার কাঁটাটি বাজারে ছেড়েছিলেন তিনি।
খোঁপার কাঁটাটি বাণিজ্যিক সফলতা না পেলেও ঐ পণ্য সম্পর্কে দারুণ ইতিবাচক সাড়া পাওয়ায় এবছরেও একই বার্তা সম্বলিত ভিন্ন পণ্য বাজারে ছাড়ার পরিকল্পনা করেন নিশা।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে বাসে ভিড়ের মধ্যে নারীদের যৌন হয়রানির শিকার হওয়ার ঘটনা খুবই সাধারণ হয়ে গেছে। তার মতে, বাসে ভিড়ের মধ্যে গায়ের সাথে ধাক্কা লাগাটা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু অনেকেই ভিড়ের অন্যায় সুযোগটা নেন, যার প্রতিবাদ করা প্রয়োজন। নিশা বলেন, বাসে অনেক পুরুষের সাথেই ছোঁয়া বা ধাক্কা লাগলেও সেসব পুরুষের মধ্যে কারা সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করেন তা একজন নারী সহজেই বুঝতে পারেন।
ফেসবুকে যেভাবে ভাইরাল
‘গা ঘেঁষে দাঁড়াবেন না’ লেখা টি-শার্টের ছবি ভাইরাল হওয়ার পর এনিয়ে বিভিন্ন রকম আলোচনা-সমালোচনা তৈরি হয়েছে। এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাচ্ছেন অনেকে, আবার অনেকেই এর সমালোচনা করছেন।
মোস্তাফিজুর নূর ইমরান নামের একজন এই উদ্যোগের প্রশংসা করে বলেছেন, লোকে তো অনেক কিছ্ইু বলবে, লোকের কাজই বলা। এগিয়ে যাও।
অনেকে প্রশংসা বা অনুপ্রেরণা দিয়ে মন্তব্য করলেও নেতিবাচক মন্তব্য করা মানুষের সংখ্যাই বেশি বলে মনে করেন নিশা। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও অনেকে বিষয়টির সমালোচনা করেছেন। তারা বলেছেন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নারীদের এমন পোশাক পরা উচিত নয়। করিম নামের এক ব্যক্তি লিখেছেন, মানুষের কমেন্টগুলো দেখুন। আপনাদের বোঝা উচিত এটা বাংলাদেশ।
অনেকেই ছবিগুলোকে বিক্রি বাড়ানোর কৌশল বলে মন্তব্য করেছেন।
তবে জিনাত জাহান নিশা জানান, বিক্রি বাড়ানোর পদ্ধতি বা আলোচনায় আসার কৌশল হিসেবে এই পণ্য তৈরি করেননি তারা। সামাজিক মাধ্যমে এ ছবিগুলো ভাইরাল করার উদ্যোগ কিন্তু আমাদের পক্ষ থেকে নেয়া হয়নি। যারা এগুলো নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করছেন, ট্রল করছেন, তারাই এটিকে ভাইরাল করেছেন। তবে এভাবে সমালোচনা ছড়িয়ে পড়ার ফলে টি-শার্ট তৈরির উদ্দেশ্য সফল হয়েছে বলে মনে করেন নিশা।
সূত্র : বিবিসি